ভালো থেকো নিশীথ অবশেষ — পর্ব ১৩ : জয়দীপ চট্টোপাধ্যায়
'আরে দেখ কে!... কেয়ারফুল ইয়ার!'
গ্লাসটা পড়ে ভেঙে যেতে, আর কাচগুলো সশব্দে টুকরো টুকরো হয়ে ছড়িয়ে যেতে যতটা সময় নিল, তারই মাঝে প্রতিক্রিয়াবসতঃ চেঁচিয়ে উঠে পড়ল প্রাজক্তা। আড়ষ্ট হয়ে একজায়গায় দাঁড়িয়ে তখন অন্তরা, ওর হাতে জলের জাগটা কাঁপছে। পায়ের কাছে ছিটকে এসেছে ভাঙা কাচের টুকরো। 'ওখানেই দাঁড়িয়ে থাক, নড়লেই পায়ে কাচ ফুটে যাবে!', কথাগুলো বলতে বলতে খাট থেকে নেমে এগিয়ে এসে ওর হাত থেকে জলের জাগটা নিয়ে নিল ব্রততী। তারপর অন্তরার একটা হাত ধরে আসতে আসতে দু-পা পেছন দিকে নিয়ে এলো, খাটের দিকে। ভালো করে তাকিয়ে দেখল ঘরের কোথাও কাচ পড়ে আছে কি না।
'যা তুই খাটে গিয়ে বস, কিচ্ছু হয়নি। এত চাপ নেওয়ার মত কিচ্ছু হয়নি।' বলে ওকে একরকম হাত ধরে টেনে খাটের দিকে সরিয়ে নিয়ে এল ব্রততী, তারপর নিজে সাবধানে মেঝেতে বসে দেখার চেষ্টা করল পড়ে থাকা কাচের টুকরোগুলো। যতগুলো বড়ো কাচের টুকরো চোখে পড়ে চটপট তুলে নিল সাবধানে।
'দেখ কে, তু র্যাহে নে দে... লেট মি কল আ ফেসিলিটি হেল্প।' বলে প্রাজক্তাও উঠে পড়ল। ব্রততী হাতের ইশারায় ওকে বসতে বলে এদিক ওদিক থেকে আরো কিছু কাচের টুকরো তুলে নিয়ে গ্লাসের সব থেকে বড়ো ভাঙা খণ্ড অংশটির ভেতরে রাখল। তারপর সাবধানে পা ফেলে পিছিয়ে এলো খাটের দিকে।
'কেয়া কর রহি হ্যায় ইয়ার? লেট দেম ক্লিন ইট নো? কেটে ব্লিডিং হলে আবার একটা... ' বলতে বলতে প্রাজক্তা খাটের অন্য দিক দিয়ে ঘুরে গিয়ে দরজাটা খুলে বাইরে মুখ বাড়াল। দেখার চেষ্টা করল ডাক দিয়ে, এদিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করার অত কাছাকাছি কেউ আছে কি না। অন্তরা তখনো মেঝের দিকে তাকিয়ে আছে, যেন ভেঙে যাওয়া কোনো কাচের টুকরো আততায়ীর মত লুকিয়ে আছে কি না দেখার চেষ্টা করছে।
'আরে, কী হল কী তোর? এরকম টেন্সড হয়ে গেলি কেন হঠাৎ?', স্মিতা ওর পিঠে হাতটা রাখতেই চমকে উঠল অন্তরা। ঘরের খোলা দরজাটা দিয়ে যতটা বাইরের দেখা যায়, সেদিকে তাকিয়ে যেন কিছু চোখে পড়ছে কি না লক্ষ করতে করতে বলল, 'আমাদের এখানে একা ফেলে, সব এক এক করে চলে যাচ্ছে... না?'
স্মিতা আর ব্রততী একে অপরের দিকে তাকাল কথাটা শুনে। এর উত্তরে ঠিক কী বলা উচিৎ বুঝতে পারল না।
আসলে, সত্যিই ওরা জানে না,এই মুহূর্তে প্রত্যূষের সঙ্গে অন্য ঘরে কে আছে। রেসর্টে থাকা অন্যরা এখন কে কোথায় আছে, কী করছে। প্রত্যূষ নিজেই বা কী করছে এখন?
প্রাজক্তা দরজার বাইরে দুদিকে কিছু দূর এগিয়ে কাউকে দেখতে পেল না, ফিরে এসে বলল, 'লেট মি কল সামওয়ান টু ক্লিন দিস মেস। ব্রোকেন গ্লাস ইস টেরিবল থিং টু স্টে উইথ! দে আর চার্জিং আস লাইক হেল... অওর সার্ভিস কে নাম পে...' উত্তেজিত হয়ে কথাগুলো বলতে বলতেই চলে গেল প্রাজক্তা, কোনো এক পরিচারিকার খোঁজে। নাইট শিফটে থাকা ম্যানেজার বলেছিল ম্যাডমরা ডাক দিলেই সে চলে আসবে। যাওয়ার আগে আলগা ভাবে টানলেও দরাম করে একটা শব্দ করে বন্ধ হয়ে গেল ভারী পাল্লার কপাট। এই শেষ রাতের নিস্তব্ধতায় করিডোরে প্রতিধ্বনি হয়ে ফিরে এলো, এত বড়ো বাড়ির অন্দরমহলের দেওয়ালে দেওয়ালে।
অন্তরা সেইদিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করে শুধু বলল, ' একা ফেলে চলে যাচ্ছে, সব এক এক করে চলে যাচ্ছে!' স্মিতা আবার ব্রততীর দিকে একবার তাকাল। ওরা দুজনেই দেখল, যেখানে প্রাজক্তা এতক্ষণ বসে ছিল, রানিমার খাটের সেই অংশের দিকে। তাড়াহুড়োর মাথায় প্রাজক্তা নিজের ফোনটাও বিছানায় ফেলে গেছে। ম্যাসেজ আসার শব্দ এলো... অথচ লক করা ফোনটা। বোঝা গেল না,এত রাতে কে-ই বা ম্যাসেজ পাঠাচ্ছে। প্রাজক্তরার পরিচিত কেউ? নার্সিং হোম থেকে অনশু বা টায়রা? নাকি অন্য দিকের ঘরটা থেকেই...
- 'কেয়া বোলকে গয়া ইয়ে লোগ?'
- হু? নীলেশ?
- হাঁ?
- আই ডোন্ট নো... লগা সুট্টে কে লিয়ে নিকলে দোনো।
- ইয়ে নো স্মোকিং জোন হ্যায় কেয়া? বাহার ব্যালকনি মেঁ স্মোক নেহি কর সকতে?
- হাউ শুড আই নো ব্রো? উনকি মরজি!
খুব কাঠকাঠ ভাবেই মৈনাকের কথাগুলোর উত্তর দিল কবীর। স্পষ্টই বুঝিয়ে দিল, এই প্রশ্নগুলোর উত্তর দিতে ও বাধ্য নয়। মৈনাকের একবার মনে হলেও এদের এই ঘরে রেখে ও নিজেও বেরিয়ে যায়। ফালতু সময় নষ্ট করছে এই ঘরে। প্রত্যূষ কী করেছে না করেছে... তাতে ওর কী? যদি কিছু ঘটিয়েও থাকে, পুলিশ আর অন্য কলীগরা বুঝবে, কোম্পানি বুঝবে। এই দুটো ছেলের হঠাৎ করে হাওয়া হয়ে যাওয়াটাও খুব অস্বস্তিকর। ওদের খুঁজতে যাবে না এখানে বসে থাকবে বুঝতে পারল না। কিছুক্ষণ চুপ করে মোবাইল ফোনের দিকে তাকিয়ে থেকে অভীককে একটা টেক্সট করল -- 'পৌঁছে গেছিস? ওখান কার কী হাল?' আরো কিছুক্ষণ অপেক্ষা করল, উত্তর এলো না। তখন ফোঁস করে একটা নিঃশ্বাস ফেলে উঠে পড়ে কবীরকে বলল, 'ইয়ে তো নশে মে ধুন্ত্ হ্যায়। উড ইউ বি এবল টু কিপ অ্যান আই অন হিম,?' কবীর খুব শান্ত দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ, মনে হল যে উত্তরটা মনে আসছে... সেটা না বলে অন্য কী বলা যায়, সেটা ভাবছে। তারপর বলল, 'প্লিজ ক্যারি অন... অভি তক তো অকেলে হি দেখ রহা তা। ক্যান ম্যানেজ। ' কথাগুলো শুনেও মৈনাক আর একবার বলল, 'নেহি... আই উড বি ব্যাক ইন ফিউ মিনিটস... জাস্ট দেখনা হ্যায় ইয়ে দোনো...'
কথার মাঝেই কবীর আবার বলে উঠল, 'নো ইস্যুজ... মুঝে ইস সে না খতরা হ্যায়, না ডর। হি ইজ অলসো আ ভিক্টিম ব্রো। হালাত কা...'
'কিপ দ্য ডোর ক্লোজড... প্লিজ।' বলে দরজাটা বাইরে থেকে ঠেলে বন্ধ করে চলে গেল মৈনাক। ওর জুতোর শব্দটা ক্রমে ক্ষীণ হয়ে এলো। কবীর দরজার দিকে তাকিয়ে হাসল, তারপর মাথা নেড়ে ঘুমন্ত প্রত্যূষের দিকে তাকিয়ে একবার দীর্ঘশ্বাস ফেলে ওর চাদরটাআর একবার টেনে দিল ভালো করে।
'প্যাটার্ন লক তো... দেখ না ট্রাই করে খোলে কি না।'
ব্রততী কনুইয়ের একটা গুঁতো দিয়ে স্মিতাকে ইশারা করল প্রাজক্তার ফোনটা হাতে তুলে নিতে। স্মিতা চোখের ইশারায় বুঝিয়ে দিল, ও পারবে না। দরজাটা বাইরে থেকে টেনে দিয়ে গেছিল প্রাজক্তা, ফিরছে না দেখে একসময়ে উঠে গিয়ে ভেতর থেকে বন্ধ করে দিল অন্তরা। ব্রততী আর স্মিতার দিকে তাকিয়ে বলল, 'করিডোরে কেউ নেই। একজন কাজের লোককে এত রাতে পাওয়া যায়? কোথায় গেল ও?'
'যেখানেই যাক, আমি গিয়ে দেখতে পারব না একা। ফোনও করা যাবে না... ফেলে গেছে এখানে।', কথাগুলো বলে ফোনটা নিজেই হাতে তুলে নিল ব্রততী। তখনো নেট কানেকশন অন করা, মনে হচ্ছে আগের ম্যাসেজগুলো এসে অপেক্ষা করছে-- কখন তাদের পড়া হবে এক এক করে।
- একটা ফোন কর না এই ফোনটাতে।
- তাতে কী হবে?
- রিসিভ করলে আনলক হবে না?
- অতই সস্থা? ফোনটা রেখে দে, এসে বুঝতে পারলে বাজে সিন হবে...
- ছেলেদের কাউকে একটা ফোন করব?
- করে কী বলবি? প্রাজক্তা বেরিয়ে গেছে একা... খুঁজে আনতে?
- ঘড়িতে কটা বাজে দেখেছিস? একজনকে নিয়ে চলছে... ঠাকুরকে ডাকছি ভালোয় ভালোয় ফিরে আসুক, আবার থানা পুলিশ না হয়!
- এটা কোনো সিরিয়াল কিলার মার্কা গল্পও নয়... যে এক এক করে হাওয়া হয়ে যাবে!
ব্রততী আর স্মিতার মধ্যে কথাগুলো চুপ করে শুনছিল অন্তরা। স্মিতার এই এক এক করে হাওয়া হয়ে যাওয়ার কথাটা শুনে আর চুপ না থাকতে পেরে বলল, 'তাই তো হচ্ছে স্মিতা দি। একদল নার্সিং হোম চলে গেল। দু জন তাদের পেছন পেছন। ছেলেদের ঘরে এখন কারা, তাও জানি না। আমাদের ঘর থেকেও একজন চলে গেল। এমন কি হওয়ার কথা ছিল? মেনে নিলাম একজন কোনো ভাবে মাথায় চোট পেয়ে সেন্সলেস হয়ে গেছিল, তার মেডিকাল অ্যাটেনশন দরকার। কিন্তু... শুধুই কি এইটুকু? তোমাদের মনে হচ্ছে না, সবাই কিছু না কিছু চাপা দেওয়ার চেষ্টা করছে... লুকনোর চেষ্টা করছে কিছু?'
'তুই শান্ত হয়ে বস... প্লিজ। মেঝেতে এখন এদিক ওদিকে কাচের টুকরো পড়ে থাকতে পারে।', ব্রততী ওকে হাত ধরে টেনে বসাল আবার। ওকে শান্ত করার চেষ্টা করেই বলল, 'রেসর্টে অনেক লোক আছে, সিকিওরিটি গার্ড আছে, রাতে অনেকে জেগে থাকে। প্রাজক্তা যদি কোথাও গিয়ে থাকে, এসে যাবে। আসবে না-ই বা কেন?'
'জানি না রে, এই সিকিওরিটি, সিসিটিভি... এসব থাকতেও তো রাগিনীর কিছু একটা হল। প্রত্যূষ বলতেই পারছে না কী হয়েছিল ঘরে। বা চাইছে না বলতে... যদি অন্য কেউ এসে...', কথাগুলো বলতে বলতে চাপা উৎকণ্ঠায় আর কান্নায় গলা বুঁজে এলো অন্তরার।
স্মিতা ওর কাছে এগিয়ে বসল। অন্তরার পিঠে হাতটা রেখে বলল, 'ঠিক আছে, তুই তো একা নেই। এখন যদি এসব কিছু না হত, প্রাজক্তা কি রাতে ঘর থেকে একা বেরতো না? সবাই তো অ্যাডাল্ট এখানে। ওর চিন্তায় তুই কেন প্যানিক করছিস? আমি কোত্থাও যাব না... তোর পাশেই বসে থাকব এখানে, তুই আমাকে ধরে শুয়ে থাক এখানে। চোখটা বন্ধ করে শুয়ে থাক... ঘুমোতে না পারলেও স্ট্রেসটা কমবে।'
ব্রততী তখনো হাতে প্রাজক্তার ফোনটা নিয়ে নাড়াচাড়া করছে, বিড়বিড় করলে বলছে 'প্যাটার্নটা আমি দেখেছিলাম একবার... কেমন জেড-এর মত করে ওপরে তুলে দিত... একবার ট্রাই করে দেখলে...'
স্মিতা ওর দিকে একবার আড়চোখে তাকিয়ে আবার অন্তরাকে বলল, 'কী হল? প্রাজক্তা এসে যাবে... তুই এদিকে আয়, বালিশে মাথা রাখ।'
অন্তরা বুঝতে পারছিল একটা চাপা উত্তেজনায় ওর শরীরে মাঝে মাঝে একটা মৃদু কাঁপুনির মত হচ্ছে। পায়ের পাতার তল আর জিভটা শিরশির করছে,অ্যাংসাইটির লক্ষণ। স্মিতা ওদের থেকে বয়সে বড়ো, ওর কথায় নিজেকে কিছুটা আশ্বস্ত করার চেষ্টা করেই বালিশে মাথা দিয়ে শুলো অন্তরা। আলোর দিকে পিঠ করে শুলো যাতে চোখ আলো না লাগে। ওর গায় একটা চাদর টেনে দিয়ে স্মিতা ব্রততীর দিকে তাকিয়ে বলল, 'ফোনটা রেখে এসিটা একটু বাড়িয়ে দে না... ঠান্ডাই তো হচ্ছে না তেমন।'
----------------------------
'হোয়াট হ্যাপেনড... এনি প্রবলেম?'
প্রাজক্তাকে এত রাতে জমিদারবাড়ির অন্দরমহলে একদিক থেকে অন্যদিকে একা আসতে দেখে একটু চমকেই গেল মৈনাক। মেয়েরা চারজন একটা ঘরেই আছে, এটা জানত। একবার নক করে দেখেও এসেছিল অভীকের সঙ্গে গিয়ে। ওদের কারো এত রাতে, এই সময়ে বেরনোর কথা নয়। কেমন অদ্ভুত লাগছে ওকে, অন্ধকার থেকে আলোর দিকে এগিয়ে আসছে, একটা নীল রঙের স্ট্রলকে শালের মত জড়িয়ে। বাদামী রঙ করা কোঁকড়ানো চুলগুলো খোলা, কপালে কাঁধে পড়ে হালকা হালকা উড়ছে চলার তালে তালে। হয়ত এই রকম সময় বলেই, এমন অদ্ভুত লাগছে। জমিদার বাড়ির রেনোভেট করা অন্দরমহলের পুরনোদিনের ল্যাম্পশেডের এফেক্টে, প্রাজক্তার এই একা একা এগিয়ে আসা-- সুন্দর না গা ছমছমে ঠিক আলাদা করে বুঝতে পারল না মৈনাক। শুধু মনে হল, পরিস্থিতি অস্বাভাবিক হলে সব কিছুই কেমন অস্বাভাবিক হয়ে ওঠে। সৌন্দর্য্য, লাবণ্য, বিস্ময়, সব কিছুই...
ও কাছাকাছি আসতেই মৈনাক বলে উঠল -- 'হোয়াট হ্যাপেনড... এনি প্রবলেম?'
প্রাজক্তাও মৈনাককে এই সময়ে এখানে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখবে, প্রত্যাশা করেনি। হাঁটতে হাঁটতে থমকে গেছিল হঠাৎ এক মুহূর্তের দুজন। তারপর দ্রুত এগিয়ে এলো একটা হাসি নিয়ে। মানসিক অথবা পারিপার্শ্বিক প্রতিকূলতার মাঝে পরিচিত একটা মুখ দেখতে পেলে মানুষের মধ্যে যে স্বাভাবিক এক আশ্বস্ত হওয়ার অনুভূতি জন্মায়। কিছুটা হালকা হওয়ার চেষ্টা করেই ওর স্বভাবোচিত কায়দায় হিন্দি টানে বলল, 'আরে দাদা! তুমি এই রাতে ভীরান হাওয়েলি মেঁ চলে বেড়াচ্ছ কেন?!'
পরিস্থিতি বুঝেই মুহূর্তরা কেমন অপ্রত্যাশিত ভাবে জন্মায়। সারাদিন চলে গেল, হঠাৎ এখন এখানে... এই প্রথমবার প্রাজক্তাকে একা সামনে পেল মৈনাক। অপ্রত্যাশিত ভাবেই। অথচ সকলের যা মানসিক অবস্থা, অন্য সময়ে যে ভাবে কথা বলা যেত, যেভাবে কথা বলতে চাইত মৈনাক... তা চেষ্টা করেও পেরে উঠবে না। এই হাল্কা ইয়ার্কির উত্তরেও যে কী বলবে স্থির করতে পারল না মৈনাক। দুটো ছেলে বেমালুম গায়েব হয়ে গেছে, অথবা প্রত্যূষকে ওই অদ্ভুত সাইকো মত ছেলেটার দায়িত্বে রেখে চলে এসেছে-- এসব জানাতে ইচ্ছে করল না। তার চেয়ে হালকা হেসে চুপচাপ থাকা যায়।
ওর এই চুপচাপ থাকার মাঝেই প্রাজক্তা আরো কিছুটা কাছে এগিয়ে এসে বলল, 'উড়ন ছু হোনে কা ইরাদা হ্যায় মিয়াঁ! হমে সব পতা হ্যায়!'
'আর উরন ছু! একি সিনেমা?... পুলিশের কাছে এফআইআর হলে সবাই ধরে ধরে ইন্টেরোগেট করবে শালা রা!', মেয়েটা এমন একটা আহ্লাদ করা সুরে এগিয়ে এসে ইয়ার্কি করল, তার উত্তরে কোনো হালকা সরস কিছু না বলে স্পষ্ট ভাবেই মনে আশঙ্কাটা বলে ফেলে দীর্ঘশ্বাস ফেলল মৈনাক। আহ্বালদের উত্তরে সময়োচিত চটুল উত্তর দেওয়ার যোগ্যতাই আসলে ওর নেই। এটা নিজেও মনে মনে বুঝতে পেরে হতাশ হয়। অতিক্রম করতে পারে না।
'তুমি এদিকে হঠাৎ... কিছু লাগবে?'
প্রসঙ্গটা ঘুরিয়ে দিতে, অথবা এই পরিবেশে একটা তুলনামূলক ভাবে স্বাভাবিক কথোপকথনের জন্যেই জিজ্ঞেস করল মৈনাক। প্রাজক্তাও এক কথায় কেজো উদ্দেশ্যটা বলতে চাইল না। একটু থেমে ওর দিকে তাকিয়ে থাকল কিছুক্ষণ, তারপর অন্যদিকে কাউকে একটা খোঁজার মত চোখ বুলিয়ে দেখার মত করে তাকিয়ে থেকেই বলল-- 'ঢুন্ড রহি হু, মিল নেহি রহা কোই।'
মৈনাকও সেদিকে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করল, কাকে খুঁজছে প্রাজক্তা এত রাতে। 'কীসে ঢুন্ড রহি হ্যায় আপ? শুড উই কল দ্য ম্যানেজার ফর হেল্প? ইজ এভরিথিং অল রাইট?'
- এই কোয়েশ্চনটারই তো কোনো স্রেট উত্তর আসছে না দাদা। কিছুই তো অলরাইট হচ্ছে না!
- মানে?
- অব তুমি জিজ্ঞেস করলে, কেন এদিকে... কী লাগবে...
- হুম।
-সো, দেয়ার আর মোর দ্যান ওয়ান আনসার! মোর দ্যান ওয়ান ট্রুথ... ইউ নো। দেয়ার ইজ অফন্ মোর দ্যান ওয়ান ট্রুথ টু বিহোল্ড।
-
- হা হা... ভাবছ, একজনকে হাসপাতালে নিয়ে গেছে... অব আর একজন কী শুরু করল। তাও এই সময়ে!
- না... মানে, বুঝতে পারছি না আর কি!
- শিশা টুটকে বিখর গয়া ব্রো... গলৎ ওয়াখৎ, গলৎ জগাহ।
-
- আরে অন্তরা নার্ভাস হয়ে হাত থেকে কাচের গ্লাস ফেলে... ও ডিয়ার!... অব ক্লিন করার জন্য তো আমার সাসুমা এখানে বসে থাকবে না। রাইট?
- এই সময়ে...
- ইয়াপ, অ্যাট দিস টাইম কেউ এসব করবে না। বাট উই উড পে ডিয়ারলি ফর সার্ভিস অ্যান্ড অল দ্য জমিন্দারি দিস অ্যান্ড দ্যাট। এক মসকিউটো রিপেলেন্ট তক ঠিক সে কম নহি করতা! অ্যান্ড দিস... অন্দরমহেল, ঝাড় লন্ঠন, রানিমার বিস্তর... নন সেন্স!
- আর তো কয়েক ঘন্টার ব্যাপার, ঘরে গিয়ে চোখ বন্ধ করে কাটিয়ে দাও।
- দ্যাট ওয়াজ ওয়ান ট্রুথ। দ্য অদার ট্রুথ ইজ-- দম বন্ধ হয়ে যাচ্ছে আমার ওই ঘরে, এক কথা শুনতে শুনতে। এই নওকরানি ডাকার নাম করে ভাগ আই কুছ দের কে লিয়ে! আই ওয়াজ জাস্ট আবাউট গো আউট ফর সম ফ্রেশ এয়ার। অ্যান্ড...
- অ্যান্ড?
- জিহাল-এ-মস্কিঁ মকন-বা-রঞ্জিশ... অওর কেয়া বতায়?
- মানে?
- ঘুটন সি মেহসুস রহা হ্যায় কভি কভি। আপ নহি সমঝোগে ব্রো... হর চোট অপনি অপনি জগাহ...তকলিফ কে টুকরে বিখরা বিখরা। আই জাস্ট ডোন্ট হ্যাভ আ গুড ফিলিং আবাউট দিস প্লেস এনিমোর!
প্রাজক্তা দীর্ঘশ্বাস ফেলে হঠাৎ ফিরে দাঁড়াল, চলে যাওয়ার জন্য। মৈনাকের ইচ্ছে হল ওকে থামতে বলে... পারল না। প্রাজক্তা মাথা নিচু করেই এগিয়ে গেল দু-পা। কিছুটা দূরে চলে গেল। তারপর থেমে গিয়ে বলল, 'প্রত্যূষ ডিড নট এক্সপ্লেন এনিথিং... না কুছ কনফেস কিয়া... হ্যায় না?'
'ইভেন ইয়ু ফিল, হি হ্যাজ ডান সাম্থিং টু হার?'
যেতে না দেওয়ার একটা অন্যতম পথ-- যে চলে যেতে চাইছে তাকে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন দিয়ে বাঁধা। নিজের প্রশ্নের উত্তরে মৈনাকের প্রশ্নটা শুনেই প্রাজক্তা ঘুরে দাঁড়াল, কোমরে হাত দিয়ে একটা তাচ্ছিল্যের হাসি হাসল। তারপর সাবধানে দুদিকে তাকিয়ে গলা খাদে নামিয়ে সেই তাচ্ছিল্যের সুরেই বলল ' কাম অন! কিস কো নেহি লগতা ব্রো?'
মৈনাক কাঁধটা ঝাঁকিয়ে বুঝিয়ে দিল, ও নিশ্চিৎ নয়। তারপর ইচ্ছে করেই কবীরের মত করে বলল, 'উই ডোন্ট নো দ্য হোল স্টোরি, রাইট?'
ওর কথাটা যেন প্রাজক্তার পছন্দ হল। মনে হল, এই ঘরে মেয়েদের মাঝে যে সেন্সিবল কথাটা কেউ বলতে বা শুনতে চাইছিল না, একটা গসিপের মধ্যে চলে যাচ্ছিল অথবা প্যানিকের মধ্যে... তার বাইরে এসে এই প্রথম কেউ একজন একটা থিওরির কথা বলছে। একটা ঘটনা যা দেখা যাচ্ছে, তার পেছনে একটা ঘটনাপ্রবাহের থিওরি। যা সবাই এখন দেখছে, বা যেখান থেকে দেখে আন্দাজ করে নিচ্ছে... তার অন্তরালে থাকা ঘটে যাওয়া কিছু। দ্য হোল স্টোরি। দ্য আদার ট্রুথ। দ্য আদার আনসার।
' আপ কো পতা ভি হ্যায়, হোয়াট ইজ গোইং অন দেয়ার ইন দ্য নার্সিং হোম?'
একটা অদ্ভুৎ রহস্যের সুর নিয়ে কথাগুলো বলল প্রাজক্তা। মনে হল মৈনাককে পরীক্ষা করছে। আদৌ কী জানে, আর কী ভাবছে ছেলেটা।
অন্য কেউ হলে মৈনাকের সেই চিন্তাটাই ফিরে আসত... কোনোক্রমে কাটিয়ে দিয়ে এসব থেকে নিজেকে দূরে রাখার কথা। কিন্তু প্রাজক্তার এই প্রশ্নটার মধ্যে যে অদ্ভুৎ একটা গোপন এবং রহস্যময় কিছু তথ্যের প্রলোভন, তাতে জড়িয়ে গেল আগের সিদ্ধান্তগুলো। এমন কি কিছুক্ষণের জন্য, নীলেশ আর সতীশকে খোঁজার কথাটাও গুরুত্ব হারিয়ে ফেলল হঠাৎ। ও জানে রাগিনী খুব একটা স্টেবল না, আন্দাজ করতে পারে কিছু একটা অপ্রত্যাশিত জটিলতার সৃষ্টি হয়েছে নার্সিং হোমে। ওকে সব কিছু ভেঙে না বললেও, অভীক হয়ত আর একটু বেশি কিছু জানে। আর সেই কারণেই ভিভানকে নিয়ে চলে গেল... অপ্রতিমদা ডাকছে বলে। অপ্রতিমদা তো না, আসলে ডাকছে টায়রা! টায়রার ডাকে ল্যাজ নাড়তে নাড়তে চলে গেল হিরো সাজতে। কিন্তু প্রাজক্তা ঠিক কী ঘটার কথা বলছে নার্সিং হোমে?
'অপ্রতিমদা ফোন করেছিল। বলল এখন স্টেবল। মেয়েদের নিয়ে আসতে গেল অভীক আর ভিভান। তোমরা হয়ত জানো না... ওরা বেরিয়ে গেছে অনেকক্ষণ।', নিজে অনেকটাই জানে, এটা বুঝিয়ে দেওয়ার জন্যই একটা সার-সংক্ষেপ করার চেষ্টা করল মৈনাক। ওদের না জানার কথাটা জোর দিলেও, কিছুটা সাবধানেই বলল, যাতে এমনও মনে না হয় ও নিজে অনেক কিছুই জানে, আর লুকোতে চাইছে। প্রাজক্তা ওর কথাগুলো শুনে হেসে ফেলল ফিক করে, মাথাটা দুদিকে নেড়ে কোঁকড়ানো চুলগুলো ঝাঁকিয়ে শুধু বলল, 'ও রিয়েলি, অপ্রতিমদা নে খুদ ফোন কিয়া থা? মে বি... উনিই হয়ত বলেছেন। ওনারই ইনস্ট্রাকশন।'
- এই তো ব্যাপার, হোয়াট এলস ইস গোইং অন?
- আরে! হাম কো কেয়া পতা? আপ তো হম পর হি চড় গ্যায়!
মৃদু অনুযোগের সুর থাকলেও, প্রাজক্তা তখনও কেমন একটা রহস্য আড়াল করা হাসির মাঝে সাজিয়ে রাখতে চাইছে সব কথাগুলো। মৈনাক একটু সামলে নিয়েই বলল, ' আই ফেল্ট উই নো সামথিং এলস, তাই বললে ওভাবে।'
প্রাজক্তা ওকে পাশ কাটিয়ে চলে গেল সিঁড়ির দিকে, ধাপে ধাপে সিঁড়ি নেমে গেছে একতলার সেই বড়ো হলঘরের দিকে... যেখানে ওরা সন্ধ্যেবেলা আড্ডা দিচ্ছিল সবাই মিলে। অথচ এখন গ্রুপের শুধু ন জনই আছে রেসর্টের এই অংশে। তাও তিন-দুই-দুই-দুই ছকে চার দিকে বিচ্ছিন্ন হয়ে। একটা ছোটো বিচ্ছিন্ন অংশ জানেই না, যে অন্য অংশগুলোতে এখন কী ঘটছে। রেসর্টের সিসিটিভি ক্যামেরাগুলোর কাছে আছে কেউ, কেউ আছে একেবারেই আড়ালে, অন্য কোথাও। আর কিছুক্ষণ পরেই দিনের আলো ফুটে যাবে। তার আগেই হয়ত কেউ ফিরে আসবে নার্সিং হোম থেকে। অথবা না-ও ফিরতে পারে। হয়ত প্রত্যূষ আর রাগিনীকে নিয়ে অনেকগুলো অপ্রিয় কথা শুরু হবে সকাল হলেই। এই রেসর্ট থেকে ওরা বেরিয়ে গেলেও, এই রেসর্টের রাতটা অনেকদিন পিছু নেবে প্রত্যেকের। অথচ, একটা সামান্য আঘাতের ঘটনা হয়েও থেকে যেতে পারত। অনেক কিছুই তো মানুষ একটা রাতে সহ্য করে, মুখোমুখি হয় অপ্রিয় কিছু মুহূর্তের... কিন্তু পরদিন ভুলে যায়। পর দিন না হলেও, কয়েক দিন পর, কয়েক সপ্তাহ অথবা কয়েক মাস। অথচ এখানে প্রায় অনেকেই মনে মনে নিশ্চিৎ... পরিস্থিতি অস্বাভাবিক বলেই, রাগিনীর সুস্থ হওয়ার বাইরেও অনেক কিছু থেকে যাবে। কিছু একটা অস্বাভাবিক বলেই, জেরার মুখে পড়তে হবে একে একে অনেককেই। সে পুলিশ হোক বা অন্য কেউ। এই জেরার ঊর্দ্ধে কেউ না। জেরাকে মানুষ কখন ভয় পায়? কেন এড়িয়ে যেতে চায়?... শুধু অপরাধ বোধ থেকেই?... আর হেনস্থা? প্রাসঙ্গিক প্রশ্নের বাইরের আরো যা কিছু জোঁকের মত আটকে থাকবে...
সিঁড়ি দিয়ে ধীরে ধীরে তিন চার পা নেমে থেমে গেল প্রাজক্তা। রেলিং-এ সামান্য ভর দিয়ে মাথা তুলে মৈনাকের দিকে তাকিয়ে বলল --
'পুরা রামায়ণ ইয়েহিঁ খড়ে খড়ে সুন লেঙ্গে? কোথাও বসে বলি?'
( চলবে)
© জয়দীপ চট্টোপাধ্যায়
পোস্টার : ত্রিবিন্দু
Comments
Post a Comment