চকোলেট কথা : সোহম ভট্টাচার্য্য
অতীতের চকোলেটের সঙ্গে আজকের দিনের চকোলেটের মিল খুবই কম । ইতিহাস জানান দেয়, অতীতে চকোলেট কোন মিষ্টি ও ভক্ষণযোগ্য নয়, বরং ছিল তিতা স্বাদের উৎসবের পানীয় । প্রাচীন মায়া সভ্যতায় যুগেও ছিল চকোলেট এর অস্তিত্ব । এমনকি তারও আগে, দক্ষিণ পূর্ব মেক্সিকোর প্রাচীন ওলমেক সভ্যতায় এর প্রচলন ছিল বলে খাদ্য ইতিহাস বিশেষজ্ঞদের মত । ‘চকোলেট’ শব্দটা শুনলেই মিষ্টি, ক্যান্ডি, বার ও মনোরম মিষ্টান্নের ছবি চোখে ভেসে ওঠে । তবে সুদূর অতীতের চকোলেটর সঙ্গে আজকের কোনও মিলই নেই । ইতিহাস জানান দেয়, কোকো নামের গাছের গুটি গুটি ফলগুলোর এক একটিতে প্রায় চল্লিশটির মত ‘বিন’ বা ‘শুঁটি’ থাকে যেগুলো পুড়িয়ে কোকো বিন তৈরি হতো।
যুক্তরাষ্ট্রের স্মিথসোনিয়ার ন্যাশনাল মিউজিয়াম এর কালচারাল আর্ট কিউরেটর হায়েস লাভিস জানান, খ্রীষ্টপূর্ব ১৫০০ থেকেই প্রাচীন ওলমেক সভ্যতার মানুষেরা নৌ যান ভরে কোকো ফল নিয়ে আসতেন ।
ধারণা করা হয়, ওলমেকরা, তাঁদের ধর্মীয় উৎসবে কোকো বিনগুলি সাজিয়ে রাখতেন দেবতার প্রতীক বা (totem) এর সামনে । মায়া সভ্যতায় ওলমেকরাই সম্ভবত এই কোকোর ব্যবহারকে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন ।
মায়ার ইতিহাসে উল্লেখ পাওয়া যায়, বিশেষ বিশেষ লেনদেন এর চূড়ান্ত করার অনুষ্ঠানে চকলেট পানীয় ও চকলেট ক্যান্ডি পরিবেশিত হতো । তবে এটি সর্বসাধারণের জন্য সম্ভবত ছিল না । সম্পদশালী ও ক্ষমতাধররা এটি খেতেন । এমনকি মরিচ, ফলের টুকরো সহযোগে এটি খাওয়া হতো ।
আজটেক সভ্যতা (১৪২৮ সালে প্রতিষ্ঠিত) লোকেরা চকোলেটকে গরম অবস্থায়, সান্দ্র পানীয় রূপে তাম্র ও স্বর্ণের পাত্রে পরিবেশন করতেন এমন কী, তাঁরা কোকো বিনকে মুদ্রারূপেও ব্যবহার করতেন ।
আজটেক সভ্যতায় চকলেটের খাদক দাপুটে ছিলেন বলে মনে করা হয় আজেটকিয়ান শাসক মন্টেজুমার দ্বিতীয়কে (১৪৬৬ – ১৫২০ সাল)। তিনি রোজ গ্যালনভর্তি চকলেট পান করতেন বলে জনশ্রুতি রয়েছে কোন কোন ঐতিহাসিকের মতে, মন্টেজুমার দরবারে চকোলেটের খোঁজ পান স্প্যানিশ বীর হারনান কার্টেজ । তিনিই নাকি স্পেনে এর প্রচলন করেন ।
অন্য একদলের ভাষ্য ১৫০২ সালে খ্রীষ্টোফার কলম্বাস আমেরিকা যাত্রাপথে কোকো বিনের আবিষ্কার করেন ও ফেরার পথে তা স্পেনে নিয়ে এসেছিলেন ।
ইতালি, ফ্রান্স সহ অন্য যেসব ইউরোপীয় দেশের অভিযাত্রীরা সেন্ট্রাল আমেরিকায় ভ্রমণ করতেন, তাঁরাও চকোলেটের সন্ধান পান ও নিজ দেশে নিয়ে যান ।
(ফ্রান্সের অভিজাতদের চকোলেট পান দৃশ্য)
সহসাই ইউরোপ জুড়ে এই চকোলেট এর প্রতি দুর্বলতা ছড়িয়ে পড়ে। চকোলেট কৃত্রিম উপায়ে উৎপাদনে খাটতে থাকেন ক্রীতদাসেরা । তবে প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, আজটেকীয় চকোলেট ইউরোপে এসে, আখের রস, দারুচিনি, গোলমরিচ প্রভৃতির সঙ্গে মিশে গিয়ে ‘হট চকলেট’ নাম নিয়ে কেতাদুরস্ত লোভনীয় পদ হয়ে ওঠে। খুব শীঘ্রই, লন্ডন, আমস্টারডাম দেশসমূহে, এর দোকান গড়ে ওঠে। বাণিজ্যিক ভাবে ১৬৪১ সালে স্প্যানিশ জাহাজে ফ্লোরিডায় চকোলেট আনা হয় সর্ব-সাধারণের জন্য ।
১৬৮২ সালে বোস্টনে প্রথম ‘চকোলেট হাউস’ চালু হয় ।১৭৭৩ সালে আমেরিকায় কোকো চাষ গম ও ভুট্টা চাষের মতই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে । ১৭৭৫ থেকে ১৭৮৩ সালে আমেরিকান বিপ্লবের দিনগুলিতে চকোলেট সামরিক বাহিনীর মধ্যে রেশন রূপে দেওয়া হত । ১৮৭৬ সালে সুইস চকলেট ব্যবসায়ী ড্যানিয়েল পিটার প্রথম চকোলেট ও দুধ মিশিয়ে জমাট করে । বর্তমানের ‘চকোলেট বার’ তৈরী করেন বলে মনে করা হয় ।
© সোহম ভট্টাচার্য্য
কৃতজ্ঞতা স্বীকার : -
Corrie E. Norman, “Food & Religion” in the Oxford Handbook for Food History (2012) P.P – 409 – 429.
Melitta Weiss Adamson, ed. “Food in the Middle Ages”.
Comments
Post a Comment