ভালো থেকো নিশীথ অবশেষ —পর্ব ৭: জয়দীপ চট্টোপাধ্যায়
ভালো থেকো নিশীথ অবশেষ —পর্ব ৭:
হাসপাতাল অথবা মাল্টিস্পেশ্যালিটি ক্লিনিকের অস্বস্তিকর চেয়ারগুলোতে বসে বসে ঠাঁয় অপেক্ষা করে যাওয়া... অন্য কারো দেরি করে যাওয়া, দায়িত্বজ্ঞানহীনতা-- এই সব কিছু সহ্য করতে থাকা... সময় ছাড়াও আর কী কী মূল্যহীন হয়ে গেছে, মূল্যহীন হওয়ার তালিকায় চলে যাচ্ছে দ্রুত-- এইসব ভাবতে ভাবতে আবার সচেতন অপেক্ষার উদ্বেগে ফিরে আসা। এই অভিজ্ঞতা আর এইসবের মধ্যে দিয়ে যাওয়ার ব্যাপারটাকেই ঘৃণা করে কৃষাণু। চিকিৎসা ব্যাপারটাই যে কত বড়ো বিরম্বনা হয়ে গেছে মানুষের কাছে, তা হাতেকলমে বুঝে নেওয়া যায় এভাবে নাকাল হতে হতে। চুপচাপ হজম করে যেতে হয়, কাজটা উদ্ধার করতে হবে। লেকচার অনেকেই দেবে, কিন্তু এগিয়ে এসে কাজটা করে দেবে না। ছোটোবেলায় একরকম দেখেছে, এখন আরো বেশি করে দেখছে। বাবাকে নিয়ে কম ছুটোছুটি করতে হয়নি। মা-কে নিয়েও বছরে দু-তিনবার যাওয়া-আসা লেগে থাকে। অন্য কত জন আরো খারাপ পরিস্থিতির মধ্যে আছে, তাও তারা ভেঙে পড়ছে না... ফ্রাস্ট্রেটেড হয়ে নিজের মানসিক শান্তি নষ্ট করছে না-- এটাই একমাত্র অপ্টিমিস্টিক থাকার মন্ত্র এখন। যদিও কেউ রিয়েলিস্টিক হয়, তার পক্ষে কোনো মতেই এসবের মধ্যে যুঝতে যুঝতে আশাবাদী থাকা সম্ভব না। কৃষাণুর পেশাগত কর্পোরেট জগৎ ওকে অপ্টিমিস্ট হতে শেখায়, রেজিলিয়েন্ট হতে শেখায়, প্রতিকূল পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুত থাকার কথা বলে। যা বলে, তার সারমর্ম না বুঝলেও এটা বোঝে যে 'নিজের ভালোটা আগে বোঝার আর দুশ্চিন্তামুক্ত থাকার এক প্রকার অর্গ্যানাইজড মগজধোলাই এসব'। কিন্তু এত কথা অফিসে বলতে নেই। ঘনিষ্ঠ সহকর্মীদের সঙ্গেও না। কার মনে এখন কী আছে, বোঝা যায় না। একটা রাজনৈতিক পরিস্থিতি, একটা আর্থিক পরিস্থিতি, বা একটা আন্দোলন নিয়ে নিজের ব্যক্তিগত মত প্রকাশ করতে গেলেও দুবার ভাবতে হয়। এদের নিজেদের এতদিন লুকিয়ে রাখা চেহারাটা ইদানিং খুব স্পষ্ট হয়ে ওঠে কোনো রকম কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স নিয়ে কথা শুরু হলে। আগে বোঝাই যেত না, যে এরা এত কিছু পুষে রেখেছে মনের ভেতর। আর ঘনিষ্ঠ... শব্দটা মনে আসতেই অপ্রতিমের দিকে আড়চোখে একবার তাকাল কৃষাণু। মোবাইল ফোনের দিকে তাকিয়ে মাথা নিচু করে বসে আছে অপ্রতিম... খানিক দূরত্ব রেখে অন্য একটা চেয়ারে। সঙ্গে সঙ্গে টুং করে কৃষাণুর ফোনে একটা ম্যাসেজের শব্দ হল। অনশুর ম্যাসেজ।
অনশুর ম্যাসেজটা পড়েই উদ্বিগ্ন হয়ে ডাকল কৃষাণু, ‘অপ্রতিমদা… দেখে যাও।’ অপ্রতিম কাছে আসতেই নিজের ফোনের পর্দাটা দেখাল কয়েক মুহূর্তের জন্য। পাশে বসে থাকা রিসর্টের লোকটা উঁকি-ঝুঁকি দিয়ে বোঝার চেষ্টা করছে দেখেই চট করে ফোনটা আড়াল করে নিল অপ্রতিম। ইংরেজিতে লেখা-- ‘প্লিজ কাম কুইক, ডক ইজ কুকিং আ বিগ মেস ফর আস হিয়ার।’ ম্যাসেজটা দেখা মাত্রই কৃষাণুকে ইচ্ছে করে হাত ধরে টেনে রিসর্টের লোকটার থেকে দূরে নিয়ে গেল অপ্রতিম, তারপর কানের কাছে মুখ নিয়ে আসা চাপা গলায় বলল– ‘যেটা বলছি, শুধু শুনবি… কমেন্ট করবি না, মুখের এস্কপ্রেশন চেঞ্জ করবি না। অভীক বা মৈনাক কাউকে একটা ফোন করে বল, রাগিনী আগের থেকে বেটার, নো ডেঞ্জার, নো ওরিজ। আমাদের ফিরতে লেট হবে। আর হোটেল ম্যানেজার কিছু জিজ্ঞেস করলে যেন এটুকুই বলে, বেশি জানতে চাইলে যেন আমাদের ফোন করতে বলে। এর বাইরে অন্য কেউ… অন্য যে-ই ফোন করুক, নিজেরা কোনো কথা না বলে। বাথরুমে পড়ে গেছিল রাগিনী, ড্রিংক করেছিল… অন্য অনেকের মতই। দ্যাট্স ইট। এর বাইরে কেউ কিচ্ছু জানে না। ফোনটা তাড়াতাড়ি করে ভেতরে চলে আয়। আমি গিয়ে দেখছি ডাক্তার কী বাওয়ালটা দিচ্ছে! আর শোন… এই ম্যানেজারের চামচাটাকে বেশি চড়তে দিস না। বি পোলাইট, বাট স্পেস দিবি না একদম!’ কথাগুলো বলেই অপ্রতিম দ্রুত নার্সিংহোমের ভেতর দিকে যেতে যেতে বলল– ‘নিত্যবাবুকে একটু আইডি আর ডিটেলসগুলো দে, আমি একবার দেখি ওরা কী করছে।’ রিসর্টের লোকটা একইরকম সন্দেহর চোখে ওদের দেখে যাচ্ছিল, বোঝাই যায়– ওকে পাঠানোই হয়েছে নজরদারী চালিয়ে যেতে। চোখের আড়াল হতে দেবে না কাউকে। সব কথা গিলবে। ঝামেলা শুরু করলে এরাই করবে… যদি না ম্যানেজারকে স্পষ্ট বোঝানো যায়, পুলিশ কেস হলে তাদের রিসর্টের নামটা কোথায় কোথায় আর কতটা নীচে টানার সম্ভাবনা আছে।
এমার্জেন্সি রুমের কাছাকাছি পৌঁছতেই অপ্রতিম দেখল পর্দা সরিয়ে ভেতর থেকে সেই অল্পবয়সী ডাক্তার বাইরে বেরিয়ে আসছেন। ওকে দেখেই চোয়াল শক্ত হয়ে গেল অপ্রতিমের। অনশুর ম্যাসেজটা একটা এসওএস-এর মত ছিল, যা কারো জন্যই খুব একটা সুবিধের কথা নয়। অপ্রতিম প্রায় পথ অবরোধ করেই ডাক্তারের সামনে এসে দাঁড়াল, এবং গলায় যতটা সম্ভব উদ্বেগ মিশিয়ে বলল– ‘কেমন দেখলেন ডাক্তারবাবু? এনিথিং টু ওরি আবাউট? ওকে কি অ্যাডমিট করতে হবে?’ কথাগুলো বলতে বলতেই অপ্রতিম চেষ্টা করল ডাক্তারের কাঁধের ওপর দিয়ে দেখার, যে এমার্জেন্সি রুমের ভেতর মেয়েগুলো ঠিক কী অবস্থায় আছে। ওদের মুখ-চোখের অবস্থা কেমন। রাগিনীকে দেখা যাচ্ছে, এমার্জেন্সি কেয়ারের বেড-এ শোয়ানো... ঘুমোচ্ছে না আচ্ছন্ন হয়ে আছে-- বোঝা যাচ্ছে না। খুব একটা স্বাভাবিক লাগছে না। আন্দাজ করা যায়, এই ডাক্তার ভেতরে কী বলে থাকতে পারে যাতে অনশু প্যানিক করছে। টায়রা রাগিনীর দিকেই মুখ করে বসে, আর অনশু ঝড়ের বেগে কাউকে কিছু ম্যাসেজ করে যাচ্ছে। এই সকলকে কিছু না কিছু বলে বেড়ানো, ঘটনাটা ছড়িয়া পড়ে-- এটা শত চেষ্টা করেও আটকানো যায় না। এইসব ক্ষেত্রে প্যানিক করে ভুল কিছু কাউকে লিখে পাঠালে খুব সমস্যা হয়ে যাবে। ইচ্ছে করছিল ছুটে গিয়ে হাত থেকে ফোনটা নিয়ে নেয়। কিন্তু আপাতত সেখান থেকে দৃষ্টি সরিয়ে ডাক্তারকে ম্যানেজ করার চেষ্টা করল অপ্রতিম। এত বছরের পিপল ম্যানেজমেন্ট স্কিল, প্রতিকূল পরিস্থিতিতে বিরূপমতি ক্লায়েন্টকে বসে আনা বা কনভিন্স করার যে কৌশল ও আয়ত্ত করেছে, এতবার অ্যাপ্রিশিয়েটেড হয়েছে– সেই সব স্কিলেরই যেন আর একটা পরীক্ষা ওর সামনে উপস্থিত হয়েছে অপ্রত্যাশিত ভাবে। একটা সুন্দর ডে-আউট, কিছু সুন্দর মুহূর্ত... দু-তিন ঘন্টার মধ্যে সব কেমন দুঃস্বপন হয়ে উঠল! এক ঝলকে এমার্জেন্সি রুমের ভেতরটা দেখেই আবার সেই উদ্বিগ্ন দৃষ্টিটা ফিরিয়ে এনে ডাক্তারের দিকে তাকাল অপ্রতিম। চিকিৎসক সামান্য হাসলেন, হাসিটা আশ্বস্ত করার জন্য না ব্যঙ্গ করার জন্য– ঠিক বোঝা গেল না। হেসে বললেন– ‘আরে এই তো!... আপনি এসে গেছেন, আমি আপনাদেরই খোঁজে যাচ্ছিলাম।’
- কেন? এনিথিং সিরিয়াস? কী হয়েছে রাগিনীর?
- হ্যাঁ কিছু একটা তো সিরিয়াস আছেই… এখানে সব রকম টেস্ট সম্ভব নয়। আর কালকে সকালের আগে তো…
- কী মনে হচ্ছে ডাক্তারবাবু?... আপনি প্লিজ আপনার অবজার্ভেশনটা জানান, আমরা ইমিডিয়েটলি ওকে সদর হাসপাতালে শিফট করানোর ব্যবস্থা করছি!
- শিফট করবেন… মানে এখান থেকে নিয়ে যাবেন?
- অফ কোর্স!
‘এই নিত্য দা-আ-আ… এদের আইডি প্রুফ, এটসেটেরা দেখেছেন? সব ডিটেইলস রেজিস্টার করা হয়ে গেছে?’... কথাগুলো বলতে বলতে অপ্রতিমকে পাশ কাটিয়ে এগিয়ে গেলেন নার্সিং হোমের একমাত্র উপস্থিত চিকিৎসক। নিত্য নামের সেই মাঝবয়সী ভদ্রলোক ওঁকে এগিয়ে আসতে দেখে থতমত খেয়ে তারাতারি রেজিস্টারের খাতাটা হাতে নিয়ে মিলিয়ে দেখার চেষ্টা করলেন… কী কী আছে লেখা। মিনমিনে গলায় বললেন ‘হ্যাঁ স্যার… আসলে এত রাতে তো কম্পিউটার অন হবে না। আর ওসব শ্যামলী আর ব্রতীন করে… আমি ঠিক…’
- আপনি কী কী রেকর্ড করলেন তাহলে? যা যা দরকার রেজিস্টারে নোট করেছেন তো?
- হ্যাঁ হ্যাঁ… এই… এই যে…
- গাড়ির নম্বর, কোন রিসর্ট, কোন অফিস, পেশেন্টের নাম, সঙ্গে যাঁরা এসেছেন তাঁদের নাম… আইডি প্রুফ… এই যে ড্রাইভার, তার নাম-ঠিকানা… সব নোট করেছেন?
- না… মানে, এত ডিটেলস তো লাগে না জেনারেলি… কেন, কী হয়েছে স্যার? সিরিয়াস কিছু?
অপ্রতিমও পেছন পেছন রিসেপশন ডেস্কে এসে একই সুরে বলল, ‘আই অ্যাম সরি, বাট আমরা ঠিক বুঝতে পারছি না… আপনি এত ডিটেলসই বা কেন জানতে চাইছেন… আর ঠিক করে কী হয়েছে, সেটাই বা বলছেন না কেন?’ অপ্রতিমের কথাগুলো কানে পৌঁছতে কৃষাণুও দৌড়ে এলো রিসেপশনের ডেস্কের দিকে। বাইরের সিকিওরিটি আর পুরুষ নার্সিং স্টাফটি সজাগ হয়ে উঠে দাঁড়াল। এমনকি রিসর্টের লোকটিও গাড়ির পাশ থেকে ছুটে চলে এলো ব্যাপারটা ভালো করে বুঝতে। সেই চিকিৎসক অপ্রতিম আর কৃষাণুর দিকে একবার তাকালেন, তারপর শান্ত ভাবে বললেন– ‘দেখুন… আপনারা যে একেবারেই কিছু বুঝতে পারছেন না, বা জানেন না, এটা আমি বিশ্বাস করি না। আমরা ডাক্তার, কিছু জিনিস টেস্ট না করলেও বোঝা যায়। মেয়েটির মাথায় এমন কিছু চোট লেগেছে বলে মনে হচ্ছে না আমার। পালস একটু ইরেগুলার থাকলেও প্রেশার বা টেম্পারেচরও নর্মাল। তাহলে বলুন তো… ও এভাবে সেন্স ফেরার পরেও এভাবে শুয়ে আছে কেন? রেসপন্স স্বাভাবিক নয় কেন?... ওর নাম জিজ্ঞেস করতেও বলতে পারেনি আমাকে… বুঝেছেন? লেট অ্যালোন আদার থিংস। আমাকে এটা নর্মাল বলে মেনে নিতে হবে?’
চিকিৎসকের কথাগুলো শুনে অপ্রতিম আর কৃষাণু একবার চোখ চাওয়া-চাওয়ি করে নিল নিজেদের মধ্যে। তারপর কৃষাণু বলল– ‘দেখুন… আমরা কিন্তু ওকে সেন্সলেস অবস্থাতেই পেয়েছি… ’
‘পেয়েছেন?’ বলে সেই চিকিৎসক কৃষাণুর দিকে ঘুরে তাকালেন। রিসর্টের লোকটিকে দেখে মনে হচ্ছে, রীতিমত ভয় পেতে শুরু করেছে। বুঝতে পারছে যে পরিস্থিতি হাতের বাইরে বেরতে শুরু করেছে। আসতে আসতে দু এক-পা করে পিছিয়ে যেতে যেতে সিকিওরিটি গার্ডের নজরের আড়ালে চলে যেতে চাইল। অপ্রতিম নিজেকে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করে গুছিয়ে বলার চেষ্টা করল, ‘পেয়েছি মানে… যে ওর রুম মেট ছিল, টায়রা, এখানে এসেছে আমাদের সঙ্গে… ও-ই প্রথম… দেখুন, উই ক্যান এক্সপ্লেন। আপনি পুরোটা শুনলে ব্যাপারটা বুঝতে পারবেন। দিস ইজ ভেরি ক্লিন সিচুয়েশন। আপনি যেমন ভাবছেন বা সাস্পেক্ট করছেন। র্যাদার… আনফরচুনেটলি যেমন লাগছে আর কি…’। ‘আপনারা একটু এই দিকে আসবেন প্লিজ?’, অপ্রতিমকে শেষ করতে না দিয়েই চিকিৎসক ওঁদের পাশের একটি ঘরের দিকে ইশারা করে সেই দিকে আসার অনুরোধ করলেন। দেখে মনে হল… বসে কথা বলতে চান, শুনতে চান ওদের কথা... একান্তে। অথবা ওঁর নিজেরই আরো কিছু বলার আছে। ‘ওহ সার্টেনলি’ বলে অপ্রতিম ইশারা করে কৃষাণুকেও সঙ্গে আসতে বলল। চিকিৎসকের সঙ্গে সঙ্গে দুজনে গিয়ে ঢুকল পাশের ছোটো ঘরটায়, রোগী দেখার ক্লিনিক… তখন ঝুপসি অন্ধকার, ফাঁকা… ঘরে একটা চাপা ওষুধ-ওষুধ গন্ধ, তার সঙ্গে মিশেছে হালকা ফিনাইলের গন্ধ। ঘরে ঢুকে একটা আলোর সুইচ টিপে দরজাটা বন্ধ করতে করতে চিকিৎসক বললেন ‘নিত্যদা… আপনি একটু দেখুন, মহিলারা আছেন ভেতরে… ওঁদের কিছু দরকার লাগবে কি না। পেশেন্ট ড্রাউসি অবস্থায় আছে, প্রায় অজ্ঞানই... কিছু মনে হলে ডাকবেন আমাকে। আর সিকিওরিটিকে বলুন গাড়িটার ওপর নজর রাখতে। আমরা একটু ভেতরেই বসছি… ওকে?’
- হুম, বলুন এবার।
- হুম?
- ওই যে… বাইরে বললেন… পুরোটা শুনলে…
- ওহ ইয়েস!… তার আগে জানাই, মাইসেলফ অপ্রতিম ঘোষ… আর ও কৃষাণু বণিক। আমরা দুজনে একই অফিসে কাজ করি। উই আর কলীগস।
- সে তো আপনাদের কথা মত আপনারা প্রত্যেকেই কলীগস।
- ইয়েস, অ্যাবসোলিউটলি। বাই দ্য ওয়ে… আপনি…
- ঠিক ঠিক… এমার্জেন্সি ডাক্তার, নামটাও কেই জানায়নি বোধহয় এখনো… আপনারা জিজ্ঞেস করেননি নিত্যদাকে?
- না মানে… আসলে এত কিছু একসাথে…
- আমার নাম সায়ক দত্ত, এমবিবিএস। মেডিকেল কলেজের নামটা লেটারপ্যাডে আছে। সঙ্গে আর কোনো ডিগ্রী নেই আপতত… বুঝতেই পারছেন, এমন নার্সিং হোমে রাতে জেগে বসে আছি যখন…
- ইফ ইয়ু ডোন্ট মাইন্ড, আমার মনে হয় আপনি কৃষাণুর থেকেও ছোটো… মানে আমার থেকেও অনেকটাই…
- হোয়াটস দ্য পয়েন্ট? ছোটো তো কী? অনভিজ্ঞ? না অথোরিটি কনসার্ন?
- নো নো…প্লিজ। এমনিই…
- আমি ইচ্ছে করেই অন্যদের থেকে আলাদা করে নিয়ে এলাম আপনাদের। আশা করি বুঝেছেন। মেয়েদের সঙ্গেও বসলাম না। নাও প্লিজ… হেল্প মি, অ্যান্ড হেল্প ইয়োরসেল্ভস।
‘আপনি কি পুলিশ কেস সাস্পেক্ট করছেন?’ কৃষাণু যেন একটু অধৈর্য হয়েই কথাটা বলে ফেলল। সন্ধ্যেবেলা ড্রিংক করেছে, তারপরেও স্ট্রেসড ছিল একাধিক কারণে। বমি করে ফেলেছিল রুমে গিয়ে, অনেকেই জানে না। তারপর রাত থেকে এই চলছে… মানসিক ভাবে নিতে পারছিল না আর। কৃষাণুর কথাগুলো শুনে ওর দিকে তাকিয়ে কিছু বলতে যাচ্ছিলেন ডাঃ সায়ক দত্ত, কিন্তু ওঁকে কিছু বলতে না দিয়ে অপ্রতিমই কৃষাণুকে উত্তর দিল ‘পুলিশ কেস যদি মনে হয়, তার কারণ থাকতে পারে… লেটস ডিসকাস ইট আউট ফার্স্ট। ওঁর যদি সব কিছু শুনে মনে হয় দেয়ার ইজ সাম নীড…’। ‘নীড আছে অপ্রতিম বাবু… আমি বাজী ধরে বলতে পারি, শি ইজ ইনটক্সিকেটেড। টেস্ট করলে রিপোর্ট হান্ড্রেড পার্সেন্ট পজিটিভ আসবে। কীসের ট্রেস পাওয়া যাবে জানি না। ডেফিনিটলি নট জাস্ট অ্যালকোহল!’... কথাগুলো গম্ভীর ভাবেই জানিয়ে দিলেন ডাঃ দত্ত। তারপর চেয়ারে মাথাটা এলিয়ে দিয়ে পিঠটা টান করে বসলেন। কৃষাণুর চোখমুখ দেখে মনে হচ্ছিল– সত্যিই আর নিতে পারছে না। কোনোক্রমে নিজের মেজাজের কলার ধরে রেখেছে। চোখের ইশারায় অপ্রতিমকে বলল ‘তুমিই যা বলার বলো।’
অপ্রতিম আবার একবার নিজেকে গুছিয়ে নিয়ে বলার চেষ্টা করল, ‘দেখুন ডক্টর দত্ত। উই আরে ডেফিনিটলি নট হিয়ার টু চ্যালেঞ্জ ইয়ু। বাট আপনি যদি আমাদের কথাটাও একটু শোনেন… আমরা তো কোঅপরেট করবই, আপনিও একটু…’
- সেই কারণেই তো এখানে এলাম… বলুন?…
- রাগিনীকে আমি বা কৃষাণু কেউই প্রথম দেখিনি… ওর অন্য কলীগরা দেখেছে। সো লেটস বি অনেস্ট… উই ডোন্ট নো হাউ শি ওয়াজ একজ্যাক্টলি ফাউন্ড, ইনিশিয়াল কন্ডিশন কী ছিল। আমরা যখন গেছি… ওকে অলরেডি তিন-চার জন ঘিরে দাঁড়িয়েছিল। আমি আর কৃষাণু প্রায় একসাথেই গেছি ঘটনাস্থলে।
- ঘটনাস্থল।
- হ্যাঁ, মানে যে ঘরে রাগিনীকে সেন্সলেস অবস্থায় পাওয়া গেছিল... যেখানে।
- কী ভাবে পড়েছিল… মেঝেতে? উপুর হয়ে না চিৎ হয়ে?
- আমরা চিৎ হওয়াই দেখেছি… আর… আমার মনে হয় না কেউ টাচ করেছিল ওকে।
- শিওর?
- না… আগেন, শিওর হওয়া সম্ভব না। বাট মনে হয়…
- কেউ সাহস পাচ্ছিল না, আপনারা যাওয়ার আগে ওকে টাচ করতে… তাই তো?
- কুড বি।
- সেন্সলেস হল কী করে? পড়ে গিয়ে? ভেতরে একটি মেয়ে বলল সে রুমমেট… সে দেখেছে বাথরুমে পড়ে সেন্সলেস হয়ে যেতে।
- হুম ওই বাথরুমেই…
- আপনারা বাথরুমেই পড়ে থাকতে দেখেছেন?
- অফকোর্স।
- দেখুন… আপনারা হয়ত মনে মনে আমাকে খিস্তি করছেন। স্বাভাবিক। বাট আমাদের এই কনভার্সেশনটা একটু নিজেরা মনে মনে রিপিট করে দেখবেন… অ্যান্ড বি থ্যাংকফুল যে আমি পুলিশ নই।
কথাটা শুনেই কৃষাণুর মাথার ভেতরে কেমন ঝিমঝিম করে উঠল, হঠাৎ করে প্রেশার লো হয়ে গেল যেমন হয়। বুঝতে পারল, মজার ভেতর পায়ের পাতায় একটা শিরশির করা অস্বস্তি জেগে উঠছে। ভীষণ ঘুম পেলেও যখন ঘুমনো যায়, শরীর বা মাথা না চললেও জোর করে কিছু করতে হয়-- একটা অন্য রকম কষ্ট হয়। যা করতে চাইছে আর যা করছে-- তার মধ্যে সামঞ্জস্য থাকে না। যা ভাবছে আর যা বলছে-- তার মধ্যে তা আউট অফ সিংক হয়ে যায়। অনেকক্ষণ একটানা চলার পর যেমন যন্ত্রের মটর গরম হয়ে যায়, পারফর্মেন্সের সমস্যা দেখা দেয়-- অনেকটা সেরকম। কৃষাণু দেখল, ঘড়িতে তখন রাত দুটো বেজে গেছে। মনে হল ওর শরীরের কলকব্জাগুলোতেও এবারে পারফর্মেন্স ইস্যু হচ্ছে। এসব তারই লক্ষণ। মনে হল-- এই প্রসঙ্গে যা-ই বলা হবে , এই লোকটা তার সুযোগ নেবে। ওদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করবে। এইখানে সবকিছুই যেন খুব হসটাইল হয়ে উঠছে আসতে আসতে।
‘ইন দ্যাট কেস আমরাই প্রোঅ্যাক্টিভলি লোকাল থানায় একটা ফোন করি... জেরাই যদি করার থাকে, পুলিশই করুক। ডাক্তার কেন? কী অপ্রতিমদা?’
কথাগুলো বলে নিজেরই কানে অদ্ভুত শোনালো কৃষাণুর। মাথার ভেতরের পারফর্ম্যান্স ইস্যু। শরীর এই সাজানো প্যাসিভ চেহারাটা ধরে রাখতে পারছে না আর। বেসামাল হয়ে যাচ্ছে। কৃষাণুর কথাগুলো শুনে চমকে ওর দিকে তাকাল অপ্রতিম। ডঃ দত্ত ফিক করে হেসে ফেললেন, মাথাটা নিচু করে নিজের আঙুলের নখগুলো দেখার একটা মন ঘোরানো খেলায় ডুবে গেলেন, হাসিটা ধরে রেখেই। আসলে, এই দুজনের দিকে তাকিয়ে হেসে ফেলার ব্যাপারটা যতটা এড়িয়ে থাকা যায়। অপ্রতিম তখনও বিরক্তি নিয়ে তাকিয়ে আছে কৃষাণুর দিকে। ইদানিং কৃষাণু যতটা পারে এড়িয়ে যায় অপ্রতিমকে, সেটাই স্বাভাবিক। বিরক্তি এবং ব্যক্তিগত বিবাদের জটিলতা প্রকাশ্যে আনতে চায় না। সন্ধ্যেবেলা যে অপ্রতিম অ্যাপোলোজেটিক ভাবে একটা অপরাধবোধ নিয়ে কৃষাণুর সঙ্গে কথা বলা আর না-বলার মাঝে ছিল... সে এখন ওকে জাজ করছে-- এটা আরোই অসহ্য লাগল কৃষাণুর। কিচ্ছু না বলে মুখটা অন্যদিকে ঘুরিয়ে বসে রইল। একটা ঘরে তিনটে লোক বসে। কেউ কারো সঙ্গে কথা বলছে না... প্রায় দু-তিন মিনিটের একটা দীর্ঘ নীরবতা।
© জয়দীপ চট্টোপাধ্যায়
অঙ্কন: ঋতুপর্ণা খাটুয়া
Comments
Post a Comment