ভালো থেকো নিশীথ অবশেষ— পর্ব ১০: জয়দীপ চট্টোপাধ্যায়



ভালো থেকো নিশীথ অবশেষ— পর্ব ১০: জয়দীপ চট্টোপাধ্যায়

'একি! তুমি এখানে?'
কাউকে অপ্রত্যাশিত ভাবে, অপ্রত্যাশিত স্থানে এবং সময়ে হঠাৎ দেখতে পেলে যা হয়। ঠিক এইভাবে একটা পরিস্থিতির মুখোমুখি হওয়ার জন্য কৃষাণু একেবারেই প্রস্তুত ছিল না।
ক্লায়েন্ট ভিজিটে অন্য শহরে একাধিকবার গেছে। বিদেশী ক্লায়েন্টদের সঙ্গেও বিজনেস মিটিং-এ গেছে কোনো ডেলিভারি হেডের সঙ্গে। সব সময়ে সেসব সাক্ষাৎকারের গতি-প্রকৃতি যে খুব অনুকূল থাকে, তা নয়। কিন্তু এরকম কিছু ঘটবে... জানা থাকলে এখানে আসতই না কৃষাণু।
একটা স্বাভাবিক দিন ক্রমে কেমন অস্বাভাবিক থেকে অস্বাভাবিকতর হয়ে উঠল। হঠাৎই রোদঝলমলে দিনে যেমন দুর্যোগ ঘনিয়ে আসে। কেন যে হঠাৎ কৃষাণুর এত বছর পর মনে হল চাকরির জন্য এই অফিসে অ্যাপ্লাই করার কথা! কাউকে না জানিয়ে... কারো সঙ্গে কনসাল্ট না করে ইন্টারভিউ দিতে চলে এলো। এমন হাইকের আর অনসাইটের প্রলোভন তো নতুন নয়!
ক্যান্ডিডেটদের কেমন অস্বাভাবিক ভিড়... একটাই পদের জন্য? চেনা মুখও দেখা যাচ্ছে। সকাল থেকে এসে বসে আছে সবাই। স্ক্রিনিং আর প্রস্তুতি থাকা সত্ত্বেও ভেতর থেকে মুখোমুখি সাক্ষাৎকারের ডাক আসেনি তাদের। কেউ কেউ ফাইল দিয়ে মুখ আড়াল করছে। কৃষাণু বুঝতে পারছিল, তাকেও অনেকেই চিনতে পারছে। অস্বস্তি হচ্ছিল একটা। কোনও একটা চেয়ারে বসে থাকতে পারছিল না, ইচ্ছে করেই দূরে দূরে পালিয়ে বেড়াচ্ছিল আর ডেস্কে জিজ্ঞেস করছিল নিচু স্বরে-- আমার টার্ন আসতে কতক্ষণ? কটা ওপেন পজিশনের জন্য আজ ইন্টারভিউ... এখানে তো ওয়াক-ইনের মত ভিড় দেখছি! ডেস্কে বসে থাকা মহিলারা এমনিতেই মেপে কথা  বলে। এও ব্যাতিক্রম নয়। বিশেষ সুবিধে হল না। একটা চাপা অসন্তোষ, গুজ-গুজ ফিস-ফিস। ঠিক যেমন 'প্রতিদ্বন্দ্বী' সিনেমায় দেখেছে কৃষাণু। মনে হল একটা বড়োসড়ো সিন ক্রিয়েট হবে এখানে... আর তখনই বারান্দার দিকের দরজাটা দরাম করে শব্দ করে খুলে গেল... একটা দমকা হাওয়া ঢুকে অনেকের ফাইলের কাগজ উড়িয়ে দিয়ে এলোমেলো করে চলে গেল। হাওয়ার দাপট থামছে না... সকলে অপ্রস্তুত হয়ে, বেসামাল হয়ে, কেমন একটা কুঁচকে গিয়ে কাগজ কুড়োতে শুরু করল। একটা হাওয়ার দাপট যেন সবার আড়াল আর সাজিয়ে রাখা মেকি ব্যক্তিত্ব উড়িয়ে দেল ওই কাগজগুলোর মত। এখন সেই সব ছড়িয়ে ছিটিয়ে যাওয়া আড়াল আর রূপসজ্জা কুড়িয়ে নিচ্ছে সবাই কুণ্ঠিত হয়ে। পরচুলা খুলে গেলে, বা বাঁধানো দাঁত ফস করে মুখ থেকে বেরিয়ে এলে যেমন হয়।
কৃষাণুর  হঠাৎ খেয়াল হল ওর হাতে কোনো ফাইল নেই, সঙ্গে কোনো ব্যাগও নেই। কিছুতেই মনে করতে পারল না-- আগেই ডেস্কে জমা দিয়ে দিয়েছিল, নাকি অন্য কোথাও রেখেছে... আদৌ ফাইল সঙ্গে এনেছিল নাকি আনতেই ভুলে গেছে! ডেস্কে থাকা মহিলা ব্যস্ত হয়ে ল্যান্ডফোনে কাউকে ডেকে পাঠাচ্ছিল, দেরি হচ্ছে কেন... এখানে কী অবস্থা... সে সব নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করছিল। সেসবের মাঝে জিজ্ঞেসও করতে পারল না তাকে কৃষাণু-- যে তার নিজের ফাইলটা আদৌ তার সঙ্গে ছিল কি না, সেকথা মনে করতে উনি কোনো ভাবে সাহায্য করতে পারবেন কি না। মহিলাটি বোধহয় কোনোভাবে বুঝতে পারল ওর মনের কথা... বোধহয় নিজের অবচেতনেই  তার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল কৃষাণু।  মহিলাটি  ল্যান্ডলাইনের রিসিভারটা একহাতে চাপা দিয়ে প্রফেশনাল টোনে ইংরেজিতে বলল-- আপনি এখানে এতক্ষণ অপেক্ষা করছেন কেন? যান...  ভেতরে চলে যান?!
কৃষাণু বুঝতে পারল না যে কথাটি ওকেই বলছে কি না। ও যাচাই করার জন্য জিজ্ঞেস করল-- আমাকে বলছেন?
মহিলাটি এবার রিসিভারটা নামিয়ে রেখে কেমন বিস্ময় আর অসহিষ্ণুতা মিশ্রিত কণ্ঠে বলল-- ইয়া! ইয়োর নেম ইজ ওনলি কৃষাণু বণিক... রাইট?
কৃষাণু তার পরিচয় স্বীকার করে জিজ্ঞেস করল কোন দিকে যাবে, কোন দরজা দিয়ে প্রবেশ করবে। মেয়েটি 'ওয়ান মিনিট', বলে একটা ফোন করে কাউকে জানাল যে কৃষাণু এতক্ষণ বাইরেই অপেক্ষা করছিল, এই অনভিপ্রেত বিলম্বের জন্য সে দুঃখিত। এবং এটি তার দোষ নয়, সে জানতই না কেন এভাবে কৃষাণু বাইরে অপেক্ষা করছে। তারপর কৃষাণুকে বলল-- প্লিজ ডোন্ট স্ট্যান্ডহিয়ার... গো থ্রু দ্যাট ডোর, দে আর এক্সপেক্টিং ইউ ফর মোর দ্যান হাফ অ্যান আওয়ার। বি ফাস্ট!
এই কথাবার্তার মাঝেই কেউ এসে বারান্দার দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে চলে গেছে, থেমে গেছে সেই এলোমেলো করে দেওয়া হাওয়ার দাপট। অন্য অপেক্ষারত ক্যান্ডিডেটরা কাগজ-কুড়নো থামিয়ে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে কৃষাণু আর সেই ডেস্কের মহিলার দিকে। মনে হল অনেকেই তার শেষ কথাগুলি শুনেছে-- দে আর এক্সপেক্টিং ইউ ফর মোর দ্যান হাফ অ্যান আওয়ার।
একটা চরম দুর্নীতি, অথবা পরিচিত কারচুপি ঘটে যাচ্ছে... ঠকে গেল সবাই আবার। কিন্তু কিচ্ছু করতে পারবে না। এদের মধ্যে অনেকেই হয়ত এরকম নামী প্রতিষ্ঠানে এমন খুলে-আম কারচুপি প্রত্যাশা করেনি।
কৃষাণু তাদের সকলের দিক থেকে চোখ সরিয়ে মহিলার দেখিয়ে দেওয়া দরজার দিকে নিজের লক্ষ্য স্থির করল। এবং সেই দিকে এগিয়ে গেল দৃঢ় পদক্ষেপে, মাথা উঁচু এবং ঘাড় সোজা রাখার চেষ্টা করে। মানসিক ভাবে উপেক্ষাই করতে হয় তাদের... যারা পেছনে, যাদের ডাক আসেনি।
      দরজাটা হালকা চাপ দিতেই খুলে গেল, আর পেছন থেকে একাধিক পরিচিত কন্ঠস্বরের মৃদু আপত্তি বাড়তে বাড়তে একটা অসন্তোষের চেহারা নিয়ে নিল আবার। ওদের এইসব মন্তব্য, বলাবলি, কথার টোন-- এ সবই কৃষাণুর পরিচিত। দরজাটা বন্ধ করে দিল কৃষাণু পেছন না ফিরেই... হাত দিয়ে ঠেলে। অসন্তোষের শব্দ দরজার ওপারে চাপা পড়ে গেল। আর সামনে সৃষ্টি হল এক নতুন জগৎ-- একটাই ঘর, বড়ো বড়ো কাচের জানলা, সাদা-পর্দা দিয়ে ঢাকা। সাদা পর্দার ওপার থেকে আসে বাইরের আলোতেই ঘর আলোকিত। একটাই লম্বা কাচের টেবিল-- যেমন অফিসের মিটিং রুমে হয়। আর টেবিল ঘিরে বেশ কিছু খালি চেয়ার। সবই ফাঁকা, শুধুমাত্র একটিতে কেউ বসে, চেয়ারটা অন্যদিকে মুখ করে আছে বলে, বসে থাকা ব্যক্তির মুখ দেখা যাচ্ছে না।
চেয়ার ইতিমধ্যে কেউ বসে আছেন দেখে হঠাৎই একটা অপ্রস্তুত বোধ ফিরে এলো, নিজেকে গুছিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে কুশল বিনিময় করল কৃষাণু প্রফেশনাল কায়দায়। আর ঠিক তখনই সেই চেয়ারটা ঘুরে গেল, কৃষাণুর দিকে মুখ করে বসলেন সেই চেয়ারে বসে থাকা ব্যক্তি।
ঠোঁটের কোণে পরিচিত স্মিত হাস্য, ক্রমে বেঁকে যাচ্ছে কাস্তের মত। কোলে এক শিশু, চেয়ে আছে কৃষাণুর দিকে। ভাবলেশহীন।
'একি! তুমি এখানে?'
একটা দমকা হাওয়ায় ঘরের অন্য কোনো একটা দরজা দরাম করে খুলে গেল সশব্দে... সেই ঝোড়ো হাওয়া। কাচের কিছু পড়ে ভেঙে গেল খানখান হয়ে। কৃষাণু চমকে উঠল সেই শব্দে।

চারপাশে কেমন সব কিছু মুছে দেওয়া আলোকশূন্যতা। চারপাশের সব কিছুই কেমন আবছা, অস্পষ্ট। ধাঁধার মত। কী যেন  ঘটে গেছে-- এই কিছুক্ষণে।


---------------------------------


'কাউকে জানালেন... এখানে আসার জন্য?'
একটা অস্বাভাবিক রকম নীরবতা ছিল ঘরটার মধ্যে। অপ্রতিম আর ডঃ দত্ত দুজনে চা খাওয়ার মাঝে একেবারেই একে অপরের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করছিল না। অপ্রতিমই চাইছিল না স্পষ্টতঃ। ওর আসলে ইচ্ছে করছে না আর কথা বাড়াতে। নিজের মত করে ভেবে যাচ্ছে, কতটা কম ঝামেলায়... কম জোর খাটিয়ে, কম লোকজনের দৃষ্টি-আকর্ষণ করে-- এই পরিস্থিতি থেকে মেয়েটাকে নিয়ে বেরিয়ে যাওয়া যায়। এত রকম ডিসিশন মেকিং, কনফ্লিক্ট রিজলিউশন, আর উইন-উইন ডিসিশনের ওয়ার্কশপ করেছে, তার প্রয়োগও করেছে কখনো না কখনো-- অভ্যেস বা অনুশীলনের মত। কিন্তু এখানে এসে যে কোনো কারণেই হোক মানসিক ভাবে ক্লান্ত এবং বার্ন্ট-আউট লাগছে। কোনো না কোনো ভাবে খালি মনে হচ্ছে-- একটা দায় এসে পড়ছে ঘাড়ে। যা কিছু খারাপ ঘটবে এর পর বা  ঘটতে পারে, তার দায়।
প্রত্যুষের সঙ্গে রাগিনীর নাম জড়াবেই। আর জিজ্ঞাসাবাদ হবেই দুজনকে নিয়ে, দুজনকেই জেরার মুখে পড়তে হবে বার বার... অস্বস্তিকর প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে।
অনেক কিছুই চাপা থাকবে না আর।
অপ্রতিম স্পষ্টই জানিয়ে দিতে পারে, ও সেই সময়ে ছিল না রেসর্টে। সিকিওরিটি গার্ড সাক্ষী। টায়রাও। কিন্তু টায়রাকে এসবের মাঝে না আনাই ভালো, যদি খুব দরকার না হয়।
আর বাকি রা? কেউই কি ছিল না ওই ঘরের কাছাকাছি? কেউই কি আসলে দেখেনি বা জানে না... যে কী ঘটে ছিল ওখানে ওই সময়ে?
ঘটনা পুলিশি তদন্তের দিকে গেলে রেসর্টের কর্মী এবং প্রায় সব অতিথিদেরই কমবেশি পুলিশের প্রশ্ন সামলাতে হবে। তবে সব থেকে বেশি জড়াবে রাগিনীর সহকর্মীদের নাম, সব থেকে বেশি টানাটানি হবে একটি অফিসের কিছু কর্মীকে নিয়েই।
ফ্লো ডায়াগ্রামের মত ওর্স্ট কেস সিনারিওতে অপ্রতিম কীভাবে নিজে বেরিয়ে যেতে পারে আনটাচড-- সেগুলিও মাথায় চলে এলো একসময়ে।
যা করেছে, কোনোটাই আইনের চোখে অপরাধ নয়... শুধু পুলিশে খবর দিতে হলে... দেরিটা জাস্টিফাই করতে হবে। এই দেরির জন্য আর কতই বা...
ঘড়িতে এখন রাত পৌনে দুটো, আর কয়েক ঘন্টা পরেই আকাশের আলো ফুটে যাবে... কিছু একটা সিদ্ধান্ত নিতেই হবে তার মধ্যে। নাকি... দিনের বেলাই যা হওয়ার হোক... যেমন ভাবে এই ঘটনার পরবর্তী ধাপে যাওয়ার কথা... পুলিশ, বাড়ির লোক, অফিসের এইচ আর, এই ঘটনার জন্য অফিসে আলাদা করে মানবাধিকার বোর্ড... এমপ্লয়ী সেফটি দপ্তরের জেরা...

- কাউকে জানালেন... এখানে আসার জন্য?
- ভাবছি।
- এখনো ভাবছেন? পেশেন্টের মেডিকাল রিপোর্ট কিন্তু আপনাদের জন্য একেবারেই সুবিধের হবে না।
- ঘড়িতে কটা বাজে দেখেছেন? রিসর্টে যারা আছে তাদের কেউই এখন এলে বাড়তি কিছু সুবিধে হবে না। আর ওর গার্জেনরা অন্য রাজ্যে থাকেন, কাল সকালে ইনফর্ম করলেও আসতে সময় লাগবে।
-
- কে তাড়াতাড়ি আসতে পারবে, কলকাতা থেকে আসার মত কেউ আছে কি না... সেটাও তো জানার। এই সময়ে ওঁদের ফোন করে কী বলব?! এই খবর দেব?
- যাক... এটা যে নর্মাল কিছু না, এটা অন্ততঃ মনে মনে আপনিও বুঝেছেন। আমার সামনে এগ্রি করতে হবে না... মনে মনে বুঝলেই এনাফ।
-
- আমি আপনার, আপনাদের কারো বিরক্তির পাত্র হতে চাই না। আসলে আমার এত কথা বলতেও ইচ্ছে করছে না। এই নিয়ে আর কিছু বলবও না...
-
- কাল সকাল আটটা থেকেই অন্য স্টাফরা আসবে, ম্যানেজমেন্টের লোকজন আসবে কেউ না কেউ। অন্য ডক্টররা আসবেন... আমার দায় বা দায়িত্ব-- এই রাতটুকুই। কেউ এলেই হ্যান্ডওভার দিয়ে চলে যাব।
-
- আপনাকে একটাই রিকোয়েস্ট-- ব্যাপারটা ধামাচাপা দেওয়ার ভুল করবেন না। আরো বড়ো ক্ষতি হতে পারে, আমার অভিজ্ঞতা অন্ততঃ তাই বলে...
- ধামা-চাপা?
- কেউ স্বীকার করে না। সবাই মরালি কারেক্ট থাকতে চায়। সেলফ রাইটিয়াস...
- তাহলে এখানে এত রাতে নিয়ে আসতাম?
- সেন্স ফিরে এলে, বা নিজে উঠে বসলে আনতেন?
-
- ছোটো নার্সিংহোম, কিন্তু আগে অন্য হাসপাতালেও থেকেছি... অনেক রকম কেস দেখতে হয়। বিশেষ করে রাতের দিকে... কত রকম যে পেশেন্ট নিয়ে আসা হয়, তাদের সঙ্গে লোকজন যে কতরকম।
-
- আমার আর সেলফ রাইটিয়াস থাকার দায়টাও নেই। আমার কথাই শেষ কথা, তাও তো না।
- হুম, এখানে ম্যানেজমেন্টের কেউ থাকলে হয়ত এতটা সমস্যা হত না, একটা নেগোশিয়েশন হয়ে যেত।
- কাল সকালে এসে যাবে। আমি চলে যাব হ্যান্ডশেক করে... যে আসবেন, তিনি বুঝবেন লেটারপ্যাডে কী লিখে ডিসচার্জ করবেন।
- সবই জানেন, অথচ আমাদের জন্য একটা গোটা রাত কমপ্লিকেশন ক্রিয়েট করলেন।
- কারণ আমার লিখে দেওয়া কিছুর ভিত্তিতে একজন ডেফিনিট ভিক্টিমের ফিউচার ডিপেন্ড করবে... এটা আমি হতে দেব না। এই না হতে দেওয়াটা এখনও আমার হাতে। আই উড এক্সসাইজ দ্যাট, অ্যাস লং অ্যাস আই ক্যান।
- অদ্ভুত কঠিন! হাঃ!
-
- কিছু মনে করবেন না, আপনি এত কথায় গেলেন বলেই বলছি। পারসন টু পারসন। কিছু মানুষ এক রকম ভেবে একটি জীবিকায় আসে, বিশেষ করে পাবলিক-সার্ভিং প্রফেশনগুলিতে। অনেক রকম হাই থটস অ্যান্ড ইমপ্রেশনস থাকে। এক্সপেক্টেশনসও। তারপর দেখে এখানেও সেই একই ব্যাপার। তার কথায় কিছুই হয় না, হবেও না। অন্য কেউ অন্য লেভেলে সেটল করে দেবে।
- আপনার পয়েন্টটা ঠিক কী?
- হাঃ! পয়েন্টটা আপনি ঠিকই বুঝতে পারছেন। অ্যান্ড ইট ইজ অলরেডি হার্টিং ইয়ু।
-
- আপনিও তাদের মতই একজন। এর পরে কীভাবে কী হতে পারে অনেকটাই জানেন, কিন্তু এই মুহূর্তে ... এই কয়েক ঘন্টা-- আপনিই অথোরিটি। আপনার মোমেন্ট অফ গ্লোরি। আপনার জায়গায় আমি হলেও এটা ছাড়তাম না।
- এগুলো ভেবে আপনার হালকা লাগতে পারে... কিছুটা ঠিকও, হয়ত। বাট প্লিজ কনসিডার মাই ওয়ার্ডস-- ভিক্টিমের কিন্তু আরো বড়ো ক্ষতি হতে পারে... বেটার মেডিকাল অ্যাটেনশন, অ্যান্ড দ্য ট্রুথ মাস্ট বি রিভিলড। ও হয়ত অনেক কিছুই বলতে চাইবে না, জ্ঞান ফেরার পরেও।
-মানে?
- মাথার পেছনের আঘাত ছাড়াও অনেক কিছু আছে অপ্রতিম বাবু । ওর সঙ্গে কিছু ঘটেছে, অস্বাভাবিক কিছু। যদিও শরীরে আর তেমন আঘাতের চিহ্ন নেই... কেউ যে ব্রুটালি ফোর্স করেছে নিজেকে-- এমনও না। বাট স্টিল...
- আপনি কি স্টেটমেন্ট দেবেন?
- হুম?
- দেবেন? স্টেটমেন্ট?
- আপনার সঙ্গে... আপনাদের সঙ্গে আমার কোনো শত্রুতা নেই অপ্রতিম বাবু।
- দেন?
- ম্যানেজমেন্ট বা পুলিশ-- জিজ্ঞেস করলে কিছু তো বলতে হবে।
- আপনি যদি একটু সামলে...
- সামলে? ড্রাগ করে রেপ করে থাকার সম্ভাবনা আছে... সিমেন টেস্ট করলে একাধিক ব্যক্তির ডিএনএ-ও আসতে পারে... ইউ ডোন্ট ওয়ান্ট টু অ্যাকনলেজ দ্য গ্রেভনেস অফ সিচুয়েশন... ডু ইয়ু?
- অথচ আপনার ম্যানেজমেন্ট কিছু মিডল-পাথ নিয়ে ব্যাপারটা কাল সকালেই সামলে নেবে। রেসর্ট-হাসপাতাল-পুলিশ এমনকি আমাদের অফিসেরও হয়ত কেউ...
- যা আমার হাতে নয়...
- আপনার ওপরেও তো এর নেগেটিভ প্রভাব পড়তে পারে?
- যদি এগেন্সট দ্য অডস স্ট্যান্ড নিই... পারে।
- নেবেন?

ডাঃ শায়ক দত্ত কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলেন সোজা হয়ে বসে... কিন্তু তার আগেই বাইরে থেকে নার্স এসে বলল 'এমার্জেন্সিতে একবার আসুন স্যার। পেশেন্টের ঘুমের মধ্যে মাঝে মাঝে খিঁচুনির মত হচ্ছে।'
ডাঃ দত্ত সঙ্গে সঙ্গে চেয়ার ছেড়ে উঠে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। অপ্রতিমের দিকে ফিরেও তাকালেন না। অপ্রতিমও খবরটা শুনেই দ্রুত চেয়ার ছেড়ে উঠে এমার্জেন্সি রুমের দিকে যাওয়ার জন্য এগলো। ঘরে থেকে বেরিয়ে করিডোরে দেখল টায়রা আর অনশু দাঁড়িয়ে-- দুজনেরই চোখে স্পষ্ট উদ্বেগ, তবে তার মাত্রা আলাদা। অনশু কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল... অপ্রতিম তার আগেই ওদের দুজনকে বলল--  'ডোন্ট প্যানিক। যদি সিরিয়াস হয়, উই উড চেক আউট ফ্রম হিয়ার ইমিডিয়েটলি অ্যান্ড টেক হার টু দ্য টাউন।'
কিন্তু অনশুর ওপর এসব কথার বিশেষ প্রভাব পড়ল না। ও নিজেকে একটু দূরে সরিয়ে নিয়ে বলল-- 'আই নীড টু লীভ নাও অপ্রতিম দা। আই লাভ রাগিনী... আই অ্যাম কনসার্ন্ড আবাউট হার। আই অ্যাম কনসার্নড আবাউট অল অফ ইউ ইন দিস সিচুয়েশন। বাট... আই নীড টু লিভ... রাইট নাও... আই অ্যাম নট গোইং টু বি আ পার্ট অফ এনি অফ দিস। এনি অফ দিস!... সরি!' উত্তেজনায় ওর গলা কাঁপছিল, চোখ ছল ছল করছিল। 
কথাগুলো বলতে বলতেই ও দ্রুত পায় গেটের দিকে এগিয়ে গেল। যেন এখান থেকে বেরিয়ে ও নিজেই এই অন্ধকারে, অচেনা জায়গায়-- একা ফেরার ব্যবস্থা করে নিতে পারবে। ওকে দেখেই বোঝা যাচ্ছিল, এই স্ট্রেস ও আর নিতে পারছে না... র‍্যাশনালিটি কাজ করছে না ওর মধ্যে। মরিয়া হয়ে এইসব কিছু থেকে পালাতে চাইছে এই মুহূর্তে। ও সেই মুহূর্তে নার্সিংহোমের গেটের দিকে এগিয়ে গেল, তারপর কিছুক্ষণ থেমেই আবার দ্রুত ফিরে এলো কিছু একটা মনে করে। ওর এভাবে যাওয়া আসায় নার্সিং হোমের সিকিওরিটি গার্ডও সচেতন হয়ে গেটের কাছে এসে দাঁড়াল ভেতরে কী ঘটছে  নজর রাখার জন্য। সেই নিত্য নামের ভদ্রলোকও ডেস্ক থেকে মাথা তুলে উঠে বসলেন। চোখ কচলে বোঝার চেষ্টা করলেন ঠিক কী ঘটছে। বাইরের মেয়ে, অন্যরকম সাজ-পোশাক-- এভাবে একবার যাচ্ছে, একবার আসছে। খুবই অদ্ভুত কিছু ঘটে চলেছে এই হাসপাতালে আজ রাতে, এটা উনি ভালোই বুঝতে পারছেন।
অপ্রতিম আর টায়রার কাছে ফিরে এসে অনশু নিজেকে মনে মনে কিছুটা প্রস্তুত করল দু সেকন্ডের জন্য, তারপর একটা নিঃশ্বাস নিয়ে বলল-- 'অল রাইট, আই নো আই অ্যাম ডিপেন্ডিং অন ইয়ু পিপল হিয়ার। আই ডোন্ট নো দিস প্লেস। সো আই অ্যাম বেগিং ইউ... অপ্রতিমদা, উস আদমি কো বোলিয়ে-- টু ড্রপ মি অ্যাট দ্য নিয়ারেস্ট বাস স্টপ অর স্টেশন। ফ্রম দেয়ার, আই ক্যান টেক কেয়ার অফ মাইসেল্ফ। নাও কুড ইউ প্লিজ রিকোয়েস্ট হিম... প্লিজ?'
অপ্রতিম অনশুর এই ব্রেকডাউন দেখে মনে মনে বলল, 'পালাতে আমরা অনেকেই চাই... কিন্তু পারি কী?'
ওকে স্পষ্ট করে হ্যাঁ বা না কিংবা ওকে আটকানোর জন্য গুছিয়ে কিছু বলার আগেই অপ্রতিম দেখল নার্সিংহোমের অন্য দুজন ওদের দিকেই তাকিয়ে আছে। ওরা বুঝতে পেরেছে-- একটা গোলমাল বেঁধেছে এদের মধ্যে। যেটা হয়ত বলতে যাচ্ছিল, সেটা না বলে বলল-- 'আর ইউ আউট অফ ইয়োর মাইন্ড? তুমহে পতা ভি হ্যায় ইয়াহাঁ সে ক্যায়সে ওয়াপাস যানা হ্যায়? ইভন আই ডোন্ট নো দিস প্লেস!'
- ওহ কাম অন অপ্রতিমদা... আই নো হাউ টো ফাইন্ড আ রুট ওভার ম্যাপ। আই হ্যাভ ইভন চেকড, নিয়ারেস্ট স্টেশন ইজ জাস্ট ফিউ কিলোমিটার্স অ্যাওয়ে।
- অ্যান্ড হোয়াট ইফ সামথিং হ্যাপেনস টু ইয়ু। কৌন যা রহা হ্যায় তুমহারে সাথ?
- ক্যায়া হোগা মুঝে! আই হ্যাভ ট্র্যাভেলড টু সো মেনি প্লেসেস অ্যালোন! অ্যান্ড ইন ফিউ আওয়ারস ইট উড বি ডন রাইট?
- লুক, আই অ্যাম স্টিল টেলিং ইয়ু... ইফ ইয়ু আর ফ্রিকিং আউট বিকজ অফ...
- বস হো গয়া অপ্রতিম দা... নাও আই জাস্ট ওয়ানা লীভ। দ্যাটস অল। প্লিজ ডোন্ট মেক দিস বিগ নাও...

' আধা ঘন্টে কে লিয়ে রুক যা... ভিভান ইজ কামিং, চলি যা না উসকে সাথ।' ... অনশুর কথার মাঝেই বলে উঠল কথাগুলো টায়রা। 

দুজনে কথা থামিয়ে তাকিয়ে রইল ওর দিকে। ততক্ষণে নিত্য বাবু  চেয়ার ছেড়ে ওদের কাছাকাছি এসে দাঁড়িয়েছেন। কী ঘটেছে শোনার চেষ্টা করছে্ন। অপ্রতিম এমনিতেই অনশুর মতিগতি দেখে উত্তেজিত হয়ে পড়েছিল, এর মাঝে টায়রার কথা শুনে গলা এক ধাপ চড়িয়েই ওকে বলে ফেলল 'সিরিয়ালি? আর ইয়ু অল ফ্রিকিং আউট অফ ইয়োর মাইন্ডস?'
টায়রা অপ্রতিমকে না জানিয়েই ওদের আসতে বলেছে। ওরা এসেও পড়বে কিছুক্ষণের মধ্যে... বাইকে আসার কথা। অপ্রতিমের সঙ্গে কোনোরকমে তর্কে জড়ানোর কোনো ইচ্ছেই ওর ছিল না তখন। ঠান্ডা মাথায় বলল 'আপনাকে জিজ্ঞেস করা উচিৎ ছিল। মানছি। কিন্তু অনশুর অবস্থা দেখে আমার মনে হল... শি কান্ট টেক দিস এনিমোর... ওয়ান্টস টু লীভ।'
- আর ওখানে? ওখানে মেয়েগুলোকে কে দেখবে? প্রত্যুষের সঙ্গে কে থাকবে?
- ওখানে আরো কিছু ছেলে আছে অপ্রতিম দা। শুধু ভিভান আর অভীক আসছে।
- অভীকও আসছে?
- আই ডিডন্ট আস্ক হিম টু কাম। ও নিজেই আসছে।
- চমৎকার!
- আপনি আমার ওপর কেন রাগ করছেন জানি না। আমার মনে হয়েছে, এখানে কিছু লোক দরকার... আর এখন তো...

টায়রার কথা শেষ হওয়ার আগেই এমার্জেন্সি রুমের দিক থেকে ডাঃ দত্তের গলার আওয়াজ ভেসে এলো-- 'অপ্রতিম বাবু... একটু আসবেন প্লিজ? উই হ্যাভ আ সিচুয়েশন হিয়ার!'
ওরা সকলেই একসঙ্গে ডাঃ শায়ক দত্তের গলার আওয়াজ পেয়ে তার দিকে তাকাল। কথা থামিয়ে সেই দিকেই ছুটে গেল অপ্রতিম। অপ্রতিমের পেছন পেছন টায়রা।
শুধু অনশু একা দাঁড়িয়ে রইল ওখানে... ওদের চলে যাওয়ার দিকে।
নিত্যবাবু সিকিওরিটি গার্ডকে ডেকে বললেন -- এই, তুমি ম্যাডামের সঙ্গে সঙ্গে থাকো। তারপর ছুটে গেলেন এমার্জেন্সি রুমের দিকে। 


কৃষাণুর শুধু মনে হল একটা ঝাপসা অন্ধকার ঘরে পড়ে আছে একা। একটা সাদা-পর্দায় ঢাকা মিটিং রুম কেমন হঠাৎ অন্ধকার হয়ে গেল। বাইরের চাপা অশান্তিটা ইন্টারভিউ দিতে আসা ক্যান্ডিডেটদের না অন্য কেউ... বুঝতে পারল না। মানসিক যন্ত্রণাগুলো সকলে একসঙ্গে মাথার ভেতর জোট বেঁধেছে। 

এবারও কথা হল না। কিছুই জিজ্ঞাসা করতে পারল না ওকে। অন্ধকারে পড়ে আছে কৃষাণু। বাইরে কারা ছড়িয়ে ছিটিয়ে যাওয়া প্রশ্ন-উত্তর কুড়িয়ে নিচ্ছে অপ্রস্তুত ভাবে। 

অতসীকে ওভাবে দেখবে হঠাৎ-- একেবারেই আশা করেনি কৃষাণু। 

© জয়দীপ চট্টোপাধ্যায়
অঙ্কন : ঋতুপর্ণা খাটুয়া 

Comments

Popular posts from this blog

অনিন্দ্য সরকারের গুচ্ছ কবিতা : গান ছুঁয়ে ছুঁয়ে

অয়ন হালদারের পাঁচটি কবিতা

মুন্নী সেনের গুচ্ছ কবিতা : সম্বোধন