ভালো থেকো নিশীথ অবশেষ : পর্ব ১৪ — জয়দীপ চট্টোপাধ্যায়
ভালো থেকো নিশীথ অবশেষ : পর্ব ১৪
জমিদার বাড়ির এই অংশটি একটু অন্যরকম, অন্য দিকের অংশের থেকে চার-পাঁচ ধাপ সিঁড়ি বেয়ে নীচে নেমে আসতে হয়। একসময়ে নাকি গুমঘর ছিল। অথচ এখন রেনোভেট করে অন্যরকম করে দিয়েছে। দিনের বেলা এলেও একটা রহস্যের গন্ধ পাওয়া যায়, ঘরের দেওয়ালগুলো কেমন ঠান্ডা। এরা ইচ্ছে করেই অল্প পাওয়ারের আলো রেখেছে ঘরের এক একটি দেওয়ালে। ঘরটা এখন বদলে গিয়ে রিক্রিয়েশন রুমের মত করা হয়েছে। একদিকে ছোটো ফ্রিজে ঠান্ডা পাণীয় আর নানা রকম বিয়ার, তালা বন্ধ থাকে। সার্ভিসে থাকা স্টাফদের বললে অর্ডার মত আনিয়ে দেয়। আর একদিকে বসে থাকার মত কাউচ, বেতের চেয়ার, ছোটো টেবিল। বইয়ের তাকে পাতলা পাতলা কিছু বই। দুটো কাঠের দাবা খেলার টেবিল-বোর্ড, যেখানে চা-কফির কাপও রাখা যায়। কার্ড গেম খেলারও ব্যবস্থা আছে। অল্পসংখ্যক কিছু জনের এক বিচ্ছিন্ন রিক্রিয়েশন রুমের মত, কিংবা coquette's lounge। কিন্তু নো-স্মোকিং জোন। এসির মাধ্যমে ঘরের তপ্ত বাতাস বাইরে বার করে দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে। আসলে ঘরটায় ঢোকার একটাই দরজা, কোনো জানলা নেই। অন্য কোনো দরজাও নেই। ঘরের ছাদটাও তুলনায় একটু খাটো।
অতিথিদের কেউ রাতে এদিকে আসে না, আসার নিয়মও নেই। কিন্তু ঘরের দরজাটা খোলা দেখেই ধাপে ধাপে সিঁড়ি দিয়ে নেমে এলো প্রাজক্তা। ঘরের ভেতর ঢুকে একবার তাকাল পেছন ফিরে মৈনাকের দিকে, 'আসবে?' মৈনাক চারিদিকে তাকিয়ে দেখল, কেউই নেই। কোনো স্টাফকেই দেখা যাচ্ছে না চারপাশে এখন। শুধু করিডোরের আলোগুলো জ্বলছে কয়েকটা। স্বাভাবিক ভাবেই, বিদ্যুৎ সাশ্রয় করতে এত রাতে বিশেষ কিছু দিকেই আলো জ্বলে করিডোরে। আর এইদিকে অতিথিদের আশার কথা নয় বলে, এদের কর্মচারীরাও কেউ থাকে না। হয়ত রাউন্ডে থাকা কোনো সিকিওরিটি আছে। শুনেছিল কুকুর নিয়ে পাহারা দেওয়া হয় রাতে, যদিও এখনো অবধি কোনো কুকুরের ডাক পর্যন্ত শুনতে পায়নি।
ঘরে ঢুকেই বুঝতে পারল, এসিটা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। স্বাভাবিক, সার্ভিস বন্ধ হয়ে গেলে এসিই বা চলবে কেন? কিন্তু এই অঞ্চলে ঠান্ডা পড়ে গেছে বলেই তেমন অসুবিধে হচ্ছে না, দেওয়ালগুলো তো এমনিই কেমন ঠান্ডা ঘরটার। জমিদারবাড়ির এক কোণে থাকা অদ্ভুৎ একটা ঘর, লোকে বলে গুমঘর। সত্যি-মিথ্যে যা-ই হোক, 'গুমঘর' শব্দটা শুনলে কেমন গা ছমছমই করে। রাতে এরকম দরজা খোলাই বা রাখে কেন? কর্মীরা কেউ সুযোগ বুঝে এদিকে এসে রাতের দিকে? গোপনীয় ব্যক্তিগত মুহূর্তের সুযোগ-সুবিধে? নিশ্চয়ই এখানেও সিসি-টিভি থাকবে কোথাও না কোথাও! কথাটা মনে আসতেই, মৈনাক মাথা তুলে চারদিকের দেওয়ালের কোণগুলো দেখার চেষ্টা করল-- কোনো সিসি টিভির ক্যামেরা চোখে পড়ে যদি। আপাতভাবে তেমন কিছু দেখতে পেল না। 'আশ্চর্য! এরকম একটা কোণের দিকের ঘরে সিসি-টিভি রাখেনি?... তার মানে সত্যিই কেউ না কেউ আসে, দরজা বন্ধ হয় না তাই!', কথাগুলো মনে আসতেই বিশেষ কিছু মনে করে হেসে ফেলল মৈনাক। প্রাজক্তা এত রাতে আর জায়গা পেল না টেনে নিয়ে আসার!
প্রাজক্তা একটা দাবা-বোর্ডের পাশে বেতের কেদারায় বসে আছে, স্ট্রলটা ভালো করে টেনে নিয়ে। চোখের ইশারায় ডাকছে, কাছাকাছি কোথাও বসতে। মৈনাক এগিয়ে গেল, দাবার বোর্ডের উলটো দিকের বেতের কেদারায় বসল চারপাশটা দেখতে দেখতে। শুধু দুটো অল্প পাওয়ারের আলো জ্বলছে বলে ঘরটা আরোই আলোকশূন্য গা ছমছমে লাগছে। অদ্ভুৎ লাগছে প্রাজক্তাকে এই অল্প আলোয়, কী অকল্পনীয় রহস্যময় লাগছে ওর কাঁধের ওপর ছড়িয়ে থাকা বাদামী কোঁকড়ানো চুলগুলো। ওর এই অপলক দৃষ্টিতে শান্তভাবে তাকিয়ে থাকা, হাতদুটোর ওপর চিবুক ভর দিয়ে বসে।
- কুছ জগাহ অপনে সাথই আপনি মনহুসি লেকর গুমসুম রহে যাতে হ্যায়...
- এই ঘরটার কথা বলছ?
- নাহ্।
- এই ঘরটা নাকি...
- ডর লগ রহা হ্যায় আপ কো?
- না... সিকিওরিটি রাউন্ডে এলে ভাগিয়ে দেবে। দুজনকে এভাবে দেখলে...
- বোহ ভি ডর হি তো হ্যায়। নেহি?
কিছুক্ষণ চুপ করেই বসে রইল মৈনাক, কী বলবে বুঝতে পারছিল না। প্রাজক্তার থেকে চোখ সরিয়ে অন্য দিকে তাকিয়ে পালাতেও পারছিল না। বুঝতে পারছিল না, কেনই বা ওকে... ওকেই কেন একা ডেকে নিয়ে এলো এমন একটা নির্জন কোণে। শুধুই কিছু 'অন্য কথা' গোপনে জানাতে?
'আপকো কেয়া লগ রহা হ্যায়... রেপ অ্যাটেম্পট?'
কথাটা শুনে একটু চমকে গেল মৈনাক। প্রাজক্তা সরাসরি ওর দিকে তাকিয়ে আছে, একটা হ্যাঁ অথবা না শোনার জন্য সরু হয়ে গেছে ওর চোখ। উত্তর যা-ই হোক, একটা আঘাত করার মত মন্তব্যই ছুঁড়ে মারবে প্রত্যুত্তরে, তারই প্রস্তুতি নিচ্ছে মনে মনে। পরিকল্পিত। ফালা ফালা করে দেবে বলেই ডেকে এনেছে এভাবে নিভৃতে। একদা যেখানে প্রজাদের শোষণ-নিগ্রহ করত জমিদারের কোতয়াল বা লেঠেলরা, সেখানে এখন প্রাজক্তার চাবুক সহ্য করবে মৈনাক। হয়ত অস্বাভাবিক রকম সময় নিয়ে অথবা দৃষ্টি নিয়ে চুপ করে তাকিয়ে ছিল মৈনাক। তুরি দিয়ে ঘোর কাটিয়ে প্রাজক্তা আবার জিজ্ঞেস করল-- 'বলিয়ে মিস্টার... বুর্বক তো কই নেহি হ্যায় ইঁয়াহা... হোয়াট ডু ইয়ু থিংক আবাউট ইট?'
- জানি না। মানে...
- জানি না? আর ইয়ু... আর ইয়ু রিয়াল?
- না, মানে... আমি যখন দেখলাম... শি ওয়াজ প্রপার্লি ড্রেসড। কোনো স্ট্রাগল...
- আচ্ছা। মানে অ্যাপারেন্টলি-- ইয়ু ফিল -- নট আ রেপ। জানি না কিঁয়ু বল র্যাহে হো?
-
- তো ঘর মে তো খলি দোনো হি থে... রাইট?
- হুম। যখন প্রথম গেছিল... অনশু। অ্যান্ড অল আফটার দ্যাট...
- সব অ্যাজিউম কর লিয়া?
- মতলব?
- মতলব অ্যাজিউম হি কর লিয়া না... ওনলি টু অফ দেম ওয়্যার দেয়ার। হ্যায় না?
- হু এলস কুড গো দেয়ার?
- হোয়াই উড প্রত্যূষ ফোর্স হার... অ্যান্ড হার্ট হার উইথ আ ব্লান্ট ফোর্স?
- এত রকম নেশা করলে কারো মাথার ঠিক থাকে?
- পয়েন্ট। বাট জাস্ট প্লেইং ডেভিলস অ্যাডভোকেট... দে আর কোয়াইট ইন্টিমেট, আই ডোন্ট থিংক দেয়ার ইজ এনিথিং লেফট টু হ্যাপেন বিটুইন দেম... ইউ নো হোয়াট আই মীন।
- সো?
- সো... ডু ইয়ু রিয়েলি ফিল,প্রত্যূষ ইজ রিয়ালি আ ডাফার টু ডু সামথিং... দ্যাট উড রুইন এভরিথিং ফর হিম? আজ হি নশা করনা শুরু কিয়া কেয়া বো?
- আই ক্যান ফিল ইয়ু আর ট্রাইং টু পুট অ্যান অলটারনেট থিওরি হিয়ার... বাট...
- জী হাঁ মাই লর্ড... বাট... আই ডোন্ট নো হোয়াই, পর মুঝে লগ রহা হ্যায়, কুছ তো হুয়া হোগা উস ঘর মেঁ...
- লাইক?
- লাইক... আ থার্ড পারসন ট্রাইং টু টেক হার অ্যাডভান্টেজ... অ্যান্ড প্রত্যূষ ফাইন্ডস হার দ্যাট ওয়ে হোয়েন হি কেম? হতে পারে না?
- তাহলে ও বলছে না কেন সেটা!
- বোহি তো সারজী! হি ইজ নট ক্লিয়ারলি টেলিং এনিথিং। নশে মেঁ তো হ্যায়... বাট মুঝে লগা কুছ শক ভি লগা হ্যায় উসকো... দ্যাট ইজ ইভন মোর উইয়ার্ড অ্যান্ড ইনট্রিগিং... নেহি?
-
- উস রুমকে পাস কোই সিসিটিভি ক্যামেরা ভি নেহি হ্যায়... হ্যাভ ইয়ু নোটিস্ড দ্যাট?
- হুম।
- মতলব... উই কান্ট রিয়েলি ট্রেস... হু এলস হ্যাড গন দ্যাট সাইড। নিয়ার দ্যাট রুম... ইনসাইড দ্যাট রুম!
- পয়েন্ট।
- বাট... উই ক্যান ট্রেস... হু অল ওয়্যার মিসিং অ্যাট দ্যাট টাইম... রাইট?
- মিসিং... মিসিং কেমন?
- আরে বুদ্ধিমান প্রাণী... উই অল আর ইন গ্রুপ্স... থ্রু আউট দ্য ডে। কোই কিসিকে সাথ হোনা হি ইউজুয়াল হ্যায়, ন্যাচারাল হ্যায়। কোই এক অকেলা থাক কেয়া... যো নেহি দিখ রহা থা?
- অপ্রতিম দা।
- ব্রো! সিরিয়াসলি!
- হি ওয়েন্ট সামহোয়্যার। অ্যালোন। উসি কি নাম পহলে ইয়াদ আয়া। অ্যান্ড ইট ইজ আ ভ্যালিড ওয়ান।
- কেয়া ভ্যালিড! রাতকে উস টাইম... হি ওয়াজ নট ইভন ইন দ্য রেসর্ট ব্রো... অপনে দুনিয়া মেঁ থে কহি... কিসি অওর কে সঙ্গ। শি ইজ হার অ্যালিবাই... এনিওয়ে দেয়ার পার্সোনাল স্পেস।
- আচ্ছা... তখন দুজন একসঙ্গেই এসেছে না... খেয়াল ছিল না।
- আপকা দাদা ইজ আউট। আপ বতাও... হু এলস ওয়াজ নট সিন অ্যারাউন্ড বাই আ গ্রুপ।
- অ্যায়সে তো কোই ভি হো সকতা হ্যায়... কুড ইভন বি সামওয়ান হু ইজ নট ফ্রম আওয়ার গ্রুপ। রেসর্টের কেউ, অন্য গেস্টদের কেউ।
- কুড বি... পর, মেঁ বি... দে নিউ হিম।
- হিম কেন? হারও তো হতে পারে।
- আর ইউ লিসনিং টু ইয়োরসেলফ? শি ইজ ফিজিকালি আসলটেড, ব্লান্ট ফোর্স...
- ওভাবে বলা যায় না, মেয়েদেরও গায়ে জোর থাকে।
- ওকে... আই উইল কিপ দ্যাট ওপেন... হিম অর হার। সামওয়ান।
- ইনসাইডার... অর আউটসাইডার।
- কোই ভি হো... উসনে কুছ গজব হি কিয়া হোগা অন্দর। সামথিং আনইউজুয়াল, আনএক্সপেক্টেড, উইয়ার্ড... ক্রিপি! সমঝ রহে হো না?
- ক্রিপি? তোমার তাই মনে হচ্ছে?
- দেন হোয়াই ডিড প্রত্যূষ গেট শকড, উসকো নার্ভাস ব্রেকডাউন কিঁয়ু হুয়া?
- বিকজ হি রিয়েলাইজড, হি হ্যাজ ডান সামথিং অফুল... যেটা ও করতে চায়নি। ফেক ভি কর সকতা হ্যায়। কান্ট টেল।
- কুড বি... পর... আই ডোন্ট নো ম্যান... আমার একদম লিনিয়ার লাগছে না ইনসিডেন্টটা। অর দ্য অর্ডার অফ ইন্সিডেন্টস... হোয়াটেভার উই ব্রেনস্টর্মড হিয়ার, জাস্ট পুট দ্য পিসেস সাইড বাই সাইড। দে ডু ইন্ডিকেট সামথিং আনইয়ুজুয়াল। বস করেক্ট সিকোয়েন্স মেঁ অ্যারেঞ্জ কর না হ্যায়।
- আচ্ছা, এই ব্যাপারগুলো পুলিশ এনকোয়ারি হলে... তখন তাদের জানালেই হয় না? আমরা এখানে বসে কিছু সল্ভ করতে পারব?
-
- টেল মি, সোচ কে বতাও, বি র্যাশনাল... হমারা পজিশন কেয়া হ্যায়। অথোরিটি কেয়া হ্যায়?
- সোচ তো আপনা আপনা হোতে হ্যায় সহাব।
- দেন?
- দেন হোয়াট... পুলিস কেস হুয়া তো দো বাতে হোঙ্গে। এক-- পুলিস উড বিহেভ অ্যাজ ইউজুয়াল, এক তরফা বাতে সুনকে প্রত্যূষকো হি সাসপেক্ট বনা দেগা। দুসরা-- দে উড অ্যাক্ট ইভেন মোর পুলিস-লাইক। সব কো ইন্টেরোগেট করকে ফ্রাস্ট্রেশন কা হদ বনায়গা মাহোল কো। অ্যান্ড ইন আ ওয়ে, প্রত্যূষকো অকেলা নেহি বখরা বনায়গা, দেয়ার ডেফিনিটলি উড বি ফিউ মোর ইন দেয়ার নেট।
- এভাবে বসে বসে অনেক থিওরি বানানো যায়। ইফ শি ইজ মলেস্টেড... স্যাম্পেলস-এর মেডিকাল টেস্ট করলেই...
'ওয়াহ দাদাজী ওয়াহ!' মৈনাককে কথা শেষ করতে না দিয়েই হাততালি দিয়ে উঠল প্রাজক্তা, গলাটাও একটু জোরে হয়ে গেছিল হঠাৎ... অসাবধানে। বাইরে থেকে একটা লাঠির শব্দ ঠকঠক করে শোনা গেল। মনে হল এগিয়ে আসছে। প্রাজক্তা চেয়ার থেকে উঠে এসে মৈনাকের কানের কাছে ঠোঁট নিয়ে গিয়ে ফিসফিস করে বলল-- ইফ আ গার্ল স্লিপ্স উইথ টু গাইজ, অ্যান্ড গেটস বিটেন বাই দ্য থার্ড... কিসকি স্যাম্পল সে কিসকো পকড়োগে জনাব?'
কথাটা বলেই ঘর থেকে ছুটে বেরিয়ে গেল নিমেষে। এতই দ্রুত সরে গেল করিডোর আলো-ছায়ায় যে মৈনাক বুঝতে পারল না কোনদিকে ঠিক গেল মেয়েটা।
মৈনাকের হঠাৎ একবার মনে হল, কিছু না ভেবেই এভাবে প্রাজক্তার ডাকে ওকে অনুসরণ করতে করতে এখানে এসে পড়া কি ঠিক হল? রাগিনীর সঙ্গে একটা ঘটনা ঘটে গেছে, প্রত্যূষের নাম যেভাবে জড়িয়েছে। মৈনাক নিজেও যদি কোনোভাবে ফেঁসে যায়?... 'না না, প্রাজক্তা এমন কিছু করবে না। অতই সোজা?... সোজাই তো, একটা মেয়ে অভিযোগ করে যদি কিছু বলে, তার কথাই সবার আগে গুরুত্ব পাবে। ভিক্টিম নিজেই সব থেকে বড়ো সাক্ষী এইসব কেসে!'
'এখানে কী করছেন?!'
মৈনাক ঘর থেকে বেরনোর আগেই মুখের সামনে এসে দাঁড়াল লোকটা। এখন আর পালানোরও কোনো মানা হয় না। লোকটার কাঁধ টপকে ওর নজর তখনও অন্ধকারে হাতড়ে যাচ্ছে প্রাজক্তা, অথবা তার ছায়াকে। লোকটা আবারো জিজ্ঞেস করছ-- এখন এখানে কী করছেন? কেন এসেছেন?... বেরিয়ে আসুন!'
মৈনাকের কোনো উপযুক্ত অজুহাত বা মিথ্যে আসছিল না মনে। মনে করতে পারল না, এই লোকটাকে আগে সারাদিন একবারও দেখেছে কি না। সিকিউরিটি গার্ডের ইউনিফর্ম পরা, সম্ভবতঃ নাইট শিফটে এসেছে। সীমিত শব্দেই উদ্বেগ মিশিয়ে বলল লোকটাকে, 'আমাদের দুজন কলীগ নীচে এসেছিল, দেখতে পাচ্ছি না। ওদেরই খুঁজতে খুঁজতে...
-মানে? রুম নম্বর কত? কোন দিকে আছেন আপনারা?
- এই যে, ডানদিকের দোতলার ঘরগুলো...
- ওহ... অফিস থেকে। একটা মেয়েকে তো গাড়ি করে নিয়ে গেল ঘণ্টা খানেক আগে...
- হুম, ওই গ্রুপেরই।
- মানে ওই দুজন গাড়িতে যায়নি?
- না।
- পরে বাইকে গেল?
- না।
- তাহলে?... এই আগে আপনি বাইরে আসুন ঘর থেকে... এখানে রাতে আসাই অ্যালাওড না... আগে বেরিয়ে আসুন এদিকে!
লোকটা ঘরের দরজাটা টেনে বন্ধ করে দিল। সেকেলে মোটা হুড়কো, কিন্তু তালা নেই। মৈনাক ততক্ষণে সিঁড়ি দিয়ে উঠে এসেছে করিডোরের দিকে, এদিকে আলো তুলনায় বেশি। অথবা, স্বল্প আলোকিত কোণ থেকে বেরিয়ে এলে এমনই লাগে। প্রাজক্তাকে সত্যিই দেখা গেল না কোথাও। এত দ্রুত, কোন পথে চলে গেল সিকিউরিটি গার্ডের চোখ ফাঁকি দিয়ে? কোনো আসবাব বা থামের আড়ালে গা ঢাকা দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে? কোনো একটা আড়াল থেকে দেখছে মৈনাককে এভাবে অপদস্থ হতে একা একা! অবশ্য ভালোই হয়েছে, মৈনাককে প্রাজক্তার সঙ্গে দেখলে আলাদাই গল্প হয়ে যেত ব্যাপারটা।
'কী হল, বললেন না যে... কাদের খুঁজতে এসেছিলেন?'
সিকিউরিটি গার্ড লোকটা অনেকটা জেরার সুরেই জিজ্ঞেস করল মৈনাক। যেন কিছু একটা অসৎ উদ্দেশ্যে ঘুরঘুর করছিল মৈনাক... ধরা পড়ে গেছে। বিশ্বাসযোগ্য উত্তর না পেলে, এখনই অন্য লোকজনদের হাঁক দেওয়া হবে। যে দিকে কেউ আসে না,এরকম অসময়ে সেখানে কাউকে দেখতে পেলে এমন মনে হওয়াই স্বাভাবিক। তা ছাড়া একেবারেই কেউ আসে না এমন না... তাই পর্যটক অতিথিদের এদিকে আসা আরো বেশি করে অবাঞ্ছিত, বিরক্তির। একটা ভয় বা মানসিক চাপ না রাখলে তাদের এই দিক থেকে দূরে রাখা যাবে না রাতের দিকে।
মৈনাক ইচ্ছে করেই পালটা চাপ দেওয়ার জন্য বলল, 'এদিকটা কোনো সিসিটিভি নেই, না?'
হঠাৎ সিসিটিভির কথা জিজ্ঞেস করতেই লোকটা একটু চমকে উঠল, থতমত খাওয়া স্বরে বলল, 'সিসিটিভি... কেন? আছে তো... এত বড়ো বাড়ি, এখানে ওখানে অনেক ক্যামেরা। সব নজর রাখা হয়।'
- এদিকটা দেখতে পাচ্ছি না তো?
- আছে আছে... সব চোখের সামনে থাকে না। আমরা সব নজর রাখি...
- তাই? তাহলে একটু দেখুন না... দুজন গেল কোথায়?
- আমি কোথা থেকে দেখব?
- কেন? আপনাদের মনিটর থেকে, কোথাও তো স্ক্রিনে সব দেখা যাওয়ার কথা... চলুন না একবার।
- রেসর্টের ভেতরেই আছে কোথাও, ফোন করুন না। কটা বাজে জানেন? ভোর চারটে বাজতে যায়। যান না, ঘরে গিয়ে ঘুমোন না। যারা গেছে, এসেও গেছে যে যার ঘরে!
- ফোন তুলছে না। নট রিচেবল আসছে... শুনুন না... ও দাদা...
লোকটা আর পেছন ফিরে না তাকিয়ে গটগট করে সোজা হেঁটে চলে গেল অন্যদিকে। পালিয়ে গেল। অদৃশ্য হয়ে গেল। ওর প্রাথমিক দায়িত্ব ছিল ওই গুমঘর থেকে খেলাঘর হয়ে ওঠা অন্ধকার কোণটা থেকে একজন অপরিচিত বহিরাগতকে বার করে দেওয়া। তারপর কে কোথায় গেল-এলো... ওর ভাবার নেই।
মৈনাকের একবার মনে হল, নিজেই একবার সিকিউরিটি রুমে গিয়ে জিজ্ঞেস করে, সতীশ আর নীলেশকে দেখেছে কি না। ফুটেজ দেখতে চাওয়া সত্যিই বাড়াবাড়ি, কিন্তু একটা ফর্মালি জিজ্ঞেস করা। ছেলেদুটো অন্য রাজ্যের, বাংলা বোঝে না... হিন্দিতেও স্বচ্ছন্দ না। বিপদ আন্দাজ করে রেসর্ট থেকে নিজেদের মত পালিয়ে যাওয়ার রিস্ক কেন নেবে? ওরা যদি কিছু দেখেও ফেলে থাকে... এখন এখান থেকে পালিয়ে কী লাভ? মৈনাকের হঠাৎই মনে পড়ে গেল, প্রাজক্তার কথাগুলো... চোখ বন্ধ করে মনে করার চেষ্টা করল-- এই দুজন সেই সময়ে কোথায় ছিল, কখন শেষ দেখা গেছিল দুজনকে, কখন আবার দেখা গেল ঘটনা ঘটে যাওয়ার পর।
একটা খিলখিল করে হাসির শব্দ হঠাৎই ভেসে এলো দোতলায় ওঠা সিঁড়ির দিক থেকে। প্রাজক্তা। 'নো ব্রো, ইয়ে দোনো ইতনে ভি উল্লু নহি লগতে কে ইঁয়াহা সে ভাগ কর খুদকো হি সাসপেক্ট বনা দে। দে জাস্ট ওয়ানা অ্যাভয়েড প্রত্যূষ অ্যান্ড অল টিল মর্নিং। আপস মেঁ কুছ প্ল্যান করকে অলগ হো গয়ে।'
মৈনাক, নিশ্চিৎ হল... কিছুটা নিচিন্তও। এতক্ষণ সত্যিই তাহলে আড়াল থেকে ওদের দেখছিল প্রাজক্তা। উপভোগ করছিল মৈনাকের পরিস্থিতি। হঠাৎ জন্মানো রাগটা বুঝতে না দিয়ে বলল, 'ইয়ু ওয়্যার হিয়ার অল দ্য টাইম।'
- ইয়েস... অ্যান্ড থ্যাংক্স ফর কিপিং হিম ডিস্ট্র্যাক্টেড। দোনো কো একসাথ দেখতা তো মসলা হো যাতা...
- ও কী বলল শুনলে তো... যে যার ঘরে চলে যাবে। তাই নিজেও এবার ঘরে যাও। আলো ফুটে যাবে এবার আকাশে।
- সচ বতাউঁ? আই ডোন্ট ফিল লাইক গোইং ব্যাক টু দ্যাট রুম উইথ গার্লস।
-
- বাট ডোন্ট ওরি... আই ওন্ট হন্ট ইয়ু ইদার। আই অ্যাম গোইং ব্যাক... সামহোয়্যার... বিতা লেঙ্গে চন্দ বঁচে পল ইয়ুঁহি... ইয়ুঁহি কহি...
প্রাজক্তা স্ট্রলটা ভালো করে টেনে নিয়ে সিঁড়ি দিয়ে উঠে চলে যাচ্ছিল। আবারো দূরত্ব বেড়ে গেলে মৈনাকের সঙ্গে। ক্রমবর্ধমান দূরত্বের হ্রাস এবং বৃদ্ধির এক পর্যায়ক্রম। সম্পর্কের আপেক্ষিক অধ্রুব, সরল দোল গতির সমীকরণে ঢুকে পড়ে যেভাবে। মৈনাকের মনে হল, এখন সিঁড়ি দিয়ে উঠে গেলেও পিছু নেওয়া হয়। আর কিছু বললেও পিছু ডাকা হয়। এভাবে ফিরে চলে যাওয়া, মাঝে মাঝে যে কত কিছু মনে করিয়ে দেয়! হঠাৎই মনে করিয়ে দেয়, অপ্রাসঙ্গিক ভাবেই। চেনা দৃশ্য, চেনা স্বাদ, চেনা ঘ্রাণের মত। কিছুটা আরোপিত নিঃস্পৃহতা নিয়েই বলল... 'ইটস বেটার, ইয়ু গো ব্যাক টু দ্য রুম। দেয়ার ইজ নো হার্ম ইন স্টেইং সেফ। অ্যাভয়েডিং ফার্দার ট্রাবল'। সিঁড়ির একটা ধাপে থমকে দাঁড়াল প্রাজক্তা, অদ্ভুত এক হাসি নিয়ে পেছন ফিরে তাকিয়ে ফিসফিস করে থেমে থেমে বলল কথাগুলো। ওর চোখের দিগদর্শন করানো ইশারা আর লিপ-রিড করে দূর থেকেও স্পষ্ট বুঝতে পারল মৈনাক কথাগুলো-- 'ম্যায় তো সোচ রহি থি... ফির সে একবার উস রুম মেঁ চলুঁ। অকেলি!'
(চলবে)
© জয়দীপ চট্টোপাধ্যায়
পোস্টার : ত্রিবিন্দু
Comments
Post a Comment