বৈশাখী নার্গিসের গুচ্ছ কবিতা : শহরের ডায়েরী


শহরের ডায়েরী 


ছেঁড়া পাতা ২৪ 

একটা অর্ধেক কেটে যাওয়া দিনের পর আমার মনে পড়ে যায় ওষুধের কথা। কোথাও একটা শুনেছি, নিজের দূর্বলতাকে নিজের শক্তি বানাও। আমি বার বার ফিরে আসি চৌকাঠে। আজ দুপুরের পর টিকটিক করে মাথার ওপর শুধু ঘড়ির কাঁটা নাচছে। একটা মৌমাছি হুল ফুটিয়ে দিলে যেমন যন্ত্রণা হয়, ঠিক সেরকম একটা ব্যথা বুকের বাঁ দিকে। মা’কে বললে, এই বলে উঠবে, আরও সব উলটো পালটা জিনিস খাও। 
ঠিক মায়ের কথার উলটো দিকে দাঁড়িয়ে আমি একটা সিগারেট ধরাই। আর হাওয়ায় ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে দিই যত আছে আদিখ্যেতা, ন্যাকামো গুলো। চাঁদের ঢলতি জওয়ানি দেখে একটা হাসি মাথায় ঘুরে ফেরে। 
অপু দূর্গার সেই ট্রেনের হুইশল শুনতে পাই… অথচ কতদিন হয়ে গেল ট্রেন বন্ধ। পাখি উড়ছে, ফড়িং উড়ছে, মাথার কাছে যাবতীয় কথারাও উড়ছে। কিন্তু আমি ঠিক দাঁড়িয়ে আছি। যেভাবে দাঁড়িয়ে থাকার কথা। তার ছিঁড়ে গেলে এরকমই মাথার ওপর পিঁপড়ের দল বাসা বাঁধে। মগজের ভেতর যারা গোলমাল করে বসে। আর ভাবিয়ে তোলে একটা শহরের ভেতর আর একটা শহর কীভাবে দ্বীপ বানিয়ে তুলতে পারে। ভালোবাসলে কি করে হেরে যেতে হয়। 
ভাবনার গাড়ি আবার প্ল্যাটফর্ম ছেড়ে অন্য ট্র্যাকে… কুউউউ… ঝিক…ঝিক। তুমি কি এখন একটা নদী হয়ে গেছো ভালো পাখি… কিংবা একটা অন্ধকার রাতের তারা। জীবনে অনেক কিছুই না পাওয়া থাকে… সেই না পাওয়ার তালিকায় এক এক করে নাম লিখে রেখো পর পর… দেড় খানা জীবন নিয়ে সেদিন যেমন আমিও পাহাড়ি পথে হারিয়ে গিয়েছি। 
এতসব কিছু ভাবতে গিয়ে কখন যেন… সিগারেটের ধোঁয়ায় নীল স্বপ্ন চারপাশ ঢেকে ফেলেছে। আমি চুমু এঁকে দিই সেই তার কপালে… বয়ে যেতে দিই নদীর মতো। এইসব কথার কথা… বলতে হয়। একটা খোলা মাঠে তখন বয়স্ক চাঁদ আর ধূর্ত প্রেমিকার আলাপ ঢলে পড়ছে… আর একবার পাতার ওপর লিখে রাখি… ধোঁয়া জীবনের নাম। 


২৭-এর পর 

থেকে থেকে এই যে স্প্যানিশ গিটারের টিউন মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে, আমার এতে কিছু করার নেই। দিবাস্বপ্নের মতো আজ সকালে বাবার পছন্দের গান বাজিয়েছি। অমনি দেখি, তিনি খবরের কাগজ থেকে মুখ তুলে আমার দিকে কেমন সন্দেহের চোখে তাকিয়ে। ওমা! আমি আবার কি করলাম মুখ করে গুনগুন করতে করতে সেখান থেকে ধাঁ। চিলেকোঠায় গিয়ে আওয়াজ শুনছি… কেউ গাইছে… ‘তেমনই আমার বানী সৌরভে কানাকানি…হয় যদি ভ্রমরাগো সে ব্যাথা বুঝিয়া নাও’। 
উফ আমার যে সে কি আনন্দ, নারকেল গাছে চড়ে বসে থাকতে ইচ্ছে হলো। যদিও একবার ভেবেছিলাম হাওড়া ব্রিজের মাথায় ফ্যাতাড়ুদের মতো উড়ে যাই। আর সেখানে পা দুলিয়ে সিগারেট খাই। সে ইচ্ছের মাথায় জল ঢেলে মা কান ধরে আমার নাম ভুলিয়ে দিয়েছিল। 
সে যাক গে, আর একজনের গানেরও আমি ভীষণ ফ্যান। সে বাবার মতোই গান করে। আর আমার সেই গানের ভেতর হারিয়ে গিয়ে এক অন্য জগত তখন পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সুখ এনে দিত। এখন আর শোনায় না। কোনওদিন আর হয়তো শোনাবেও না। আমার মাথা নেমে আসে দু হাটুর ওপর। কেন যে ভাবি এইসব। 
দিনের আলো থাকতে থাকতে একদিন হারিয়ে যাব। যে হারিয়ে যাওয়ার কথায় সে ভীষণ রেগে যেত। এখন আর রাগ করবে না সে। এখন কোলে মাথা দিয়ে আর বলবে না, শুনছ… একটু মাথায় হাত বুলিয়ে দেবে। 
আমি সিঁড়ি ধরে নেমে আসি। ছায়ার মতো অন্ধকার আমার পিছু নিয়েছে। একটা গুলতি ছুঁড়ে মাথা ফাটিয়ে দিতে ইচ্ছে করে। কিম্বা গায়ের উপর ছেড়ে দিতে ইচ্ছে করে এক বাক্স পিঁপড়ে। কেন? কেন? কেন? আমিই কেন?  
ধপ করে তার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে বলতে ইচ্ছে করে, কি চিনতে পারছ না তাই তো। জানি তোমার টু ডু লিস্ট থেকে বাদ পড়ে গিয়েছি আমি। তবু, কিছুটা আশায় বসে থাকি। হয়ত ফিরে এসে বসবে দু-দন্ড। কথা বলবে আগের মতো। হয়তো পুরনো হয়ে গেছি। কিন্তু তাতে কি যায় আসে। সম্পর্ক যত পুরনো হয়ে যায়, ততই মসৃণ হয় তাই নয় কি। 
তবে, সে কথা থাক। আমার আলমারিতে এখন জমা করে রাখি একটার পর একটা স্বপ্ন। সে সব দিবাস্বপ্ন কোনো একদিন পূরণ করব। হয়ত বাঁ কাল, নাহলে পরশু, নাহলে কোনও একদিন… 

 
২৮ -এর পর 

কিছুটা আদরে আবদারে মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছিল প্রায়। এইসব না বোঝার কথা। যদি তুমি ভালোবাসাকে ডিপ্রেশনের নাম দাও, আর মন খারাপ হলে বলো পাগল হয়ে গেছ। 
আমি বরাবর রোদ্দুরের দিকে পিঠ করে দাঁড়াতে ভালোবাসি। আর যেখানেই যাই একটা না একটা পাগল জুটে যায় ঠিক। আমি তখন তাঁকে গল্প শোনাতে বসে যাই। এক একদিন এক একটা গল্প। কোনো দিন নদীর তো কোনওদিন অচেনা বিদেশী শহরের নিঝুম স্টেশন। 
আর তার উশখোখুশকো চুল, ভাঙা দাঁত, স্বপ্নের চেয়েও দ্রুতগামী চোখ আমাকে আরও বেশি ভাবতে বাধ্য করে। আসলে কেউ একজন আমার মনের শক্তি ছিল, সে বলত একা বাঁচতে শেখো। এইসব এনার্জি লেভেল বোঝার কথা নয় তার। ভালোবাসাই বুঝলো না। 
আমি মাথা চুলকে নিয়ে পাগলের চোখে দিগভ্রান্ত এক নাবিকের খোঁজ পাই। সে বড়ো অস্থির, বড়োই চঞ্চল। তার দাস্তানের গালিচায় আমার হেঁটে যেতে বেশ ভালোই লাগে। পথচলতি মানুষ আড়চোখে আমাকে দ্যাখে, আর খিকখিক করে হেসে চলে যায় পরকীয়া সময়ে। আমি দ্রুত সেই পাগলের গল্পে ফিরে যাই। আমার সময় ফুরিয়ে আসে। রাতের পর রাত জেগে থাকি। তারা গুনি। যা সব অন্যমনস্ক কাজ আমি ছাদে রেখে আসি। চিলেকোঠায় বৃষ্টি নামে। আর আমি ফের পাগলটাকে আমার সামনে বসে থাকতে দেখি, যেন সে আর আমি কত শতাব্দী ধরে মুখোমুখি বসে। সিসিফাসের মতো শুধু পাথর ঠেলে চলেছি। 
দীর্ঘ ছায়া নেমে আসে সিঁড়ি বেয়ে। কত কথা বলার ছিল। কত স্বপ্ন ছিল তার সঙ্গে। সব মেঝেয় ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে। মা আজ কিছু বলেনি সারাদিন। মায়ের গল্পে আজ একটা বোবা কান্না লুকিয়ে পড়েছে। বাবার হাতে দেখি সিন্দবাদের নাবিকের গল্পকথা। 
ওষুধের পাতায় ডাকনাম লিখে রাখি আর একবার। আমার ডাকনামগুলো মুছে গেছে কতযুগ হলো। ঠিক নার্সিসাসের মতো নিজ চরিত্রে। 

© বৈশাখী নার্গিস

পোস্টার : শাশ্বত বন্দ্যোপাধ্যায়

Comments

Popular posts from this blog

অনিন্দ্য সরকারের গুচ্ছ কবিতা : গান ছুঁয়ে ছুঁয়ে

অয়ন হালদারের পাঁচটি কবিতা

মুন্নী সেনের গুচ্ছ কবিতা : সম্বোধন