ভালো থেকো নিশীথ অবশেষ : পর্ব ১১ — জয়দীপ চট্টোপাধ্যায়




ভালো থেকো নিশীথ অবশেষ: পর্ব ১১ 

এক ঝলক ঠান্ডা বাতাস এসে মাঝে মাঝেই কাঁপিয়ে দিয়ে যাচ্ছে। অথচ ঘরের ভেতরটা এমনিতে আরামদায়ক। ঘরের এক কোণে একটা জায়গায় আগুন জ্বলছে, ফায়ারপ্লেসের মত। তার ওপর শিকে গাঁথা মাংস ঘুরছে। নিজে থেকেই ঘুরে যাচ্ছে। কীসের মাংস ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। তবে পাখির না। কোনো ছোটো চতুষ্পদ প্রাণী। পরিবারে সকলেই শাকাহারী, কে এভাবে মাংস ঝলসাচ্ছে ঘরের ভেতর? মাংস পোড়া গন্ধটা ধোঁয়ায় ভেসে বেড়াচ্ছে। মনে হল, এখনই কাউকে ডেকে বলে ওটা ঘরের বাইরে নিয়ে যেতে। কিন্তু কাকে বলবে বুঝতে পারল না। দেখল দুটো লোক ক্যারম খেলছে বসে। ঘরে এত কম আলো, যে তাদের মুখ আলাদা করে চেনা গেল না। কিন্তু মনে হল খুব পরিচিত কেউ, অথচ...
     ঘরে এই অন্ধকার ভাবটা, এই হালকা ধোঁয়া, অল্প-আলোয় দেখা দেওয়ালের ইট বেরিয়ে আসা ইন্টেরিয়র... হুক্কা বারগুলোর কথা মনে করিয়ে দেয়। হুক্কাবারের কথা মনে পড়তেই একটা মিষ্টি গন্ধ ভেসে এলো, মাথা ভারী করা হুক্কার ধোঁয়া? এমনি সময়ে সিগারেট না খেলেও বারে এলে হুক্কার নল নিয়ে বসে থাকতে একটা মজা আছে। অথচ চারপাশে তাকিয়ে সেই আসল জিনিসটাই দেখা যাচ্ছে না।  ঘরে কেবল দুটো মানুষ। ক্যারমের স্ট্রাইকারের টকাস টকাস শব্দ। আর একটা অচেনা ছোটো জন্তুর মাংস ঘুরে ঘুরে ঝলসে যাচ্ছে ফায়ার-প্লেসের মত আগুনে।
     আপাতভাবে, এইঘরে আর কিছু করার নেই। থাকারও অর্থ নেই। ক্যারম, হুক্কা বা মাংস যথেষ্ট পিছুটান নয়। হঠাৎ মনে হল-- এই একাকীত্ব অস্বাভাবিক। এই ঘরটাও। একটা অপ্রত্যাশিত একাকীত্ব আর অস্বাভাবিকতার চিন্তা যেন মুহূর্তের মধ্যেই অনিশ্চয়তা আর অস্বস্তি নিয়ে এলো। কোনো প্রসঙ্গ ছাড়াই মনে হল-- অপেক্ষা একটা চিরকালীন ফাঁকি। প্রতিশ্রুতিরা সব ভাঁওতা। আর জীবনে যে আসে, উদ্দেশ্য নিয়েই আসে। সেসব কেটে গেলে সবই এই ঘর ভর্তি ধোঁয়া, আলো থেকেও আলোকশূন্যতা। আর নিজেই ঘুরে যাচ্ছে ঝলসে ঝলসে, লোকজন টিপে টিপে দেখে যায়... খাওয়ার মত হয়েছে কি না। ছুরি-কাঁটাচামচ দিয়ে চেখে দেখে মাঝে মাঝে।
       কথাগুলো মনে চেপে বসতেই দরজা দিয়ে বেরিয়ে যেতে ইচ্ছে হল। অথচ চারপাশে তাকিয়ে দরজা দেখা গেল না। কী আশ্চর্য, ঘরের একটা দরজা নেই? নাকি অন্ধকারে বোঝা যাচ্ছে না! দরজা খুঁজতে গিয়ে চোখে পড়ল, অন্ধকারে ঘরের এক এক কোণে জোড়ায় জোড়ায় বেড়ালের মত হলুদ-সবুজ চোখ জ্বলে উঠছে। ক্যারম টেবিলের দুজন ছাড়াও আনাচে কানাচে আরো কেউ আছে... যাদের উপস্থিতি এতক্ষণ বোঝা যায়নি। শুধুই চোখ। আর কিচ্ছু না। মাঝে মাঝে শিরশির করে ওঠা ঠান্ডা বাতাস, আলো-আঁধারি, মাংস পোড়া গন্ধ, হুক্কার গন্ধ, এমন অদ্ভুত হলুদ-সবুজ চোখের তাকিয়ে থাকা-- বেশ অসহনীয় হয়ে উঠল এবার। ক্যারম বোর্ডের কাছে গিয়ে অবশেষে জিজ্ঞেস করতে বাধ্য হল-- হোয়্যার ইজ দ্য ডোর?
প্রশ্নটা করেই নজরে পড়ল, বোর্ডে শুধু ক্যারমের ঘুঁটি নয়, বিভিন্ন রকম আইডি কার্ড ছড়িয়ে আছে। স্ট্রাইকার দিয়ে সেগুলোকেই এদিক ওদিক মেরে পকেট করার চেষ্টা করছে দুজন। রাগিনীরই স্কুলের আইডি কার্ড, কলেজের আইডি কার্ড, ভোটার কার্ড, ড্রাইভিং লিসেন্স, প্যান কার্ড। সবকটায় ওর এক এক বয়সের মুখ, তাকিয়ে হাসছে। প্রশ্নটা করার সঙ্গে সঙ্গেই ফায়ার প্লেসের আগুন অথবা অন্য কোথাও থেকে কমলাভ আলো এসে লোকটার মুখে ছড়িয়ে পড়ল। লোকটা অদ্ভুৎ ভাবে হাসল দাঁত বের করে। আর পালটা জিজ্ঞেস করল-- ডোর? ইয়ু ওয়ানা লীভ আস বেব?
গলাটা শুনেই চমকে উঠল ও। রোহিৎ! কলেজের সিনিয়র রোহিৎ। পলিটিকাল লিডারের ছেলে। প্রশ্নটা করেই রোহিৎ হেসে উঠল। সঙ্গে সঙ্গে দপ করে জ্বলে উঠল ক্যারম বোর্ডের বিডগুলো। এই ঘরটা আসলেই একটা ট্র্যাপ, ভেবেই আঁতকে উঠল রাগিনী। জ্বলন্ত ক্যারম বোর্ড থেকে পিছিয়ে যেতে গিয়ে একটা টেবিলে ধাক্কা খেয়ে কাচের গ্লাস পড়ে গেল কাচ ভাঙার শব্দর করে। ঘরের অন্ধকার কোণগুলো থেকে জোড়ায় জোড়ায় হলুদ-সবুজ চোখগুলো সব ওর দিকেই তাকিয়ে এখন।
     চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়ল রোহিত। সেই একই রকম ক্রূর হাসি নিয়ে এগিয়ে এসে রাগিনীর দুটো কাঁধে হাত দুটো রাখল-- থাবার মত। দুদিক থেকে আলতো চাপ দিল কাঁধে, দখল করে নেওয়ার মত। ওর শার্টের খোলা বোতাম সরে গিয়ে রোমশ পুরুষালী ছাতি প্রকাশ পেয়েছে। আগুনের আলোয় চকচক করে মোটা সোনার চেন। ক্যারম বোর্ডে বসে থাকা অন্য লোকটাও এতক্ষনে উঠে দাঁড়িয়েছে। অন্ধকার থেকে এগিয়ে আসছে, ক্রমশ স্পষ্ট হচ্ছে তার মুখও। হাসছে, অথচ অনেক শান্ত। চক চক করছে তার চোখ। সেই কমলাভ আলো তারও মুখ স্পষ্ট করে দিল। ভয়ে অবস হয়ে এলো রাগিনীর শরীর। মিঃ জয়সোয়াল। রাগিনীর মায়ের দ্বিতীয় স্বামী। এই লোকটার সঙ্গেই, তারই বাড়িতে থাকতে হয়েছিল রাগিনীকে। সহ্য করতে হয়েছিল এতগুলো বছর... কলেজ হস্টেলে পালানো অবধি।      
মুখে নিপাট ভদ্রলোকের হাসি, আর শান্ত দৃষ্টি নিয়েই এগিয়ে আসছে মাঝবয়সী মিঃ জয়সোয়াল। ক্লিন শেভড, মাথা ঝিমঝিম করা বিদেশী পারফিউমের গন্ধ।
রোহিতের পুরুষালী থাবা আলত ঠেলে বসিয়ে দিল রাগিনীকে একটা চেয়ারে। তারপর কাঁধ ছেড়ে নেমে এসেছে রাগিনীর হাঁটুর কাছে, ক্রমে পা দুটোর ব্যবধান বাড়িয়ে... থাইয়ের কাছটা ফাঁক করা প্রস্তুতি নিচ্ছে।
আসতে আসতে শার্টের বোতামগুলো আলগা করতে করতে এগিয়ে আসছে মিঃ জয়সোয়াল। প্যান্টের বেলটেটা খুলে নামিয়ে নিচ্ছে প্যান্টটা কোমর থেকে। সেই পরিচিত মিষ্টি হাসি।  
অন্ধকারে শুধু হলুদ, সবুজ চোখ নয়... শেয়াল-হায়নার মত দুসারি ঝকঝকে দাঁতও দেখা যাচ্ছে। নিঃশ্বব্দেই চারদিক থেকে এগিয়ে আসছে এই ক্ষুধার্থ শ্বাপদের হাসিগুলো।
সমস্ত শরীরে কাঁটা দিয়ে উঠল রাগিনীর। চিৎকার করতে চেয়েও গলা দিয়ে আওয়াজ বেরলো না। হাত-পা নাড়িয়ে সেখান থেকে ছুটে পালাতে গিয়ে দেখল সব অবশ হয়ে গেছে। কাঁপুনি দিয়ে উঠল সারা শরীরে।



............................................................. 



ছুটে এসে এমার্জেন্সি রুমে ঢুকে অপ্রতিম দেখল ডঃ দত্ত বেডের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে। আর রাগিনী ঘুমের মধ্যে কোনো স্বপ্ন দেখে বিড়বিড় করার মত বিড়বিড় করে যাচ্ছে। একটা চাপা গোঙানির শব্দ করছে। হাতের আঙুল দিয়ে আঁকড়ে ধরছে বেডের চাদর। মাঝে মাঝে কেঁপে উঠছে ওর শরীর। অপ্রতিমকে ঘরে ঢুকতে দেখেই ডঃ দত্ত বললে, 'জাস্ট লুক অ্যাট হার। শি ইজ গোইং থ্রু আ প্যানিক অ্যাটাক ইন হার স্লিপ, ডিলিরিয়াম হচ্ছে। হাই পালস রেট!' অপ্রতিমের পেছন পেছন টায়রাও এসেছে। ডঃ দত্তের কথাগুলো শুনে কেবল কাঁপা কাঁপা গলায় একবার বলল 'মানে?' রাগিনীকে ওই অবস্থায় দেখে হঠাৎ  মনে হল, পরিস্থিতির অবনতি হচ্ছে হঠাৎ। শারীরিক কোনো কষ্ট হচ্ছে। দুঃস্বপ্ন দেখতে দেখতে ঘুমের মধ্যে অস্বাভাবিক আচরণ করা বিরল ঘটনা নয়, কিন্তু এই পরিস্থিতিতে 'এ আর এমন কি, ঘুমটা ভাঙিয়ে দিন' বলার মত মনের জোর পেল না অপ্রতিম। কোনোরকমে বলার চেষ্টা করল 'ও কিছু দুঃস্বপ্ন দেখছে মনে হয়, প্লিজ ওর ঘুমটা কোনো ভাবে...'
'ওকে কিছুক্ষণ আগেই আমি দেখে গেছি, পিসফুলি ঘুমোচ্ছিল। এভাবে ঘুম ভাঙাতে গিয়ে যদি কিছু ট্রমা বা একসাইটমেন্ট বেড়ে যায়...', বলে কিছুক্ষণ চুপ করে কিছু ভাবলেন ডঃ দত্ত। তারপর নার্সকে বললেন, 'আপনাকে যে মেডিসিনগুলো বললাম, দেখুন ফ্রিজারে তার অ্যাম্পিউল আছে কি না। পালস রেট এরকম থাকলে রিস্ক। তাড়াতারি যান। আমি দেখছি, যদি কোনোভাবে শান্ত করা যায়। ঠিক কী হচ্ছে তো বুঝতে পারছি না।'  অপ্রতিম আবার বলার চেষ্টা করল, 'মনে হচ্ছে দুঃস্বপ্ন দেখছে... ঘুমটা ভেঙে গেলে হয়ত...'
- আমার কাজটা আমাকেই করতে দিন অপ্রতিম বাবু। হতে পারে নাইটমেয়ারই, কুড বি স্লিপ প্যারালিসিস। কিন্তু আমি ঠেলে ঘুম ভাঙানোর রিস্কটা নিতে পারছি না। পারছি না কারণ শি ইজ ড্রাগড, আর মাথার পেছনে ব্লান্ট ফোর্স ট্রমা আছে। এখানে ইসিজি মেশিন অপারেট করার মত কেউ নেই। ইইজি করার মতও কেউ নেই। সবাই সকালে আসবে। মেয়েটির যা পালস রেট দেখছি...
- দেন?
- নার্সকে বলেছি। পালস রেটটা কনট্রোল করার মত আর নার্ভ রিল্যাক্স করার মত স্টেপ নিচ্ছি আপাতত। বাট...
-
- যদি আধঘণ্টার মধ্যে কন্ডিশন রিকভার না করে, উই হ্যাভ টু ইনফর্ম পুলিস অ্যান্ড হার লোকাল গার্ডিয়ানস। আমি আর দেরি করতে চাই না সকাল অবধি... ইট কুড বি টু লেট।
- কী বলছেন? একটু আগেই তো স্টেবল ছিল। এমন কিছুই খারাপ লাগছিল না দেখে। এখন হঠাৎ এইসব...
- লুক অ্যাট হার। ওর মেডিকাল হিস্টরি আমি জানি না। হার্ট কন্ডিশন কেমন জানি না। স্লিপ অ্যাপনিয়া বা তেমন কিছু আছে কি না, তাও জানি না। আপনারা বুঝবেন না। যদি দুঃস্বপ্নের মধ্যেও প্যানিক অ্যাটাক হয়। ইট ইজ ক্লিয়ার ট্রমা। শি ইজ ট্রাইং টু প্রোটেস্ট অর ফাইটব্যাক। শুনুন কী বলছে। একটু মন দিয়ে লিপরিড করলেই বুঝতে পারবেন কিছু শব্দ।
- কী বলছে ও?
- নিজেরাই শুনুন।

অপ্রতিম খুব সাবধানে একটু কাছে এগিয়ে এলো। ইচ্ছে করছিল, একটা ধাক্কা দিয়ে রাগিনীকে ঘুম থেকে ঠেলে তুলে দেয়, এই ডাক্তারের বেশি কথা বলা বন্ধ হয়ে যাবে। কিন্তু নিজের মধ্যে সেই আত্মবিশ্বাসটা পেল না, হয়ত পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতির চাপেই। অন্য যে কোনো অবস্থায়, ঘুমের মধ্যে কাউকে এমন করতে দেখলে সবার আগে তার ঘুমটাই ভাঙিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করত। অথচ এখানে এত কিছু মাথায় ঢুকিয়ে দিল ডাক্তার, যে আর এগোতেই ভরসা পেল না।  অপ্রতিমের ভেতরে একটা অস্বস্তি হচ্ছিল-- মেয়েটাকে স্বাভাবিক বা সুস্থ করে তোলার বদলে তখন শুনতে চেষ্টা করছে ও ঘুমের ঘোরে কী বলছে!
     ডঃ দত্তের শেষ দিকের কথাগুলোর মধ্যে যে অনিশ্চয়তার আভাস ছিল, তা শুনেই টায়রার চোখ ছলছল করে উঠল। ও যে মুখে হাত চাপা দিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠার শব্দটা রোধ করল, ঘাড় না ঘুরিয়েও সেটা বুঝতে পারল অপ্রতিম। পেছন ফিরে তাকাতে পারল না ওর চোখের দিকে। এইসব কিছুর মাঝেও মুহূর্তের জন্য মনে হল, অনশুর মত টায়রাও একই ভাবে পালিয়ে যেতে পারত। আত্মকেন্দ্রিক হয়ে, বা নিজের পরিস্থিতিকে গুরুত্ব দিয়ে আগে চলে গেলে পারত। অথবা, যদি একেবারেই না আসত... আরো ভালো ছিল। অপ্রতিমের এই কমপ্রোমাইজ করতে চাওয়া চেহারাটা ওকে দেখতে হত না, ওর থেকে এভাবে দৃষ্টি এড়িয়ে যেতে হত না অপ্রতিমকে। আজকের পর, অপ্রতিমের কথা মনে পড়লে... আরো অনেক কিছু মনে পড়বে টায়রার। অন্যরকম কিছু, যা অপ্রতিম চায়নি। যার সঙ্গে দু-পা হেঁটে ছিল কেবল অনুভূতিগত ভালোলাগায়, তার সঙ্গে ডিলেমা আর কনফ্লিক্টের মাঝে এভাবে না জড়ালেই ভালো ছিল।
     রাগিনীর শ্বাসপ্রশ্বাস সামান্য দ্রুত। মাঝে মাঝে কেঁপে উঠছে। চোখের পাতায় দ্রুত চলাচল স্পষ্ট। র‍্যান্ডম আই মুভমেন্টস্‌ , যেমন স্বপ্ন দেখলে হয়। অথচ এতক্ষণ দুঃস্বপনের জগতে কেউ আটকে থাকে? আঁতকে বা চমকে উঠে ঘুম ভেঙে যাচ্ছে না কেন? মানুষ তো চেষ্টা করে, দ্রুত এই অস্বস্তি আর অন্যজগতের বিপদ, যন্ত্রণা বা প্রতিকূলতা থেকে কেটে বেরিয়ে আসতে। একটা কোথাও গিয়ে তো ঘুম ভাঙে, স্বপ্ন ভাঙে, ভাঙা উচিৎ। অপ্রতিমের একবার ইচ্ছে হল মেয়েটার মাথায় একটু হাত বুলিয়ে দেয়। হয়ত এই স্পর্শেই ওর ঘুমটা ভেঙে যাবে। বা এই দুঃস্বপ্নটা কেটে যাবে। নিজের হাতটা বাড়িয়েও পিছিয়ে নিল। নিজেকর মাথাটা রাগিনীর মুখের কাছে সামান্য ঝুঁকিয়ে এনে শোনার চেষ্টা করল, ঠিক কী বলছে মেয়েটা। হিন্দি আর ইংরিজি শব্দ, জড়ানো উচ্চরণ। বিচ্ছিন্ন শব্দগুলোর মধ্যে ছেড়ে দিতে বলা, কাউকে জানিয়ে দেওয়া, সবাইকে জানিয়ে দেওয়া, অপরাধের শাস্তির কথা বলছে মেয়েটা। কার্স করছে ইংরিজিতে... ব্লাডি সোয়াইন, সন অফ আ বিচ। কিন্তু কাকে বা কাদের বলছে, বোঝা গেল না। যতটুকু শুনল বা বুঝতে পারল... খুব স্পষ্ট, মেয়েটার মাথার মধ্যে একটা স্ট্রাগল চলছে। কারো বিরুদ্ধে ধস্তাধস্তি করে নিজেকে বাঁচানোর চেষ্টা করছে মেয়েটা। 'তাহলে কি সত্যিই রেপ?',  প্রশ্নটা মাথায় আসতেই চোয়াল শক্ত হয়ে গেল অপ্রতিমের। ভুরু কুঁচকে তাকাল ডঃ দত্তের দিকে। ডঃ দত্ত শুধু বললেন, 'এবার বুঝলেন?'
    অপ্রতিম কিছু বলতে গিয়েও বলতে পারল না। সম্মতিসূচক হ্যাঁ-টাও জানাতে পারল না সরাসরি। মনে হল এখন এই হ্যাঁ-টাও পরে অনেক কিছু হয়ে যেতে পারে। মনে হল, 'টায়রাও কি শব্দগুলো শুনতে পাচ্ছে?', পেছন ফিরে  টায়রার দিকে তাকাতে পারল না  অপ্রতিম। বুঝতে পারল না, ওর চোখের অভিব্যক্তি এখন ঠিক কেমন। কার দিকে তাকিয়ে আছে। ততক্ষণে নার্স চলে এসেছে ট্রে তে অ্যাম্পিউল আর সিরিঞ্জ নিয়ে। ডঃ দত্ত বেডে বসে পেশেন্টের হাতের তালুতে হাত রেখে আসতে আসতে চাপ দিতে লাগলেন। নার্সকে বললেন, সিরিঞ্জ রেডি করে পায়ের পাতার তলাটা ধীরে ধীরে ম্যাসাজ করতে। ডঃ দত্ত রাগিনীর হাতের তালুতে চাপ দিতেই চমকে উঠল রাগিনী। মুখ থেকে একটা চাপা আর্তনাদ বেরিয়ে এলো গোঙানির রূপ নিয়ে। অনেকক্ষণ পর, আবার চোখ খুলে তাকাল মেয়েটা। স্পষ্ট আতঙ্ক চোখে মুখে। দ্রুত শ্বাস-প্রশ্বাস নিতে নিতে চারপাশের সকলকে দেখছে, বোঝার চেষ্টা করছে ও  কোথায়। তবে উঠে বসতে পারল না, শুয়ে শুয়েই। দুঃস্বপ্ন বা তার মাঝে চলা প্যানিক থেকে বেরিয়ে এলে এইভাবেই একে একে প্রতিক্রিয়াগুলো আসে। এই ট্রানজিশনের সময়ে মানুষ নিজেও সবসময়ে বুঝতে পারে না, সে কী বলছে, কী করছে। পাশে কেউ থাকলে, সে বোঝে। উদ্বিগ্ন অথবা বিস্মিত হয়। কেউ কেউ পরে হাসেও। কিন্তু রাগিনীর শারীরিক পরিস্থিতিতে, কোনো রিস্কই নিতে চাইলেন না ডঃ দত্ত। পালস রেট তখনও হাই। তাই ইনজেকশনটি পরিকল্পনা মতই দিলেন।
     'শি উড সার্ভাইভ, রাইট?' প্রশ্নটা শুনে ডঃ শায়ক দত্ত ঘুরে তাকালেন দরজার দিকে। অনশু এসে দাঁড়িয়ে আছে দরজার পর্দাটা শক্ত করে ধরে। রাগিনীর কিছু হয়ে গেলে, আরো অনেক কিছু ঘটতে পারে... একটা ছোট্ট প্রশ্নে সেটাও স্পষ্ট বুঝতে পারলেন উনি। কোনো উত্তর দিলেন না, সামান্য হাসলেন। তারপর নার্সের দিকে তাকিয়ে বললেন, 'বেলা দি, উনি জল খেতে চাইলে দেবেন। কথা বলতে চাইলে বলবেন... কিন্তু কম। আর যা ইনজেকশন দিয়েছি, এমনিতেই আবার ঘুমিয়ে পড়তে পারেন। পালসটা মনিটর করুন। আর অক্সিজেন স্যাচুরেশনটা। ওগুলো আধঘন্টার মধ্যে নর্মাল না হলে নেক্সট স্টেপ্স নিতে হবে। পাশের ঘরে ওনাদের আর একজন কলিগ আছেন, আমি একবার তাকে দেখে আসছি।' কথাগুলি বলেই উনি বাইরে চলে যাচ্ছিলেন, দু-পা এগিয়ে অপ্রতিমের দিকে ফিরে বললেন, 'একেবারেই কোনো প্রশ্ন করতে যাবেন না এখন। যদি এইসব কথা বলতে গিয়ে ও একসাইটেড হয়ে পড়ে... সেটা ওর জন্য ভালো হবে না। আর আপনাদের জন্যও না।' কথাগুলো বলেই ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন ডঃ দত্ত।
     রাগিনী তখনও শূন্য দৃষ্টিতেই তাকিয়ে আছে। শ্বাস-প্রশ্বাস অনেক স্বাভাবিক আগের থেকে। ব্লান্ট ফোর্স ট্রমার জন্য কিছু একটা ঘটে গিয়ে থাকতে পারে বলে যে উদ্বেগটা সকলের ছিল, সেরকম কিছু হয়েছে বলে এখন আর মনে হচ্ছে না। মনে হচ্ছে, দুঃস্বপ্নই দেখছিল... হাসপাতালে বলেই এভাবে সবাই বেশি ভয় পেল। অপ্রতিম ওর দিকে কিছুক্ষণ চুপচাপ তাকিয়ে দাঁড়িয়ে রইল। মনে হচ্ছিল, 'দুঃস্বপ্ন দেখতেই পারে... কিন্তু স্লিপ প্যারালিসিস কি এতটা এক্সট্রিম হতে পারে? নাকি অন্য কিছু?' একবার মনে হল রাগিনীর পাশে বসে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়, নিজেই জিজ্ঞেস করে 'জল খাবে কি না, একটু উঠে বসার চেষ্টা করবে কি না।' কিন্তু তারপরেই মনে হল, ঘরে এখনো টায়রা আছে। অনশুও এসে পড়েছে। অনশুর সঙ্গে বিশেষ কথা বলতে আর ইচ্ছে করছিল না, সত্যিই কেউ এসে মেয়েটাকে নিয়ে গেলেই হয়। এর মাঝে আর বাড়তি ঝামেলা নেওয়ার মত স্নায়বিক অবস্থা নেই অপ্রতিমের। টায়রার দিকে তাকিয়ে আসতে আসতে আর কিছুটা চোখের ইশারা দিয়ে বুঝিয়ে অপ্রতিম বলল, 'তুমি একটু পাশে বসো। জিজ্ঞেস করো জল খাবে বা একটু উঠে বসার চেষ্টা করবে কি না। কিছু কষ্ট হচ্ছে কি না। ওর ভালো লাগবে।'
     টায়রা তখন রাগিনীর দিকেই তাকিয়ে ছিল। কান্নাটা একেবারেই নিয়ন্ত্রণ করে নিয়েছে, কিন্তু মুখটা থমথম করছে, চোখের পাতা ভিজে। ও অপ্রতিমের কথা শুনে রাগিনীর বেডে এসে বসল। ওর হাতটা তুলে ধরল নিজের হাতে। কানের কাছে মুখ নিয়ে এসে বলল-- 'ক্যায়সে ফিল কর রহি হো? ইজ ইট বেটার নাও?'
রাগিনী কোনো কথার উত্তর দিল না। টায়রার হাতটা নিয়ে নিজের চোখের ওপর চেপে ধরে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে একটানা কেঁদে চলল কাঁপা কাঁপা স্বরে। এমন কান্না শরীর নয়, মনের আঘাত থেকে উঠে আসে। টায়রা ওকে কাঁদতে দিল, আর কিছু জিজ্ঞেস করল না। অন্য হাতটা দিয়ে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করল, যেহেতু কিছু প্রশ্ন করতে পারছে না। আর নার্স বেলা দি, নিজের কর্তব্য মতই মনে করিয়ে দিলেন, 'পেশেন্টকে ডিস্টার্ব করবেন না, প্লিজ। ডাক্তার বাবু কিন্তু খুব রাগ করবেন!' টায়রা ওর কথাগুলোকে খুব একটা কানে তুলল বলে মনে হল না। রাগিনীর দিকে তাকিয়েই বসে রইল ওর বেড-এ। চোখের জল মুছিয়ে দিল। মাথাটা আলতো করে তুলে দু-ঢোক জল খাইয়ে দিল স্টিলের গ্লাসে করে। চোখের জল মুছোতে মুছোতে একবার অপ্রতিমের দিকে তাকাল। বড়োই অদ্ভুত এবং দৃঢ় সেই দৃষ্টি।
'অভীকরা হয়ত এখনই এসে পড়বে অপ্রতিমদা। আপনি অনশুকে নিয়ে ওয়েটিং রুমে বা করিডোরে চলে যান। এখানে আমি আছি রাগিনীর সঙ্গে। এতজন দরকার নেই।'
টায়রার কথাগুলো শুনে চমকে উঠল অপ্রতিম। মেয়েটা সরাসরি 'ইন কোম্যান্ড' এসে বাকিদের ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে বলছে। কোনো জুনিয়র কলিগ এভাবে অপ্রতিমকে কখনো বেরিয়ে যেতে বলেনি। কথার মধ্যে কোনো অনুরোধের লেশমাত্র ছিল না। সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিল। অপ্রতিম চুপচাপ সেই কথা মেনে নিয়ে অনশু নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। কোনো পাল্টা পরামর্শ দেওয়ার চেষ্টা করল না, প্রশ্নও করতে পারল না... নীরবে মেনে নিল নির্দেশ।  অপ্রতিমের মনে হল,  রাগিনির মুখ থেকে বেরনো অস্ফুট শব্দগুলো যদি কানে নাও পৌঁছে থাকে... এখন এই কান্না থেকেই টায়রা কিছু একটা আন্দাজ করে নিয়েছে। মেয়েদের একটা ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় থাকে, ওরা নিজেদের কষ্ট চিনে নেয়। অব্যক্ত হলেও।
(চলবে) 

© জয়দীপ চট্টোপাধ্যায়

পোস্টার : শাশ্বত বন্দ্যোপাধ্যায়




Comments

Popular posts from this blog

অনিন্দ্য সরকারের গুচ্ছ কবিতা : গান ছুঁয়ে ছুঁয়ে

অয়ন হালদারের পাঁচটি কবিতা

মুন্নী সেনের গুচ্ছ কবিতা : সম্বোধন