ভালো থেকো নিশীথ অবশেষ — ৮ ম পর্ব : জয়দীপ চট্টোপাধ্যায়



অপ্রতিম বা কৃষাণু,  কেউই  বুঝতে পারছিল না-- এই ডাক্তার আসলে কোনোভাবে হালকা চাপ দিয়ে ব্যাপারটা মিটিয়ে নিতে ডেকেছে, না ক্রমশ ময়াল সাপের মত পেঁচিয়ে যাচ্ছে ওদের। কোনোভাবে কায়দা করে একটা সেটলমেন্টের দিকে এগোবে না বড়ো বিপদ তৈরি করবে। সত্যিই কথার মধ্যে অসঙ্গতি এসে যাচ্ছে… মনে হচ্ছে বলে দেয় ‘এইসব কিচ্ছু না, আসল ঘটানাটা এইরকম।’ কিন্তু এখন একবার ভার্শান চেঞ্জ করা মানে স্পষ্ট করে দেওয়া যে আরো কিছু ঘটে থাকতে পারে, যা গোপন করা হচ্ছে। চাপের মুখে এমন আরো ভার্শন বেরোবে সময়ের সঙ্গে। এক একজন এক একরকম তথ্য দেবে। আরো অসঙ্গতি ধরা পড়বে, আরো রহস্যময় হয়ে উঠবে ব্যাপারটা। বিশেষ করে, যেখানে পেশেন্ট নিজেই ঠিক করে  নিজের কথাটা বলতে পারছে না এখনো।
       ডঃ সায়ক দত্ত এই দুজনের চুপ থাকাটা যেন মনে মনে উপভোগ করছেন। ‘কমন ম্যানস মোমেন্ট অফ গ্লোরি’। দু সেকন্ড, পাঁচ সেকন্ড, দশ সেকন্ড– নীরবতার দীর্ঘায়িত হওয়ার মধ্যে একটা স্যাডিস্টিক আনন্দ থাকে, যখন প্রতিপক্ষর পালানোর পথ থাকে না, সাজিয়ে উপস্থাপন করার মত যুক্তি ফুরিয়ে যায়।  অপ্রতিম আরো একবার নিজেকে ভেতর ভেতর গুছিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করল। ঠান্ডা মাথায় যতটা সামলানো যায়। এখন এই নার্সিংহোমের পরিস্থিতিটা যতটা সম্ভব কনফ্লিক্টমুক্ত রাখা যাক, তার পর একসময়ে নিরুপায় হলে  নিজের নিজের মত পরিচিতি ব্যবহার করতে হবে। একটু লোক  জানাজানি হবে। ম্যানেজমেন্টের কথা শুনতে হবে। কিন্তু ক্রাইসিস হাতের বাইরে গেলে ওগুলো মেনে নিতেই হবে। যে স্তরে যে ওষুধ কাজে দেয়। একটা সামান্য নার্সিং হোমের ডাক্তার এভাবে বসে বসে মাইন্ডগেম খেলে যেতে পারে না… শুধু পরিস্থিতি অনুকূল নয় বলে সহ্য করতে হচ্ছে। অপ্রতিম কিছু বলার আগেই আবার একবার মেজাজ হারানো স্বরে কৃষাণু বলে ফেলল– ‘একটা অল্পবয়সী ছেলেমেয়েদের নাইট আউট… কত কী হয়… কেউ একটু বেশি নেশা করে ফেলেছে, তাই… এতটা জলঘোলা করার কি সত্যিই দরকার আছে? বেশি বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে না?’ ডাক্তার দত্ত ওর দিকে তাকিয়ে শুধু একবার দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন ‘ওয়েল’, তারপর চেয়ার ছেড়ে ওঠার উদ্যোগ নিলেন। ‘তাহলে এরপর আর কোনো কথার অবকাশও বাকি থাকে না’– স্পষ্ট ইঙ্গিত তাঁর শরীরী ভাষায়। অপ্রতিমও সঙ্গে সঙ্গে চেয়ার ছেড়ে উঠে ওঁকে আবার বসানোর মতই রেজিস্ট করার ভঙ্গি করে বলল– ‘আমরা সকলেই ভীষণ রকম স্ট্রেসড আউট। ভেবেছিলাম এখানে ওকে ফার্স্ট-এইড বা ইনিশিয়াল চেকআপ করিয়ে সেই মত সদরে বা কলকাতার হাসপাতালে চলে যাব সকালে… বাট, অনেস্টলি স্পিকিং… আমিও বুঝতে পারছি না আপনি এতটা হসটাইল কেন হয়ে উঠছেন। এভরিওয়ান ইজ এনটাইটেলড টু দেয়ার রিজন্স… উই রেসপেক্ট দ্যাট। কিন্তু আমরা তো বলছি… আমরা এত জন ছিলাম ওখানে। কোনো রকম ফাউল প্লে সাসপেক্ট করা ভ্যালিড না এ ক্ষেত্রে।’
- আমি শুধু যা যা দেখলাম, তাই জানাচ্ছি আপনাদের অপ্রতিম বাবু। আমার স্বাভাবিক লাগছে না।
- হ্যাঁ, অস্বাভাবিক লাগাটাই স্বাভাবিক। ও সত্যিই নেশাটা বেশি করে ফেলেছে… হয়ত গাঁজা বা সেরকম কিছু, বা একাধিক রকমের… মানে ওই ককটেল এফেক্ট হলে যা হয়…
- আপনারা… মানে আপনি আর উনি… এতটা শিওর হয়ে বলছেন… অথচ আপনারা দুজনে কেউই ছিলেন না ওখানে। এসে দেখেছেন…
- আরে কেউ তো ছিল। ও তো একা ছিল না। আপনি পুলিশী জেরা কেন করছেন?
- ঠিক… জেরাটা পুলিশ করলেই ভালো।
- মানে, আপনি কোঅপরারেট করবেন না। ফাইন, আমাদের আটকানোরও তো কোনো অথোরিটি নেই আপনার। রিসর্টে ফিরে যাচ্ছি আমরা… এমনিতেও আমার মনে হচ্ছে ও এখন বেটারই আছে…
- বেটার? ও নিজের নামটাও নিজে বলতে পারেনি… সঙ্গে যারা এসেছে, তাদেরও আইডেন্টিফাই করেনি। আপনি বলছেন বেটার?
- ঠিক আছে, আপনি তো ডিটেইলস নোট করেই নিয়েছেন রেজিস্টারে… আমরা ওকে নিয়ে যাই, ওর রেস্ট দরকার।
- ভুল করছেন অপ্রতিম বাবু। আপনি ভাবছেন আপনাদের প্যাঁচে ফেলছে একটা জুনিয়র ডাক্তার।
- সেটা কি খুব একটা ভুল?
- মেয়েটির ব্লাড টেস্ট করলেই কোনো না কোনো ইনটক্সিকেটিং এলিমেন্ট পাওয়া যাবে, অফকোর্স সামথিং আদার দ্যান অ্যালকোহল। মেয়েটি স্বাভাবিক হলেই ওর হয়ত ট্রমার কথা মনে পড়ে যাবে… নট নেসেসারি যে ও আপনাদের শেখানো কথাগুলোই বলবে…
- ওহ কামন ডক… ইউ আর প্লেইং বেয়ন্ড…
- ওকে চেকআপ করতে গিয়ে ওর থাইয়ের কাছে ব্রুজড ইঞ্জিওরি দেখেছি, চামড়া ছড়ে গেছে। যে দাগ শুকিয়ে আছে, স্যাম্পল টেস্ট করলেই প্রমাণিত হবে সিমেন ট্রেসেস…
- আর ইয়ু রিয়েল?!
- ইনটক্সিকেট করে রেপ করার সব রকম ইঙ্গিত স্পষ্ট।
- আপনি ঠিক কী চাইছেন? পুলিশে অভিযোগ করার হলে তো এতক্ষণে করেই দিতে পারেন… সবই যখন জেনে বসে আছেন।
- কী চাইছি?…  ওয়েল! আমি চাইছি ও এখানেই… আমাদের চোখের সামনে থাকুক। আপনাদের সঙ্গে যেতে দেব না। ওর বাড়ির লোককে খবর দিন, এসে নিয়ে যাক। ওন্ট লেট হার গো উইথ ইয়ু পিপল… নট ইন দিস কন্ডিশন।
অপ্রতিম বুঝতে পারল, ব্যাপারটা একেবারেই অন্যদিকে চলে গেছে। এখন মনে হচ্ছে এভাবে সাত-পাঁচ না ভেবে নার্সিং হোমে আসাই ভুল হল। এর চেয়ে সদরের হাসপাতালে গেলে হয়ত এত নজরই দিত না। নেশা করে বেসালামাল হয়ে গেছে বলে ভর্তি করত, বাড়ির লোককে জানাত… বাকিটা ওরা বুঝে নিত। কৃষাণু দুহাতে দিয়ে কপালটা চেপে ধরে, টেবিলে কনুই ভর করে বসে রইল। মুখ তুলে তাকাল না কারো দিকে। অপ্রতিম একেবারেই বিষয়টা ঘুরিয়ে দিয়ে বলল – ‘আচ্ছা, আপনাদের এখানে কি কোনো একস্ট্রা রুম আছে, গেস্ট বা পেশেন্ট পার্টিদের রাতে থাকার জন্য? যা বুঝছি… এখনো অনেকক্ষণের ব্যাপার। সঙ্গে যিনি আছেন,  গাড়িতে শুয়ে পড়বেন… কৃষাণুর শরীরটা একটু খারাপ, ও যদি একটু ঠিক মত রেস্ট নিতে পারত কিছুক্ষণ…’
হঠাৎ এই বিষয় পরিবর্তনটা বোধহয় ডাক্তার দত্তও প্রত্যাশা করেননি। প্রথমতঃ ব্যাপারটা বুঝতে না পেরে বললেন ‘কী? এনারও শরীর খারাপ?’
কৃষাণু সঙ্গে সঙ্গে হাত তুলে বলতে গেল ‘না না… আ-আমার তেমন কিছু…’
কিন্তু কথাটা শেষ করার আগেই টেবিলের ওপর মাথা এলিয়ে পড়ে গেল ঝপ করে।

_________


মধ্যমানের হসপিটাল নার্সিংহোমের ভেতরের এই ফ্লোর ক্লিনার আর স্যানিটাইজার মেশানো গন্ধটাই একরকম অ্যানেস্তেশিয়ার অত। কোনোদিন ক্লোরোফর্মের গন্ধ নাকে না নিলেও কৃষাণুর একটা ধারণা জন্মে গেছিল-- ক্লোরোফর্মের গন্ধও এরকমই কিছু। মাথাটা ঝিমঝিম করে ওঠে। এরকম মাথা ঝিমঝিম করতে করতে আচ্ছন্নতার মধ্যে ডুবে যাচ্ছিল কৃষাণু। আর কিছু চিন্তা করতে ইচ্ছে করছিল না, রেজিস্ট করতে ইচ্ছে করছিল না। হাত-পা অবস হয়ে আসার মত রাগে ফেটে পড়ার ইচ্ছেটা অবস হয়ে এলো, ফুঁ দিয়ে নিভিয়ে দিল কেউ আগুনটা। অপ্রতিমদা কী বলছে, ডাক্তারটা কী বলছে-- কিছুই আলাদা করতে পারছে না। জড়িয়ে জড়িয়ে উঠে বুদবুদের মত ভেসে যাওয়া শব্দ। দূর থেকে অনেকের কণ্ঠস্বর ভেসে আসছে। বিলিয়ার্ড টেবিলের আলোটা কমজোরি হয়ে আসছে। কে যেন আবার একটা বল ঢুকিয়ে দিতে পেরেছে, হাততালি দিচ্ছে পাশে দাঁড়িয়ে থাকা অল্পবয়সী সুন্দরী মেয়েগুলো। আলো থেকে দূরে সরে গেলে কেউ মিস করে না, কেউ খোঁজেও না, কেউই না। ওই যে ডাক্তারের পোশাকে অপ্রতিমদা, স্টেথসকোপ নিয়ে এক এক করে মহিলা সহকর্মীদের চেকআপ করছে, প্রেসক্রিপশন লিখে দিচ্ছে। আর কী যে পারে লোকটা! অতসী বসে আসে নার্সের পোশাকে... ও কি একটু মোটা হয়ে গেছে? গর্ভবতী?।
হাসপাতালের এই অপেক্ষা আর শেষ হয় না! মাসের হিসেব করতে করতে তলিয়ে যায় কৃষাণু। এই তলিয়ে যাওয়ার অনুভূতিটাই সব থেকে পরিচিত... সব থেকে প্রিভেইলিং। এক হাজার মাইল গভীরতায় কোনো মানুষের শব্দ নেই। চিকচিক করা আলো নেই। শুধু চিঁ-ই-ই করে একটা ক্ষীণ শব্দ... আরো ক্ষীণ হয়ে যাচ্ছে গভীরতা বাড়ার সঙ্গে।
অন্য কেউই এসব দেখতে পেল না।

‘প্রেশার লো আছে দেখছি। সম্ভবতঃ প্যানিক বা স্ট্রেস থেকে– দুটোই এক্সপেক্টেড এ ক্ষেত্রে… কিছুক্ষণ ঘুমোলে, তারপর একটু গরম চা-টা খেলে হয়ত সুস্থ বোধ করবেন। মাইল্ড সেডাটিভ দিয়েছি, এটা ছাড়া আর কোনো মেডিকেশন এই মুহূর্তে লাগবে বলে মনে হচ্ছে না। তবে… ওনার বিশ্রাম দরকার। আপনাদের যা পরিস্থিতি, তাতে…’
প্রেশার মাপার যন্ত্রটা পাশের টেবিলে রাখতে রাখতে বললেন ডঃ দত্ত। টায়রাও উঠে এসেছে কৃষাণুকে দেখতে, ডাক্তারের কথাগুলো শুনে অপ্রতিমের দিকে তাকাল একবার… বোঝার চেষ্টা করল কী ঘটেছে এই ঘরে। কৃষাণু ঘুমিয়ে পড়েছে... কোনোরকম শারীরিক অস্বস্তির লক্ষণ নেই। একটা বেডে শুইয়ে দেওয়া হয়েছে ওকে। অপ্রতিম টায়রাকে বলল, ‘অনশু রাগিনীর কাছে আছে তো? ওকে একা থাকতে দিও না।’ টায়রা শুধু ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানাল। ডঃ দত্ত আবার বলে উঠলেন ‘নিত্যদাকে বলছি, যদি গরম চায়ের ব্যবস্থা করা যায়… আজকে রাতটা বেশ ব্যস্তই থাকতে হবে সবাইকে… যা দেখছি!’ কথাগুলো বলেই ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন ডঃ দত্ত। মনে হল-- যে উদ্দেশ্যে দুজনকে নিয়ে বসেছিলেন, কৃষাণু অসুস্থ হয়ে পড়ায় সেই মজাটা ফুরিয়ে গেল এখনকার মত। অপ্রতিম স্থির দৃষ্টি নিয়ে ওর চলে যাওয়া দেখল। টায়রা আছে বলেই হয়ত বিরক্তিটা প্রকাশ করল না অভিব্যক্তিতে।
      এই ঘরটা একটা কেবিনের মত, ডবল বেড কেবিন। কোনো রোগী নেই তাই খালি। এমার্জেন্সিতে রাগিনী আছে, তাই এই ঘরটিতেই এনে শোয়ানো হয়েছে কৃষাণুকে। চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে, ঘুমোচ্ছে বলেই মনে হয়… স্বল্প ক্ষমতার সেডাটিভের প্রভাব। ‘গরম কিছু খাওয়াবে বলে চা আনতে গেল বটে… কিন্তু ঘুমিয়ে পড়েছে যখন, আর ডেকে তুলে চা গেলানোর মানে হয় না। ঘুমটা দরকার ওর।’, এক প্রকার সম্মতি প্রত্যাশা করেই টায়রার দিকে তাকিয়ে কথাগুলো বলল অপ্রতিম। নিজেকে হঠাৎই কেমন কোণঠাসা মনে হচ্ছিল ওর। ডাক্তারটা চরম বিরক্তিকর হলেও ওর কথাগুলো একেবারে ফেলে দেওয়াও যায় না… মেয়েটাকে ওভাবে পড়ে থাকতে দেখার পর থেকেই কেমন একটা অস্বস্তি হচ্ছে। এর আগে অফিস-আউটিং-এ এমন কখনো ঘটেনি। একটা সুন্দর পরিবেশ কেমন…
‘কৃষাণুদার শরীরটা খারাপই ছিল’, কথাগুলো খুব সাবধানেই যেন বলল টায়রা, চাপা স্বরে। ও বুঝতে পারছে রাগিনীকে এই নার্সিং হোমে আনার পর থেকেই আর কিছু ঠিক যাচ্ছে না। পরিস্থিতি ওদের অনূকুলে নয় খুব একটা। অনশুও অন্য ঘরে নার্ভাস হয়ে আছে, ঘনঘন টেক্সট করছে কাউকে… এত উঁকিঝুঁকি দিয়ে দেখাও যায় না। আর জিজ্ঞেস করলেও যে সব সত্যি বলবে এমন না। অপ্রতিমদাকেও কেমন অন্যরকম লাগছে… একসঙ্গে অনেক রকম দুশ্চিন্তাই আসার কথা, মুখে প্রকাশ করছে না। টায়রা কিছু না ভেবেই হঠাৎ বলে ফেলল ‘টেনশন করো না… সব ঠিক হয়ে যাবে।’ নিজের কানেই খুব অদ্ভুত লাগল কথাগুলো শুনতে। অপ্রতিম কেমন ঘোর ভাঙার মত বলে উঠল ‘কী?’।
-সবাই খুব স্ট্রেসের মধ্যে আছি… তাই…
-অনশু কিছু বলছিল?
-না… কিন্তু কাউকে বার বার টেক্সট করছে, রিপ্লাই করছে টেক্সটে। প্রব্যাবলি ফোনে কথা বললে…
- আমরা বুঝতে পারব।
-
- শি হ্যাজ হার ওন রিজনস। ওর মনে হতেই পারে ও ফেঁসে গেছে। বাড়িতে জানাচ্ছে… বা বয়ফ্রেন্ডকে, বা এনিওয়ান ক্লোজ। ঠিক আছে… ডাজ নট ম্যাটার।
- যদি উলটোপালটা কিছু…
- কত জনকে কন্ট্রোল করবে টায়রা? এতগুলো ইন্ডিভিজুয়াল… কত জন কত জনের সঙ্গে এর মাঝেই ইনফর্মেশন এক্সজেঞ্জ করে ফেলেছে…
- সেই…
- রাগিনীর অবস্থা কেমন এখন?
- ও ঘুমিয়ে পড়েছে… কাঁপুনি মত হচ্ছিল, বাট এখন ফাইন।
- ও কি কারো সঙ্গে কথা বলছে না? উইয়ার্ড বিহেভ করছে?
- আমার খুব ভয় করছে অপ্রতিমদা… আগে করছিল না… বাট এই ডক্টর এমন ভাবে…
-
- ডাক্তার ফাউল প্লে সাসপেক্ট করছে… না?
- সেরকমই…
- কী বলছে? কী হয়েছে রাগিনীর?
- কী হয়েছে বলতে পারছে না… কিন্তু খারাপ কিছু ঘটার সম্ভাবনাকে উড়িয়ে দিচ্ছে না… হি ওয়ান্টস টু প্লে রাফ।
- মানে?
- পুলিশকে ইনভলভ করবে, রাগিনির বাড়ির লোকজনকে ইনফর্ম করে ডাকতে বলছে এখানে…মেডিক্যাল টেস্ট, রিপোর্ট, ব্লা ব্লা ব্লা…
- ওহ!
- প্যানিক করো না প্লিজ। এখনো প্যানিক করার মত কিছু হয়নি। 
- বলছি বটে, জানি... হাস্যকর লাগছে শুনতে। তোমাদের বয়সে এমন অভিজ্ঞতায় পড়লে। বিশেষ করে... 
- মেয়ে বলে? 
- সে ঠিকই। বাড়িতে জবাব দেওয়ার দায় থাকে মেয়েদের। অন্ততঃ ছেলেদের থেকে অবশ্যই বেশি থাকে। কিছু না করেও কথা শুনতে হবে আমাকে কাল। 
- খুব গিলটি ফিল হচ্ছে, জানো?
- সবার কথা ভেবেই। এদের ওপর একটু নজর রাখা উচিৎ ছিল। কে কোথায় নিজেরা একা আলাদা হয়ে যায়... ভেরি ডিফিকাল্ট নাও আ ডেজ! 
- উই নো নাথিং আবাউট ইট। কাউকে ব্লেম করতে চাইছি না... বাট, ইউ নো হু... 
- আমার কাউকে বাঁচানোর বা ডিফেন্ড করার দায় নেই টায়রা… সিরিয়াসলি! কে করেছে, কী করেছে… কে গিলটি… আমি শুধু চাই এতগুলো ছেলে-মেয়ের নাম, কোম্পানির নাম– এইসব নিয়ে শুধু শুধু যেন টানাটানি না হয়। একটা পুলিস এনকোয়ারি মানে…
- আর রাগিনী? ওর সেফটি? সত্যিই যদি ওর সঙ্গে কিছু...
টায়রার গলার স্বরটা হঠাৎই এক পর্দা ওপরে উঠে গেল অপ্রতিমের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে। অপ্রতিম অসহায়ের মতই একবার তাকালো, দরজার বাইরের দিকে চোখের ইশারা করল... অনুরোধ করার মত। টায়রাও তৎক্ষণাৎ অপরাধীর মত গুটিয়ে গেল। গিল্ট একা অপ্রতিমের না, অনেকেরই। নিজেকেও একজন মেয়ে হিসেবে দোষী মনে হচ্ছিল, কারণ টায়রা, প্রাজক্তা, এরা সকলেই অনেক কিছু জানে এদের দুজনের ব্যাপারে। কী করেছে, কী ঘটেছে-- তা সঠিক না জানলেও, কিছুই যে জানে না, এমনও না। অস্ফুটেই একবার বলে উঠল টায়রা-- 'সরি'। 

- ঝামেলাটা উলটো দিকে চলে গেল, ভালো লাগছে না। ..
- কাল সকালে পুলিশ এনকোয়ারি হলে হয়ত মিডিয়াও... 
- আমি নিজেই বাড়িতে কী বলব জানি না। এমনিতেই…
- কী হয়েছে?
- কিছু না… অ্যাজ ইউজুয়াল… বাদ দিন।
- আমি এখানে আছি বুঝলে… তুমি বরং অনশুর পাশে থাকো। এরপর ওরও যদি আবার না নার্ভাস ব্রেকডাউন বা অ্যাংসাইটি অ্যাটাক হয়… এতজনকে সামলানো মুশকিল হয়ে যাবে।
- হুম… বলছি, রিসর্টে কাউকে কল করে এখানে আসতে বলব? আপনি একা…
- আমি দেখছি… আমার অনেক কিছুই ঠিক লাগছে না আসলে… ওখানে এখন কী চলছে, সেটাও চিন্তার। সামথিং ওয়েন্ট টেরিবলি রং আউট দেয়ার!
-
- এনিওয়েজ, তুমি যাও অনশুর কাছে… শি নিড্‌জ ইয়ু মোর। যদি খুব ক্লান্ত লাগে… আচ্ছা, তুমি কি রিসর্টে ফিরে যাবে?

অপ্রতিমের প্রশ্নটার মধ্যে একটা অব্যক্ত টান ভেসে এলো। জিজ্ঞাস্য ছিল-- 'রিসর্টে ফিরে যাবে?' , টায়রা শুনল 'একা ফেলে চলে যাবে?'
টায়রার মনে হল-- উত্তরে 'না' শোনার জন্যই করা এই প্রশ্ন। দৃশ্যতঃ উদ্বেগের চাহনির আড়ালে বাকি সব কিছু লুকিয়ে মাথাটা নিচু করে অন্যদিকে ফিরে তাকাল টায়রা। কোনো উত্তরও দিতে পারল না, চলেও যেতে পারল না ঘর থেকে। সহকর্মীরা কেউ কেউ জানে, ওর একজনের সঙ্গে অনেক দিন ধরে চলা কোর্টশিপের কথা। তার নামটাও জানে দু একজন। হয়ত সামনের বছরেই একটা দিন ঠিক করে আনুষ্ঠানিক ভাবে এনগেজমেন্ট হয়ে যাবে। অবাঙালী, চাকরি করে বিদেশে। টায়রাও চলে যাবে ওর সঙ্গে, এনগেজমেন্ট হলেই ভিসার প্রসঙ্গ আসবে স্বাভাবিক ভাবেই। সে বলেই দিয়েছে-- ফেরার কোনো পরিকল্পনা নেই। প্রসঙ্গটা বাড়িতে বলে প্রত্যাশা করেছিল মৃদু আপত্তি। তাও এলো না। কেরিয়ার আর জীবন উভয়ের জন্যই এক দারুণ সুযোগ-- বিদেশ চলে যাওয়া। সত্যিই তো! কী হবে এখানে থেকে? কীসের আশায়? অপ্রতিমের ভাসিয়ে দেওয়া পিছুডাকের এই হালকা টানটা যেন এত কিছুর মাঝেও ভেতর থেকে টেনে বার করে আনল চিন্তাগুলো। গুডনাইট ম্যাসেজ করার পর এত কিছু ঘটে গেছে, তাকে আর কিছুই জানাতে পারেনি টায়রা। চাইছে না জানাতে এখন। ওদের ওখানে এখন দিন, কাজ, ব্যস্ততা। এইসব জেনে কিছু করতেও পারবে না। হয়ত ধমক দেবে, এখনই বাড়ি ফিরে আসতে বলবে কোনোভাবে। যাতে জড়িয়ে না পড়ে-- সাবধান করবে। দুশ্চিন্তা এবং তিরস্কার-- দুটোই স্বাভাবিক হয়ত, প্রত্যাশিতই। হয়ত। কেউ অনাহুত ঝামেলা পছন্দ করে না। আরো কত কিছুই তো অবলীলা অপছন্দের তালিকায় ফেলে দিতে পারে মানুষ। অন্য কারো পছন্দের হলেই বা! অনীহা বা অনিচ্ছা নয়... কিন্তু সম্পর্কে মাঝে মাঝেই একটা দোলাচল অনুভব করে টায়রা। সম্পর্ক তো ঠিক পথেই এগিয়েছে এতকাল, এমনই প্রত্যাশিত শুভ পরিণয়ের মাঝে পরিণতি পাবে-- সুন্দর হাসিখুশি ফ্যামিলি অ্যালবাম। অতি স্বচ্ছল পরিবার। তবুও... কাউকে দেখে বা কারো কথা ভেবে কোনো সেকন্ড থট নেই। কিন্তু মাঝে মাঝে এই ডিলেমাটা খুব অনুভব করে। নিজেকে বন্ধক রেখেই যেন একটা জীবন ধার নিয়ে ফেলেছে-- মনে হয় মাঝে মাঝে হঠাৎ। মাঝে মাঝে নিজের জন্যই একটু কাঁদতে ইচ্ছে করে, যে 'আমি'টাকে পেছনে ফেলে এগিয়ে যেতে হবে, একলা রেখে চলে যেতে হবে-- তার জন্যে। যেমন এখন করছে। কোথাও দ্বিধা থাকলে, তার একটা নির্দিষ্ট দৈর্ঘ্যের ফাঁক থাকে। সেই ফাঁকে কিছু একটা বা অনেক কিছু ঢুকে বসে থাকতে পারে। ফাঁকটা দিয়ে মাঝে মাঝে হু হু করে হাওয়া বয়ে যায়। হাত দিয়ে ঢেকে রাখতে হয় মাঝে মাঝে। এমন ফাঁকের মাঝেই আমাদের উৎকণ্ঠা, ক্ষোভ, বিরহ, সহ্য করে যাওয়া-- এমন অনেক কিছু জমতে জমতে কেলাসে পরিণত হয়। মানুষ নিজে তার মূল্য বোঝে না সব সময়ে। তা নিয়ে কী করবে, তাও বোঝে না। ওটা বুকের ভেতর জমে থাকা একটা ভার। বয়ে নিয়ে যাওয়া। অস্বস্তি। কষ্ট দেয়ও... গলায় হীরের খণ্ড আটকে থাকলেও তা কষ্টই দেয়। সে যতই দামী হোক।
     খুব অদ্ভুত আর অস্বাভাবিক লাগছিল টায়রার। একজন দূরের মানুষের সঙ্গে অন্যরকম কিছু মুহূর্ত কাটল এত দূরে এসে। কোনো অ্যাটাচমেন্ট নেই, থাকার কথাও না। অনেক সময় লাগে টায়রার কারো ওপর নির্ভরশীল হতে। যার সঙ্গে দু বছর ধরে একটা ধরে একটা স্থায়ী সম্পর্ক, তার ওপরেও পুরোপুরি নির্ভরশীল হতে পারেনি এখনো মানসিক ভাবে। আর অপ্রতিম তো খুবই দূরের কেউ! ওই কিছুক্ষনের ভালোলাগা নিয়ে হয়ত আবার যে যার মত নিজের জীবনে ব্যস্ত হয়ে যেত। হয়ত কেন? তাই-ই হত। সিনিয়র মানুষ, অফিসে দু ধাপ ওপরে পজিশন... বেশি না জড়ানোই ভালো। লোকটা কি এভাবেই কথা বলে সকলের সঙ্গে? টায়রার জায়গা অন্য কেউ হলেও কি এভাবে চলে যাবে কি না জানতে চাইত? চেনেই তো না ভালো করে!-- ফ্ল্যাশ কার্ডের মত প্রশ্নগুলো চোখের সামনে এসে চলে যাচ্ছে এক এক করে। ' আচ্ছা... অপ্রতিমদা কি কিছুই জানে না?'

      এখন সত্যিই মনে হচ্ছে, রাতটা এই নিঝুম নার্সিংহোমেই কাটবে। এমনই নিঝুম যে ওপরের ঘরগুলোতে আদৌ কোনো রোগী ভর্তি আছে কি না সন্দেহ হচ্ছে টায়রার। 'কিছু লোক তো বাইরে ছিল... মনে হচ্ছিল পেশেন্ট পার্টি। তাহলে নিশ্চয়ই পেশেন্ট আছে অ্যাডমিটেড!'-- উলটোপালটা চিন্তা চলে আসছে মনে। এতক্ষণ একটা অনিশ্চয়তা ছিল, এখন কেমন নিরাপত্তাহীন লাগছে … অথচ এই কথাগুলো প্রকাশ করা মানে একটা মানুষের চাপ আরো বাড়িয়ে তোলা। এমনিতেই পরিস্থিতি এবং পারিপার্শ্বিক কিছুই নিয়ন্ত্রণে মনে হচ্ছে না। কয়েক মুহুর্ত অপেক্ষার পর পর্দাটা সরিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যাবে, ঠিক তখনই আবার পিছু ডাকল অপ্রতিম, ‘শোনো?’
টায়রা সপ্রশ্ন দৃষ্টি নিয়েই ফিরে তাকাল, ওরও ক্লান্ত লাগছে এখন। দু-তিন সেকন্ড চুপ করে কিছু একটা চিন্তা করল অপ্রতিম ওর দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে, তারপর জিজ্ঞেস করল ‘ওই ঘরটায় রাগিনীদের যাওয়া… এটা একেবারেই স্বাভাবিক নয়… না ?’ প্রশ্নটা শুনে টায়রার চোখ-মুখের মধ্যে একটা স্পষ্ট পরিবর্তন হল। কিন্তু কিছু বলতে যাওয়ার আগেই দেখল ঘরের দিকে দ্রুত পায়ে এগিয়ে আসছেন নার্সিংহোমের ডাক্তার। কোনো উত্তর না দিয়ে, চোখের ইশারায় করিডোরের দিকে দেখিয়ে চলে গেল টায়রা। কয়েক মুহূর্ত পরেই পর্দা সরিয়ে ঢুকলেন ডঃ দত্ত। ঘুমন্ত কৃষাণুকে দেখতে দেখতে গলা নামিয়ে বললেন– ‘চা আনছে, তবে ঘুমিয়ে পড়ে থাকলে…’

©জয়দীপ  চট্টোপাধ্যায়

অঙ্কন : শাশ্বত বন্দ্যোপাধ্যায়




Comments

Popular posts from this blog

অনিন্দ্য সরকারের গুচ্ছ কবিতা : গান ছুঁয়ে ছুঁয়ে

অয়ন হালদারের পাঁচটি কবিতা

মুন্নী সেনের গুচ্ছ কবিতা : সম্বোধন