ঘুম : গালিব উদ্দিন মণ্ডল
উড়নচণ্ডী বলে একটা বদনাম ছিলই
উড়নচণ্ডী বলে একটা বদনাম ছিলই। উড়ে গেছে ঘুম। উড়ে ঘুমের শিকড় কি উড়িষ্যায় ?
কি জানি । গোপাল উড়েকে জিজ্ঞেস করে বলব।
আপাতত দুপুর। আপাতত শীতঘুম।
ঘুম তো এখনও ওষুধনির্ভর। আর ঘুম একটি হোমিওপ্যাথির পাখি। আমরা ওকে হোমিওপাখি ডাকি লোকে বলে হোমিওপ্যাথিকে হোমিওপাখির মতোই দেখতে। তেত্রিশ নম্বর পাতায় যতীনবাবুর দাওয়াখানা। সব রোগের একটাই ওষুধ। ‘ঘুমিওপ্যাথি’।
এদিকে আমাদের 'ঘুম ঘুম ক্লাসরুমে মাশরুম চাষ হচ্ছে। আমরা চাষ করি আনন্দে। সানন্দার পাতা মুখে রেখে ঘুমোচ্ছে উনিশ কুড়ি ।
আমি তো খাড়াই ছুরির উপর পিঠ পেতে। উপুড় হয়ে। দিব্যি ঘুমোতে পারি। শুধু আমি নয়। হিসেব কষে দেখেছি এই শবাসনে আমরাই সংখ্যাগুরু যাদের সংখ্যালঘু বলে চালিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এই হিসেবের ক্লাসটা টুকরো টুকরো। সেখানে ধর্ম দিয়ে গসাগু জাতপাত দিয়ে লসাগু । আর রাজনীতি দিয়ে খিচুড়ি । না খিচুড়ি পুরনো চালে। হালে বিরিয়ানি। চিকেন। মুরগির লাথি খেতে খেতে ঘুমিয়ে পড়ি।
ঘুমের খাঁচায় আপনি কি দেখেছেন আপনিও এক বিরাট মুরগি হয়ে যাচ্ছেন। ক্রমশই আপনার চর্বি বাড়ছে। মাথাটা আকাশ ছাড়িয়ে যাচ্ছে।
আর সেবার একটি মোরগের কাহিনী আবৃত্তি করে যে প্রথম পুরস্কার মেরেছিল, সে আসছে খেলাল করতে করতে। তার দাঁতের ফাঁকে সুকান্ত সমগ্রের টুকরো । দেখবেন গালে হাত দিয়ে ঘুমিয়ে পড়বেন না আবার।
২
ঘোর ছিল ঘুমের। জোর ছিল বিশ্বাসে। মোড় ঘুরল তর্কে।
তাসের ঘুম হুড়মুড় করে ধ্বসে পড়ল। ঘুম আসলে একটি ফোল্ডার। তার ভিতর থেকে ইস্কাবন বেরিয়ে এলো রুইতনের সাথে। বিবি খরগোশের মতো গলা বার করতেই ট্রিপল জাম্প দিয়ে উঠে এল গোলাম। খোঁড়াতে খোঁড়াতে বেরিয়ে এল সাহেব ।
সব্বার চোখে ফুটে ওঠে পিচুটির ফুল। ঝরে যায়।
এই ঘুমফুলগুলোর নাম ডুমুর । তবে এই ডুমুরগুলোর ভিতরে ঝুমুর বেজে চলেছে। এই নৃত্যবৃত্ত ছন্দই একমাত্র সাক্ষী যে ঘুম অপুষ্পক নয়।
আমরা এসে পড়েছি ঘুমের গর্ভকেশরে। এখান থেকে ঘুমের জন্ম দেখা যায়। ঘুম কীভাবে জন্মায় বলতে বলতে খালি গায়ে ছুটে যাচ্ছে দেহাতি শৈশব। ঘুমের ভ্রূণ ঘুরে বেড়াচ্ছে রাত একটায়। হাসপাতালের প্যারাম্বুলেটরে।
ঘুমের জন্মদিনে বেশি শোরগোল চলে না। ফিসফাস করে কেক কাটা হয় । বাসঘুম যেভাবে জন্মায় ট্রেনঘুম সেভাবে জন্মায় না। রাতঘুমের সাথে দিনঘুমের সনাক্তকরণ বৈশিষ্ট্য মেলে না। ঘরঘুমের আরাম মেসঘুমে থাকে না। ভাতঘুমের ঢেকুর চাউমিনঘুমের মতো নয়।
আমি ভাবছি রাস্তার ঘুমের কথা। রাস্তার মানুষজনের ঘুমের কথা। পুঁটলি পড়ে আছে। তাঁরা জানেন চোখের আগে কীভাবে পেটকে ঘুম পাড়াতে হয়।
৩
বড় ঘুম লেগেছে থ্রিডি নভেলে।
সেই আখ্যানের ভিতর ভাল্লুকটি সেইসবে চোখ কচলাতে শুরু করেছে । ঘোড়া তো দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই ঘুম পর্ব সেরে নিয়েছে। এর পরের পরিচ্ছেদে কুম্ভকর্ণের ঘুমেরও বয়স বেড়েছে। সেই কস্মিনকালে হিরোশিমার দিনে সে ঘুমিয়ে পড়েছিল। আজ হিমালয় গলে গেল । অ্যামাজন পুড়ে গেল। কুম্ভকৰ্ণ ঘুমিয়েই চলেছে। তার হোয়াটস আপে লেখা আছে স্লিপিং ।
ঘুমের জন্যই সর্ষে চাষ করা হয়ে ছিল। সেখানে শাহরুখ খান দুহাত মেলে দিল। লে, কথা ছিল নাকে দেওয়ার, চোখে পড়ল বালি ।
খালি খালি লাগছে কবিতার ক্লাস। কলকাতা একাত্তরের বাঁশি শীতকাতুরে হয়ে উঠেছে।
ফাঁকা ফাঁকা লাগছে গানের আসর। খনি অঞ্চলের লোকজনেরা ঘুমুতে পারছেন না। চটুল লাগছে ফেসবুক লাইভ। সেও মানুষকে ঘুমবাগীশ করে রেখেছে।
জেগে থাকাটা ফোবিয়া। জেগে থাকার পুরস্কারটা আদতে শাস্তি। দু চোখের পাতা এক না হওয়ার জ্যামিতি ক্লাস আগলে রেখেছে আমাদের বিশু পাগল। কবীর সুমনের লিরিকটা সে লিখছে জলের উপর। আগুন দিয়ে। জ্বলছে। আবার নিভে যাচ্ছে।
পাগল যেদিন ঘুমিয়ে পড়বে সেদিনই শিঙায় ফুঁ। সেদিনই রেজারেকশন ।
8
হাই তুলতে তুলতে মর্গে চলেছি।
মর্গে স্বর্গ আছে বলে একজন মাঝরাতে ‘আট বছর আগের একদিন’ পড়া শুরু করেছিল। আজও সে পড়া থামেনি।
সময় থেমে আছে আট বছর আগেই । কত যুগ কেটে গেল আট বছরের বেণীমাধব শীলের ফুলপঞ্জিকায়। আট মেরেকেটে সাড়ে সাতও হল না। সাড়ে আটও হল না।
সাড়ে চুয়াত্তর হয়ে উঠছে জীবন। তার ভুঁড়ি থেকে নেমে যাচ্ছে ধুতির আঁট । উঠেও যাচ্ছে মুহূর্তে। যেভাবে আমাদের শৈশবের ভুবনডাঙায় হাইরাইজ উঠে পড়ে ।
কে জানে হাইরাইজের ঘুম পায় কি না । তালগাছ একপায়ে দাঁড়িয়ে হাই তুলত যেখানে। সেখানে আজ হাইরাইজের হাইফাই ব্যাপার ।
এই আইসোলেশনের রচনা হালকা ফ্রাই করে খেতে ভালোই লাগে। হাইবারনেশন চেম্বারএকধরণের কবরঘর --- সাড়ে তিন হাতের মিন হা খালাক না কুম । সোজা কেয়ামতে ঘুম ভাঙবে।
আমি তাই আগেভাগেই ঠিক করে রেখেছি আমার সমাধি ফলকে লেখা থাকবে রক্তকরবী।
শুধু ঘুমভাঙানিয়াকে ঘুম পাড়ার বলে ক্লাইম্যাক্সে এসে ধেড়িয়ে যাচ্ছি।
৫
স্লিপিং পিল নিয়ে জাগলিং করতে করতে এগিয়ে চলেছে একবিংশ শতাব্দী।
টাইরেসিয়াসের ছানি অপারেশনের পর সে এইসব নাকি দেখে ফেলেছিল । টাইরেসিয়াস বললেই আমার কেমন সুরদাসের কথা মনে পড়ে যায়।
বাগনানের লোকাল ট্রেনে এই অন্ধ সুরদাসকে আমি প্রথম দেখেছিলাম। পিছনে সিঁদুর-পরা টাইরেসিয়াসের স্ত্রী। হাতে বাটি।
উড়ে এসে পড়ছে মহাত্মা গান্ধীজীর ছাপা ছবির কয়েন। নোট।
তার পাশ দিয়ে ছুটে চলেছে বেলুনওয়ালা। ঘুগনি ওয়ালা। দিলখুশওয়ালা।
সুরদাস আর এইসব দেখতে পান না। টাইরেসিয়াস একারণেই ফেকো সার্জারির পক্ষপাতী ছিলেন না। তিনি শুধু বললেন ঘুম বা জাগরণের মাঝে কোনো অপারেশন থিয়েটার নেই।
এইসব বলা হচ্ছে গ্রিসের কোনো বটতলায় (যদি বট গাছ থাকে)। নাহলে এই থার্ড থিয়েটার হবে হুগলি জেলায়।
ততক্ষণ চলতে থাকুক সার্কাস। দীর্ঘজীবী হোক ঘুমবড়ির ভোজবাজি।
© গালিব উদ্দিন মণ্ডল
অঙ্কন : ঋতুপর্ণা খাটুয়া
“পাগল যেদিন ঘুমিয়ে পড়বে সেদিনই শিঙায় ফুঁ। সেদিনই রেজারেকশন ।”
ReplyDelete