সহেলী সেনগুপ্তের অণুগদ্য গুচ্ছ
একে তো ফাগুন মাস, দারুণ সময়...
ফেব্রুয়ারি হাওয়ায় মনটা বসন্তবৌরি হয়ে যায় কেমন ঝুপুস করে। খোলামকুচির মতন, শিমুলতুলোর মতন, পায়রার পালকের মতন হাল্কা হয়ে গিয়ে দমকা হাওয়ায় উড়তে থাকে বেমক্কা। লাগাম পরে না কিছুতেই। কাজ করে না কিচ্ছুটি। অদৃশ্য খোঁপায় কল্কে ফুল গোঁজে। আলো-আঁধারি গলিতে উপুড় করে ঢালে মুঠোরোদ্দুর। আকাশনীল, আর শ্যাওলা সবুজ, আর মেঠো মেটে রংসাজের কবিতার নতুন বইয়েদের ওমে মুড়ে রাখে নিজেকে। গত শীতে যে তাকে ভেঙে ফেলেছিল, দুমড়ে ফেলেছিল, উপড়ে ফেলেছিল প্রায়, তাকে একফালি নতুন শিকড় ধার দিয়ে আসে হাসতে হাসতে। তার অরণ্যপ্রাণে যে শুধু কুঠার বিছিয়ে দিয়ে গেছে, তাকে নিঃশেষে ক্ষমা করে দেয়। ঈশান কোণ থেকে ধেয়ে আসা নিম্বাসমেঘের মত ওজনদার আঘাত তার পথে বিছিয়ে দিয়েছে যারা, তাদের মনে করিয়ে দেয় যীশুর ডাকনাম। পঙ্কিল জলে দাঁড়িয়ে যারা কাদা ছোঁড়ে ক্রমাগত, তাদের অনতিদূরে রেখে যায় ভোরের বেলার ফুল। আয়ুরেখা ধরে হাঁটতে থাকা যে বিগতযৌবন, ক্লান্ত রাজপুত্র তার অভিশাপসমান অমরত্বের বর ফিরিয়ে নেওয়ার প্রার্থনা করে রোজ ঈশ্বরের কাছে, তার বলিরেখায় ভরা বিষণ্ণ হাতে দেয় কোনো এক দুঃখী রাজকন্যার কবরের উপর ফুটে থাকা বেগনি ফুল। বুকের মধ্যে সঙ্গোপনে আগলে রাখা নামের উপর স্নেহ ঢালে তুমুল। আদরবাটি উপুড় করে।
ফেব্রুয়ারি হাওয়ায় এ মন বসন্তরং চুমু খোঁজে। আস্তিনের নীচে সযত্নে লুকোনো চোটের ব্যথায় ছুঁইয়ে দেয় উপশমী কর্পূরগন্ধ। বকের ডানা থেকে সাদা ধার করে ভয়ের মতন কালো মনগুলোতে গুলে দেয় একটু করে। ছোট্ট জীবনের হঠাৎ পাওয়া উড়ালপুল মুহূর্ত সজোরে বাঁচতে চায়। শঙ্খচিলের ডানার জোর নিয়ে উড়ে যেতে চায় তার নির্জনতার ছাদবাগান পেরিয়ে।
ফেব্রুয়ারি হাওয়ায় এ মন টলটলে অভিমানী হয়ে যায়। নির্বিরোধী প্রজার মতন মুখ বুজে সে ভোরে জাগে, ভাতটুকু খায়, কাজ-আপিসে যায়। ভারি কষ্ট করে রোজগারে লাগে। পাগল হাওয়াকে শাসন করে খুউউউব। কিন্তু এক্কেবারে যুঝে ওঠে না।
ফেব্রুয়ারি হাওয়ায় এ মন প্রেমিকের গালের তিল হয়ে যায়….
মনের মানুষকে...
মনের মানুষ, একদিন যখন আকাশের কাজলকালো খোঁপা ঝোড়ো বাতাসে খুলে গিয়ে মেঘ নামবে আকাশতলার মাঠে, আমি তোমার হাত ধরে এক ছুট্টে যাব নরমিয়া ঘাসে ভরা মাঝমাঠে। দরিয়ার মতন জল হবে মাঠে, ঝেঁপে বৃষ্টি নামবে। দূরে কোথাও গঙ্গার বুকে ভেসে যাবে অভিমানদুপুর। বিদ্যুৎ ঝিলিক দেবে আজকের মতন, আমি তোমার হাত চেপে ধরব ভয়ে, কিন্তু ফিরতে পারব না কেউ। মাঝমাঠ ততক্ষণে না পেরোতে পারা শ্রাবণজলে ঘেরা। চারিপাশের রাস্তায় থাকবে না কেউ। ভেজা কাক গাছের ডালে বসে অবাক চেয়ে দেখবে আমাদের পাগলের মতন প্রেম। দুটো মানুষ-মানুষী তুমুল ভিজবে আদরে আর বৃষ্টিতে। হাওয়া আর বৃষ্টির তোড়ে ডুবে যাবে আমার খোলা গলার গান। দু'চোখ ভরে দেখতে চেয়েও যত দেখতে না পাওয়া, সমস্ত মনপ্রাণ দিয়ে ছুঁতে চেয়েও যত ছুঁতে না পাওয়া, কতশত বৃষ্টিপ্রান্তরে অবিশ্রাম অপেক্ষায় বসে থেকেও যত অপেক্ষা শেষ না হওয়া, সব, সব কেমন মায়াবী আদরচুমুভরা সাম্পান হয়ে ভেসে যাবে মাঠদরিয়ায়।
মনের মানুষ, এমন একটা বর্ষাদুপুর দেবে আমায়?
মেঘবালিকার জন্য নতুন রূপকথা
লেখারা যে দিন একটুও আসেনা আমার কাছে, আমি বুঝি, নির্দ্বিধায় আমার গোটা শব্দশহরকে দু'হাতে তুলে নিয়ে তুমি পালিয়ে গেছো বনের হলদে-কমলা পাতাঝরা পথে। আমি অস্ফুটে দাঁড়াই এসে বারান্দায়। যদি তুমি লুটে নিয়ে যাও নিজে, আমার কিচ্ছুই বলার থাকেনা, তুমি জানো। আমি শব্দশূন্য চেয়ে থাকি তাই, কখন তুমি ডাকবে। আমার ভিতরটুকুতে, যেখানে যেখানে আমি শব্দ জমিয়েছিলাম এক শতাব্দী ধরে, আর জমিয়েছিলাম ছবি, আর রং, আর তুলি, আর রঙে মেশাতে দীঘির জল, সেখানটুকু ফাঁকা হয়ে কেমন তোমার অপেক্ষা হয়ে জাগতে থাকে কেবল। বাদলা হাওয়ার দিনে তুমি সে অপেক্ষার মনকেমন গন্ধ পাও বনের মাঝে। বেরিয়ে এসে, ধীর পায়ে, আমায় হাতছানি দিয়ে ডাকতে আসো। খুন হয়ে যেতে পারি জেনে একটুখানি দয়া করে পাতলা ঠোঁটে হাল্কা হাসো। বেশি না। আমি ছুটে গিয়ে দেখি, বনের মাঝে তুমি পাতা সরিয়ে শব্দ সাজাচ্ছ। কোথাও আলগোছে ছড়িয়ে আছে "ব্যথা", কোথাও "আদর", কোথাও "নিভৃত", কোথাও "রাত্রি"। তুমি অবহেলায় "আকাশ"কে এনে ফেলেছো "মাটি"র পাশে, "দীঘিজলে" গড়ে দিয়েছো "আদরপাহাড়", "কাশবনে" লুকিয়ে রেখেছো "শীতভোর"। হলদে একটা পাতা এসে উড়ে পড়েছে "ফাগুনহাওয়া"র তোড়ে। আর সবাইকার মাঝে পড়ে আছে "অপেক্ষা"।
আমি বলছি, "ও মাঝে কেন?"
তুমি বিষণ্ন চোখে বলছ - "এখনো ওর অবসান হয়নি বলে।"
আমি বলছি, "তুমিই তো গল্প লিখছো। শব্দ সাজাচ্ছ। তবে অবসান ঘটিয়ে দাও।"
তুমি বলছ - "চলো তবে, তাই দিই।"
আমি বলছি - "এখুনি দাও।"
একদম দেরি না করে বৃষ্টি নামছে ঝরঝর। আর হঠাৎ, অপার বিস্ময়ে তুমি আমার নাম ধরে ডেকে আঙ্গুল দিয়ে দেখাচ্ছ দূরে। আমি দেখছি, অনতিদূরে সোনায় মোড়া মেঘহরিণী।
পালানো সার্থক হয়েছে।
© সহেলী সেনগুপ্ত
অঙ্কন : শাশ্বত বন্দ্যোপাধ্যায়
খুব সুন্দর লেখনী
ReplyDelete