ধানের গন্ধে সুন্দরবন: প্রবন্ধ ১ — সুরজিৎ বেরা


ধানের গন্ধে সুন্দরবন


"আজন্ম ধানের গন্ধ" বইছে সুন্দরবন জুড়ে। বাদাবনের জঙ্গল হাসিল করে আবাদীকরণ হল একপ্রকার জীবন সংগ্রাম। নদীবাহিত পলিমাটির বিস্তৃত ভূভাগ নোনা হাওয়া ও লবণ জলের কারনে ধান চাষের অনুপযুক্ত। বাঁধ দিয়ে তা উদ্ধার করেন চাষিরা। বলতে গেলে সাধক রামপ্রসাদের ধারনাকে ফলপ্রসূ করেছেন তাঁরা -
"এমন মানব জমিন রইল পতিত
আবাদ করলে ফলত সোনা"

একসময় জঙ্গলের মধ্যে সবথেকে উঁচু জায়গায় যেখানে জোয়ারের জল পৌঁছাতে পারতনা, সেখানে জঙ্গল কেটে, বৃষ্টির জল সংরক্ষণ করে ধান চাষ করত মরসুমি চাষিরা। এতে জমিদার ও তালুকদারদের স্বার্থ জড়িয়ে ছিল। প্রথমদিকে অল্প পরিমাণ জমিতে চাষ শুরু হলেও ফসলের পরিমাণ বেশি হওয়ায় চাষিরা উৎসাহিত হয় এবং পরে পরে পরিকল্পিত ভাবে জঙ্গল কেটে জমির পরিমাণ বাড়াতে থাকে। আসলে সুন্দরবনের উর্বর ভূমি চাষিদের মন কেড়েছিল। ইংরেজ রাজত্ব, জমিদার - তালুকদারদের স্বার্থে সুন্দরবনের বিস্তির্ণ অরণ্য অঞ্চল
আজ আবাদ ভূমিতে পরিণত হয়েছে। বাসন্তীতে রয়েছে সব থেকে বড় আবাদভূমি।

উত্তর-পূর্ব থেকে দক্ষিণ-পশ্চিমের প্রায় ১৩৮৯ বর্গমাইল সন্দেশখালি, বাসন্তী, ক্যানিং, জয়নগর, মথুরাপুর, পাথরপ্রতিমা, কাকদ্বীপ,   সাগরদ্বীপ পর্যন্ত দীর্ঘদিন ধরে চাষ হচ্ছে। শতকরা ৯৪.৬১% পরিবার কৃষি নির্ভর। কৃষিজীবীদের মধ্যে শতকরা ৫৪.২১ ভাগ লোকের নিজস্ব জমি নেই। কৃষি হল সুন্দরবনের অর্থনীতির ভিত্তি। কৃষি সম্পূর্ণ বৃষ্টির ওপর নির্ভর করে। তিন প্রকার ধান চাষের মধ্যে বর্ষাকালের আমন ধান বেশি পরিমাণে চাষ হয়। সুন্দরবনে বিঘাপ্রতি আমন ধানের পরিমাণ পশ্চিমবঙ্গের মধ্যে সবথেকে বেশি। আউস ধানের চাষ খুবই নগণ্য এবং বোরো ধানের চাষ অল্প বিস্তর।

পশ্চিমবঙ্গের অন্যান্য জেলার সঙ্গে সুন্দরবনের চাষবাসের বিস্তর ফারাক রয়েছে। এই অঞ্চলের জমি অনেক নীচু। ভূমি অবস্থানের পার্থক্যের ভিত্তিতে এই অঞ্চলের আমন ধানকে দুই ভাগে ভাগ করা যায়। যথা -

ক. অল্প জলে হওয়া ধান :

সুন্দরবনের যে সকল অঞ্চলে জমি অপেক্ষাকৃত উঁচু সেই সকল অঞ্চলে ধানের ক্ষতির পরিমাণ কম। এতে উন্নত প্রজাতির ধান চাষ করা হয় - দুধের সর, গোবিন্দ ভোগ, পাটনাই, রূপশালি, জ্ঞেতি, দাসশালি ইত্যাদি। 

খ. বেশি জলে হওয়া ধান:

সুন্দরবনের যে সকল অঞ্চলে জমি নীচু, যেখানে জল থাকে হাঁটু সমান এমনকি উরু সমান-ও জল থাকে; সেই সব জমিতে উন্নত প্রজাতির ধান চাষ করা সম্ভব নয়। জলের উচ্চতার ভিত্তিতে দ্রুত উঠবে এবং নষ্ট না হয় টিকে থাকবে এমন ধান চাষ করা হয় - মোটা ধান, হোগলা ধান, গোপাল ভোগ, গেঁড়ি, আঁশফালি, খেজুর ছড়ি ইত্যাদি।

বহুকাল যাবত এই সকল আমন ধানের চাষ চলে আসছে সুন্দরবনে। তবে বর্তমানে পাওয়ার টিলার, ট্রাক্টর, সার, কীটনাশক ব্যবহারের মাধ্যমে কৃষিজমিতে কৃষি ফসলের পরিমাণ বেড়েছে। কৃষি উন্নয়নের সাথে সাথে চাষের আমূল পরিবর্তন ঘটেছে। গোরু-লাঙলের চাষ হারিয়ে গেছে। হারিয়ে গেছে অনেক ধান প্রজাতি। এসেছে উচ্চফলনশীল উন্নত প্রজাতির ধান - রত্না, পদ্মা, স্বর্গ, সবিতা, সি-আর ইত্যাদি।সুন্দরবনের বিভিন্ন অঞ্চলে প্রচুর পরিমাণে স্যালোর পরিমাণ বেড়েছে এবং খাল সংস্কারের মাধ্যমে বোরো ধানের চাষ ব্যাপকহারে বেড়েছে - পাশাকাঠি, সোনাচূড়, লালশংকর, ললাট, B-20 ইত্যাদি।

ধান চাষের সাথে সাথে সুন্দরবনের ধান উত্তোলনের পার্থক্য দেখা যায় অন্যান্য জেলার সাথে। ধান কাটার পর তা গোছা করে বাঁধা হয়। মাঠে খড় শুকনো হওয়ার পর তা স্তরে স্তরে বেঁধে মাথায় করে খামারে নিয়ে আসে চাষী মজুররা। ধান সমেত খড়ের গাদা দেওয়া হয় বিভিন্ন রীতিতে। চালা মন্দিরের ন্যায় গাদা, এক রত্ন বিশিষ্ট মন্দিরের ন্যায় গাদা দেখা যায়। এর মধ্য দিয়ে বাংলার মন্দির শৈলীর সম্বন্ধ পাওয়া যায়। পরে সময় করে ঝাড়াই-পাছড়াই হয়। সোনায় ভরে খামার। সলিল চৌধুরীর কথায় -
"এ দেশ তোমার আমার
এই আমরা ভরি খামার
আর আমরা গড়ি স্বপন দিয়ে সোনার কামনা"

তথ্যসূত্র: 

ক. আঠারোভাটির ইতিকথা ( আবাদ পর্ব) - ড. স্বপনকুমার মন্ডল

খ. চব্বিশ পরগণা ( উত্তর দক্ষিণ সুন্দরবন) - কমল চৌধুরী

গ. আবাদ সাহিত্য ( ২০২২ বইমেলা সংখ্যা) : সুন্দরবন অঞ্চলের চাষাবাদের বৈশিষ্ট্য এবং বিশেষ কিছু ধান - বিভূতিময় মন্ডল

© সুরজিৎ বেরা

Comments

  1. ভালো লাগল, ভাই সুরজিৎ। অভিনন্দন রইল। ধান চাষে হিঙ্গলগঞ্জেও বৈচিত্র্য কম নেই। সেটাও উল্লেখ্য।

    ReplyDelete

Post a Comment

Popular posts from this blog

অনিন্দ্য সরকারের গুচ্ছ কবিতা : গান ছুঁয়ে ছুঁয়ে

অয়ন হালদারের পাঁচটি কবিতা

মুন্নী সেনের গুচ্ছ কবিতা : সম্বোধন