সুন্দরবন কথা: প্রবন্ধ ২ — আঠারো ভাটির নাও


আঠারো ভাটির নাও

সময়ের বিবর্তনে আধুনিক যান্ত্রিক সভ্যতার ছোঁয়ায় বিলুপ্তির পথে আবহমান গ্রামবাংলার লোকসংস্কৃতি। হারিয়ে যাচ্ছে আঠারোভাটির নৌকা। হাতেগোনা দু'একটা চোখে পড়লেও জৌলুস কমেছে অনেকটাই। একসময় এই নৌকাকে কেন্দ্র করে কবি-সাহিত্যিকরা রচনা করেছিলেন কত গান, ছড়া, কবিতা, গল্প, পালা! কত সংসার ছিন্নভিন্ন হয়েছে নদীতে, নৌকায় নৌকায়। 

"কে যাস রে ভাটি গাঙ বাইয়া
আমার ভাইধন রে কইয়ো, নাইওর নিতো বইলা
তোরা কে যাস কে যাস

বছর খানি ঘুইরা গেল, গেল রে
ভাইয়ের দেখা পাইলাম না, পাইলাম না

কইলজা আমার পুইড়া গেল, গেল রে
ভাইয়ের দেখা পাইলাম না, পাইলাম না"
(মীরা দেব বর্মন)

এখন তার খোঁজ রাখে ক'জন? ডিজেল চালিত স্যালো নৌকার ভিড়ে হারিয়ে যাচ্ছে সব। কদর নেই মাঝি-মাল্লাদেরও। বিলুপ্তির পথে নৌবাইচ - নৌবাইচের শ্লোক: 

"আটির গাঙে ভাটি চলে।
সোঁদরবনে নৌকা চলে।।
নৌকা চলে হাতের জোরে - 
দরিয়ার পাঁচ পীর বদর বদর।।"

কয়েকবছর আগেও মাছ ধরার ছোট নৌকা দাঁড়ে চলত। বর্তমান সময়ে সেটিও ইঞ্জিনচালিত। ইঞ্জিনের দৌরাত্ম্যে ক্রমান্বয়ে রোজগার কমেছে অনেক মাঝির। পরে পরে অন্য পেশায় নিযুক্ত হচ্ছেন তাঁরা।

সুন্দরবনের জনপদে নদী ও খাল চলাচলের জন্য সৃষ্টি হয়েছিল নৌকার। যদিও সর্বপ্রথম নৌকার সৃষ্টি হয় অস্ট্রেলিয়ায় (বিতর্কিত)। নিম্নে সুন্দরবনের কয়েকটি ঐতিহ্যবাহী নৌকার বিবরণ করা হল :


ক. টাপুরে নাও 

টাপুরে নাও হল ছোট নৌকা। ঊনিশ শতকের প্রথমদিকে বাংলায় এই নৌকার প্রচলন ছিল। নিম্নবিত্তের মানুষেরা বিবাহ অনুষ্ঠানে এই নৌকার ব্যবহার করতো। সুন্দরবনের প্রত্যন্ত অঞ্চলে এখনও এই নৌকার দেখা মেলে। 

খ. পালতোলা পানসি নৌকা

জমিদার আমলে পানসি নৌকার প্রচলন ছিল সর্বত্র। জমিদাররা পালতোলা পানসি নৌকায় ভ্রমনের উদ্দেশ্যে নৌ বিলাসে বের হতেন।

"দে দে পাল তুলে দে
মাঝি হেলা করিস না, 
ছেড়ে দে নৌকা আমি যাবো মদিনা"
(আবদুর রহমান বয়াতী)

সম্রাট আকবরের আমলে পালতোলা পানসি নৌকায় জমিদাররা বিভিন্ন দেশ থেকে এ দেশে বানিজ্য করতে আসতেন। যদিও এই নৌকা হারিয়ে গেছে প্রায় ২০০-২৫০ বছর পূর্বে।

গ. ডিঙ্গি নৌকা 

ডিঙ্গি হল সবচেয়ে পরিচিত নৌকা। এই নৌকা নদী পারাপার, মাছ ধরা, অন্যান্য কাজে ব্যবহার করতেন হাওড়-বাঁওড়েরা। এখনো এই নৌকার প্রচলন রয়েছে।

ঘ. ঘাষী নৌকা

ভারী ও বেশি পরিমাণ পণ্য পরিবহনের জন্য অতীতে এই নৌকা ব্যবহার হতো। তবে এই নৌকা এখন সম্পূর্ণ ভাবে হারিয়ে গেছে।

ঙ. বাইচের নৌকা

নৌকা বাইচ হল সুন্দরবনের অন্যতম জনপ্রিয় খেলা। মূলত বর্ষাকালে এই খেলা হয়। লম্বায় এই নৌকা অনেকটাই বড়। প্রায় ১৫০-২০০ ফুট। অনেক আগেই বিলুপ্ত হয়েছে এই নৌকা।

চ. ডোঙা নৌকা

তালগাছের কান্ড দিয়ে এই নৌকা তৈরি হতো। এটি তালের নাও-কোন্দা নামেও পরিচিত। ভাটার সময় নৌকা চরে আটকে গেলে, ডোঙার মাধ্যমে লোকে ঘাটে এসে পৌঁছাতো।

ছ. ভেলা

নৌকার সরলতম রূপ হল ভেলা। ছোট নদী, খাল পারাপারের জন্য ভেলার ব্যাবহার হতো। একসময় সাপে কাটা মৃত মানুষকে কলাগাছের ভেলায় ভাসিয়ে দেওয়া হতো

নৌকা শুধুমাত্র পরিবহনের মাধ্যম নয়। নৌকা হল সম্প্রীতির ধারা। মাঝি-মাল্লর গানে নৌকায় একত্রিত হয় রাম রহিম। জাতি-ধর্ম -বর্নের বিভেদ সরিয়ে আত্মার মিলন ঘটে। তাইতো সলিল চৌধুরী লিখেছিলেন - 

"হেইও রে মার জোর হে আল্লাহ হে রামা।"


তথ্যসূত্র:

ক. বাংলাদেশ জার্নাল: নৌকা
খ. উইকিপিডিয়া: নৌকা
গ. আঠারোভাটির ইতিকথা (আবাদ পর্ব) : ড. স্বপন কুমার মন্ডল
ঘ. নিজস্ব সমীক্ষা।

© সুরজিৎ বেরা
অঙ্কন : ঋতুপর্ণা খাটুয়া

Comments

Popular posts from this blog

অনিন্দ্য সরকারের গুচ্ছ কবিতা : গান ছুঁয়ে ছুঁয়ে

অয়ন হালদারের পাঁচটি কবিতা

মুন্নী সেনের গুচ্ছ কবিতা : সম্বোধন