ভালো থেকো নিশীথ অবশেষ — পর্ব ৬: জয়দীপ চট্টোপাধ্যায়
ভালো থেকো নিশীথ অবশেষ -- ৬ পর্ব
যা কিছু ঘটে, তা ব্যক্তিগত সীমানার ভেতরে হোক অথবা বৃহত্তর পরিসরে, তা বেশিরভাগটাই ঘটে অপরিকল্পিত ভাবে। অপ্রত্যাশিত ভাবে। সব সময়ে সব কিছুর ফলশ্রুতি আঘাত হয়ে নেমে আসে না। প্রভাবটা সেভাবে ধাক্কা দেয় না-- তাই এই অপ্রত্যাশিত বা অপরিকল্পিত ভাবে আগমনটা সয়ে যায়। সয় না তখনই, যখন আঘাতটা অনুভূত হয়। সরাসরি প্রভাব পরে আমাদের মনে, আমাদের জীবনে। পাশের বাড়ি, পাড়া, শহর, দেশ... একটু একটু করে সীমানাটা বাড়াতে থাকলে-- একটু বেশি এসব নিয়ে ভাবলে লজ্জা বাড়বে। অপরাধবোধও ঘিরে ধরতে পারে। কত সহজেই আমার সব রকম বিচ্যুতি, আত্মকেন্দ্রিকতা, স্বার্থপরতা, নিদারুণ নিষ্ঠুরতা-- সব কিছুকেই এড়িয়ে যেতে এবং উপেক্ষা করে যেতে পারি, কেবল মাত্র আমরা নিজেরা তার দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত নই বলে। তার শিকার নই বলে। আমরা গাছ কেটে ফেলতে দেখি, বস্তি উচ্ছেদ হয়ে যেতে দেখি, স্বাভাবিক প্রশাসনিক পরিষেবা থেকে বঞ্চিত হতে দেখি, প্রাপ্য আদায়ের জন্য ভিক্ষে করতে দেখি, কুকুরের মত রাষ্ট্রের সেবকদের হাতে মার খেতে দেখি মানুষকে... দেখি তো? আমাদের সয়ে গেছে। পরিবর্তনের সঙ্গে অ্যাডপ্ট করতে করতে আমাদের শরীরের ভেতরে অনেক কিছুই বদলে যাচ্ছে, পরের প্রজন্মে আরোই বদলে যাবে। মাঝে মাঝে দাঙ্গা, যুদ্ধ, অতিমারী, আর্থিক সংকট, রিসেশন... এগুলো এলে আরো স্পষ্ট হয়ে যায় এই ক্রমশ অসাড় হয়ে যাওয়া অনুভূতিগুলির প্রসঙ্গ। কিন্তু এই অপ্রত্যাশিত ভাবে, একবারেই হঠাৎ কিছু সামনে এসে অপ্রস্তুত করে দেবে... এর তো শেষ নেই। প্রতিটা দিনই এমন কিছু না কিছু, কেউ না কেউ... অপ্রস্তুত করে দিচ্ছে, করে দেয়। শুধু অভিঘাতের মাত্রা আলাদা, আমাদের জানা বা না জানা, বোঝা বা না বোঝার অন্তরায় আপেক্ষিক।
ক্লাবের ফাইনাল ম্যাচের ঠিক চার দিন আগে বাইক অ্যাক্সিডেন্টে ফেমার বোন ফ্র্যাকচার হয়ে গেল, ফাইনাল তো গেলই... আর ক্লাব স্তরে ফুটবলই খেলা হল না কৃষাণুর। মন দিয়ে বিটেক পাশ করতে কেটে গেল কলেজ জীবন। মধ্যবিত্ত পরিবার, চাকরিটাও খুব জরুরি। প্যাশনের মত শব্দকে এসব গলিতে লালন করা আলাদা অঙ্গীকার, সে কথা আলাদা... কিন্তু এইসব দ্রুত সরিয়ে দেওয়ার জন্য এবং ঝরে যেতে দেখে আশপাশের লোক যে ধর্ষকামী সুখ পায়-- সে আর এক দাঁত চেপে সহ্য করার ব্যাপার। পরামর্শ দিতে আসা মানেই সবার আগে ব্যতিক্রমী কিছু করতে বা ভাবতে হতোদ্যম করা। বাবা-মাকে বোঝানো-- এসব অনিশ্চিৎ ভবিষ্যৎ, ঝুঁকির পথ, সময় নষ্ট, ইত্যাদি। কৃষাণুর আর ভালো লাগছিল না। চাকরি পেয়েই চলে গেল রাজ্য ছেড়ে, অন্য শহরে। কৃষাণুর বাবা যেদিন বাজার থেকে এসে বলল 'শরীরে একটা অস্বস্তি হচ্ছে', বাড়িতে কেউই বোঝেনি যে দু ঘন্টার মধ্যে একটা স্ট্রোক হয়ে বাঁদিকটা প্যারালিসিস হয়ে যাবে। অবসর জীবনটা ভালো করে কাটানোর অনেক পরিকল্পনা ছিল। এখন সেখানে ফিজিওথেরাপির ভরসায় কোনো ক্রমে পা টেনে হাঁটছেন হাতে ছড়ি নিয়ে। কৃষাণু প্রস্তুত ছিল না বিয়ের ক মাসের পরেই এমন একটা পারিবারিক দুর্যোগের জন্য। অতসীকে যে সময়টা দিতে পারত, তা আর দিতে পারল না মানসিক ভাবে... শারীরিক ভাবেও। অতসী যে অপ্রতিমের সঙ্গে একটা সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েছে-- সেটাও জানল হঠাৎই। তার জন্যেও প্রস্তুত ছিল না। অতসী একটা কর্তব্য সারার মত জানিয়ে যে নিজেকে দূরে সরিয়ে নিল, কোনোরকম বোঝাপড়ার জানলা খোলা না রেখে-- তাও একেবারেই অপ্রস্তুত করে। জীবন যে এভাবে বার বার অপ্রস্তুত করে কৃষাণুকে, কৃষাণুর ইচ্ছে হয় এর প্রতিশোধ নিয়ে। বেশ কৌশল করে একজিকিউট করা প্রতিশোধ-- সেও চমকে দেবে, অপ্রস্তুত করে দেবে সবাইকে তার কোনো সিদ্ধান্তে বা পদক্ষেপে। কিন্তু সেই সুযোগ আর পায় না। আশংকাও থাকে, ধাক্কা দিতে গিয়ে নিজেই যদি আহত হয়ে যায়!
অপ্রতিমের পাশে বসে এইসব কথাই মনে হচ্ছিল বেশি করে। 'কী থেকে কী হয়ে গেল হঠাৎ!'। শরীরটা এমনিতেই ঠিক লাগছিল না, ভাবছিল রাতে একটু ভালো করে ঘুমোবে, কিন্তু... । এমন অপ্রত্যাশিত ভাবে, এভাবে অসুবিধের মধ্যে ঠেলে দিয়ে, অপ্রস্তুত করেই জীবন ঠাট্টা করে বার বার। কৃষাণুর রাগ হয়, বিরক্তি আসে। চোয়াল শক্ত করে তাকিয়ে থাকে জানলার বাইরে। বাইরে বয়ে যাওয়া ঠান্ডা বাতাসের ঝলকটা ঠান্ডা জলের ঝাপটার মত মুখের ওপর অনুভব করার চেষ্টা করে। যদি মনটা শান্ত হয়, অন্য সব ঘিরে ধরা অবসাদময় চিন্তাগুলো সরে যায় বাতাসের ঝাপটায়। ঘামে ভেজা মুখে, ঠান্ডা হাওয়া লাগলে একটা আড়াম লাগে। সেই আড়ামটা খোঁজার চেষ্টা করছে কৃষাণু। কারো সঙ্গে কোনো কিছু নিয়ে কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। মেয়েটাকে হাসপাতালে নিয়ে না যাওয়া অবধি এমনিতেই কিছু করার নেই।
নিঝুম রাত, গ্রামাঞ্চলে গভীর রাতে গাড়ি দ্রুত চালানোর সুবিধে-অসুবিধে দুই-ই আছে। তারপর গাড়ি যে চালাচ্ছে, স্থানীয় মানুষ। তার নিজেরও সুবিধে-অসুবিধে আর মত প্রকাশের একটা আপার হ্যান্ড আছে। মোবাইল ফোনে দেখানো রুট যে সঠিক নয়, সেই রুটে গেলে সমস্যা-- সেই সব কারণে সে একাধিক পরামর্শ নাকচ করে নিজের মতই এগোচ্ছে। ওদের এই নিয়ে চ্যালেঞ্জ করার অবকাশ নেই এখন। মেয়েটাকে যত দ্রুত সম্ভব নিয়ে যেতে হবে একটা হাসপাতাল অথবা নার্সিংহোমে। টাউন অঞ্চলে যেতে পারলে তবেই তা সম্ভব। এরাই ভালো জানে, কোন হাসপাতাল বা নার্সিংহোম যাওয়ার মত। রাগিনীর মাথাটা অনশুর কোলে। ওর মুখের দিকেই একটানা তাকিয়ে বসে আছে টায়রা। অপ্রতিম বা অন্য কেউই এই দিকের রাস্তা চেনে না, হোটের লোকটা আর মোবাইল ফোনে দেখানো রুটের দিগদর্শনই ভরসা। অপ্রতিম একটানা ফোনের দিকেই তাকিয়ে আছে... কাছাকাছি হাসপাতাল আর তার থেকে দূরত্ব কতটা কমছে, দেখে যাচ্ছে। আরো আধ ঘন্টা, আরো কুড়ি মিনিট... আরো... । হঠাৎ টায়রার মনে হল রাগিনীর ঠোঁট-দুটো অল্প নড়ছে, ঘুমের ঘোরে বা স্বপ্ন দেখতে দেখতে কেউ কিছু বলার চেষ্টা করলে যেমন হয়। কিন্তু কী বলতে চাইছে ঠিক বোঝা গেল না। অনশু লক্ষ করেছে... একবার বড়ো বড়ো চোখ করে তাকালো টায়রার দিকে, টায়রার বাঁ-হাতটা শক্ত করে ধরল বিস্ময় নিয়ন্ত্রণ করতে। ওরা আরো কিছুক্ষণ দেখল... চোখ বন্ধ, কিন্তু মাঝে মাঝে অল্প ঠোঁট নড়ছে। অনশু আসতে আসতে রাগিনীর মাথায় হাত বুলিয়ে ভয় পেতে বারণ করল, চিন্তা করতে বারণ করল। রাগিনী আদৌ কিছু শুনতে পেল কি না, বুঝতে পারল কি না-- বোঝা গেল না। টায়রা অনশুর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল-- 'ঠান্ডে পানি সে চেহরা পোঁছকে দেখুঁ ফিরসে?'। কৃষাণু কিছু একটা জিজ্ঞেস করতে গেছিল পেছন ফিরে, অপ্রতিম ওর হাত চেপে বারণ করল কিছু বলতে। গাড়ির চালক, সেই রিসর্ট কর্মী… ‘ম্যডামের সেন্স এসে গেছে? এসে গেছে?’ এমন বার কয়েক জিজ্ঞেস করতে অপ্রতিম বলল ‘আর কতক্ষণ লাগবে দাদা? দেখুন না, সোজা গিয়ে ডান দিকের রাস্তা নিয়ে বলছে... একটু তাড়াতাড়ি চালান না প্লিজ?’
ঘড়িতে তখন প্রায় রাত দুটো, ম্যাপ দেখে মনে হচ্ছে, আরো মিনিট পনেরো লাগবে হাসপাতালের কাছে পৌঁছতে। তারপর লোকটা বোধহয় কাঁচা ঘুম ভেঙে উঠে এসেছে… বার বার চোখ কচলাচ্ছে। অপ্রতিম ইচ্ছে করেই মাঝে মাঝে কথা বলে যাচ্ছিল লোকটার সঙ্গে। আর তিন-চার কিলোমিটার দূরে দেখাচ্ছে যখন, অপ্রতিম একবার জিজ্ঞেস করল, অসুবিধে হচ্ছে কি না... ওরা নিজেরা কেউ বাকিটা ড্রাইভ করবে কি না। ‘না না… এই তো এসেই গেছে!’ বলে লোকটা গাড়ি চালানোয় মন দিল। মনে হল, গাড়ি হাতছাড়া না করাও একটা নির্দেশ ম্যানেজারের। গাড়ি চালাতে চালাতেই মাঝে মাঝে মাথার ওপর রেয়ার ভিউ মিররে চোখ রেখে দেখার চেষ্টা করছিল-- পেছনে ঠিক করছে মেয়ে দুটো। কী বলছে, কী ইশারা করছে নিজেদের মধ্যে...
হাসপাতালের কাছাকাছি গাড়ি আসতেই অপ্রতিম কৃষাণুকে চোখ দিয়ে ইশারা করে বলল ফোনটা দেখতে। কৃষাণু বুঝতে না পেরে চেক করে দেখল অপ্রতিমেরই ম্যাসেজ। লিখেছে– ‘যা বলব, এই মালটা শুনবে, রিসর্টে রিপোর্ট করবে… সাবধানে কথা বলিস। ডাক্তারকে কী বলবি আগে থাকতে ঠিক করে রাখ। বল বাথরুমে সেন্সলেস হয়ে গেছিল। মেয়েগুলোকেও ওই একই কথা বলতে টেক্সট করে দে। মোটামুটি ফার্স্ট এইড করিয়ে এখান থেকে বেরোতে পারলেই হল। উই ডোন্ট নীড দিস টু স্ক্রু আপ থিংস ফার্দার।’
কৃষাণুও দ্রুত উত্তর করে পাঠাল, ড্রাইভারের নজর এরিয়ে অপ্রতিম পড়ে নিল, ছোট্ট উত্তর–
'মেয়েগুলোকে টেক্সট করলে, ওটাও বাজে প্রুফ হয়ে থাকবে। যা বলার মুখেই বোঝানোর চেষ্টা করব। হোপ বুঝবে।'
গাড়ি এসে যখন থামল হাসপাতালের সামনে, তখন সেখানে খুব অল্প কিছু লোক। যেমন গভীর রাতেও হাসপাতালের সামনে মানুষের আনাগোনা লেগে থাকে… কারো না কারো সংকট এসেই পড়ে। আসলে হাসপাতালই নয়, স্থানীয় ছোটোখাটো নার্সিংহোম। পরিকাঠামোও খুব একটা ভালো বলে মনে হল না বাইরে থেকে দেখে। কিন্তু এখন অত বাছ-বিচার করা বিলাসীতা। অপ্রতিম ওই চালক লোকটিকে সঙ্গে নিয়ে ছুটে গেল নার্সিং হোমের সিকিওরিটি-গার্ডদের সঙ্গে কথা বলতে… যে এখন কোনো ডাক্তার আছে কি না। সেই ফাঁকে কৃষাণু চেষ্টা করল নিজের মত করে অনশু আর টায়রাকে বোঝাতে, যে এখানে বেশি ডিটেলস বলে পরিস্থিতি জটিল করে কারো সুবিধে হবে না, সকলের বিপদ বাড়বে। এখানে তারা বহিরাগত, সকলেই সন্দেহের চোখে দেখবে তাদের। একরকম নিজের ম্যানেজমেন্ট স্কিলের ওপর আস্থা রেখেই যতটা ঠান্ডা ভাবে পারে ব্যাপারটা ওদের বোঝানোর চেষ্টা করল… এমন ভাবে যে ক্ষতিটা ওদেরই বেশি হবে, এমন কি রাগিনীর পক্ষেও ব্যাপারটা খুব অসুবিধেজনক হবে যদি এই পুরো ঘটনাটা ভুল দিকে গড়ায়। তার চেয়ে প্রাথমিক চিকিৎসা করে সকাল হতেই এখান থেকে সোজা কলকাতা গিয়ে ভালো কোথাও ট্রিটমেন্ট করা দরকার। এইসব মফঃস্বল অঞ্চলের নার্সিংহোমের ওপর ভরসা করা যায় না। এ তো সদরের সরকারী হাসপাতালও না। টায়রা সব কিছু শুনে বলল ‘রাগিনীকেও তো জিজ্ঞেস করবে… হোয়াট ইফ শী স্পিকস ডিফারেন্টলি?’
ওরা তিনজনেই কথা থামিয়ে তাকাল রাগিনীর দিকে। রাগিনী তখনও অনশুর কোলেই মাথা রেখে শুয়ে।অচৈতন্য অবস্থাতেই অস্ফুটে কিছু বলে যাচ্ছে, ঠোঁট নড়ছে।
‘পেশেন্ট কোথায়?’
সিকিওরিটি গার্ডের মত লোকটা গাড়ি আসতে দেখেই বুঝেছিল এদের কিছু বিপদ হয়েছে। বিপদ ছাড়া এত রাতে কে-ই বা আসে নার্সিংহোমে! তার ওপর দেখেই বোঝা যাচ্ছে এখানকার নয়, বাইরে থেকে এসেছে। অপ্রতিমের আগে ওদের সঙ্গে আসা লোকটি বলে উঠল ‘গাড়িতে আছে… লেডিজ… এমার্জেন্সিতে কেউ নেই?’ ‘লেডিজ?!’ বলে এক অদ্ভুত বিস্ময় আর সন্দেহ মেশানো দৃষ্টি নিয়ে সেই সিকিওরিটি গার্ডটা তাকাল আবার ওদের গাড়ির দিকে। বোঝার চেষ্টা করল, ভেতরে কারা বসে আছে। ব্যাপারটা আদৌ খুব একটা সুবিধের কি না। অপ্রতিমও এবার একই ভাবে জিজ্ঞেস করল– ‘কেউ নেই এমার্জেন্সিতে?’ সিকিওরিটি গার্ড লোকটা অপ্রতিমকেও পা-থেকে মাথা অবধি ভালো করে দেখল। তারপর চেয়ার ছেড়ে উঠে ভেতর চলে গেল প্যান্টের ওপর দিয়ে পেছন চুলকোতে চুলকোতে। ভেতর থেকে গলার আওয়াজ পেয়ে মনে হল, সে-ই ডাকছে কাউকে… ‘নিত্যদা-আ-আ… ও-ও নিত্যদা-আ-আ… ঘুমিয়ে পড়লে নাকি-ই-ই?’
কিছুক্ষণ পর সেই সিকিওরিটি গার্ডের সঙ্গে আর একজন লোক এলো, রোগাটে গরণ… মাথায় কাঁচাপাকা চুল। ভুঁরু কুঁচকে সব কিছু দেখতে দেখতে বলল– ‘পেশেন্ট কোথায়? কী হয়েছে?’
কৃষাণু গাড়িতে বসেই দেখতে দেখতে বুঝতে পারল, গড়িমিশি আর জিজ্ঞাসাবাদ চলছে। একবার ভাবল গিয়ে দেখবে। তারপর মনে হল গাড়িতে তিনটে মেয়ে বসে, তাও একজন অসুস্থ– ওর গাড়িতে থাকাই ভালো। অপ্রতিম কিছু একটা বোঝানোর চেষ্টা করছে, সম্ভবতঃ নিজের মত করে বলছে– কে অসুস্থ, কী বৃত্তান্ত। মেয়েদের কিছু হয়েছে জানলে এমনিতেই এইসব নার্সিংহোম হসপিটালের স্টাফরা অতি সচেতন হয়ে যায়। তার ওপর এমন গ্রাম-গঞ্জের মাঝে… এমন অসময়ে। ‘অপ্রতিমদা ঠিক কী বলছে, সেটা বুঝতে পারলে ভালো হত।’, কিছু একটা করতে না পারার আফসোসে মিচ্ করে একটা শব্দ করল কৃষাণু, ঘাড় ফিরিয়ে দেখার চেষ্টা করল রাগিনী কী করছে। ওর মনের কথা হয়ত কিছুটা বুঝতে পারল টায়রা, বলল – ‘মনে হয় এবার জ্ঞান ফিরে আসবে… আই থিংক…’
কৃষাণু ওর দিকে সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকালো। গলায় সংকোচের সুর নিয়েই বলল টায়রা– 'আই থিংক… শি ওয়াজ ড্রাগড।' অনশু বড়ো বড়ো চোখ করে ওর দিকে তাকাল। কৃষাণু শুধু বলল– 'কুড বি।' তারপর কিছুক্ষণ থেমে বলল– 'শি ওয়াজ ড্রাগড বললে মনে হয় কেউ জোর করে…'
টায়রা তাকালো ওর দিকে, কিছু বলল না। অনশু মাথা নিচু করে রাগিনীর দিকে তাকিয়ে বসে রইল। রাগিনী কপালে আর ঘাড়ে জমে থাকা বিন্দু বিন্দু ঘাম, রুমাল দিয়ে মুছিয়ে দিল।
রিসর্টের লোকটির সঙ্গে সিকিওরিটিগার্ড এসে গাড়ির জানলার কাছে এসে দাঁড়াল। রিসর্টের লোকটি কাচের সামনে মুখ নামিয়ে বলল– একটা হুইল চেয়ার আছে, আপনারা কি ম্যাডামকে ধরে ধরে বসিয়ে দিতে পারবেন... নাকি স্ট্রেচার লাগবে? গাড়িটা দরজার কাছ অবধি নিয়ে যেতে দেবে কি না দেখব? কৃষাণু কোনো উত্তর দেওয়ার আগেই সিকিওরিটি গার্ড লোকটা হাতের টর্চ জ্বালিয়ে গাড়ির পেছনের সিটে আলো ফেলল। অনশু আচমকা চোখে আলো পড়ায় হাত দিয়ে মুখ ঢাকল। তারপর সেই টর্চের আলো গিয়ে পড়ল রাগিনীর ওপর। টায়রা কৃষাণুর দিকে তাকাতে, কৃষাণু বলে উঠল… ‘কোন দিকে যেতে হবে বলুন, আমি ড্রাইভ করে নিয়ে যাচ্ছি। টায়রা… তোমরা ওকে ধরে ইজি চেয়ারে বসাতে পারবে তো? নাকি স্ট্রেচারই সেফ হবে?… কী মনে হয়?’
একজন অ্যাপ্রন পরা অল্পবয়সী লোক ততক্ষণে নার্সিংহোমের দরজার কাছে এসে দাঁড়িয়েছে। হাতে স্টেথোস্কোপ। হাই তুলতে তুলতেই পাশের মাঝবয়সী লোকটিকে বলল ‘স্ট্রেচার নিয়ে আসুন… এটা হুইল চেয়ারের কেস মনে হচ্ছে না দেখে ।’ গাড়ির হেডলাইট জ্বলে উঠতে যেভাবে চোখটা হাত দিয়ে ঢেকে আড়াল করল, বোঝাই যাচ্ছে কাঁচা ঘুম এখনো কাটেনি।
অপ্রতিম তাকিয়ে তাকিয়ে লক্ষ করছিল নার্সিং হোমের ডাক্তারকে। মনে হল কেবল ইনিই আছেন একা নাইট ডিউটিতে। আর দুজন নার্সিং স্টাফ। একজন মহিলা আর একজন পুরুষ। দুজনে ভেতরে চেয়ারে বসে ঢুলছিল। ডাক্তার বেরিয়ে আসতে, বাধ্য হয়ে ওদেরও পেছন পেছন এসে দাঁড়াতে হল। পুরুষ স্টাফটির হাতে চাকা লাগানো স্ট্রেচার, ঠেলে ঠেলে বাইরে নিয়ে এসে সিঁড়ির ধাপ দিয়ে নামাল। কৃষাণু আর অনশু সেই স্টাফের সাহায্যে রাগিনীকে গাড়ি থেকে বার করে স্ট্রেচারে শুইয়ে দিল। এই প্রথম রাগিনী কোনো স্টিমুলাসে সাড়া দিল, চোখে আলো পড়তে এক হাত দিয়ে মুখটা ঢাকল… উহ্ করে একটা শব্দ করল অস্ফুটে। জ্ঞান এসেছে... তবে চোখ খুলতে পারছে না ঠিক করে। অপ্রতিম মনে মনে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল রাগিনীর জ্ঞান ফিরতে দেখে, কিন্তু তাও একবার মনে মনে ঝালিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করল-- ডাক্তার জিজ্ঞেস করলে কীভাবে ব্যাপারটা প্রেজেন্ট করতে হবে। কৃষাণুকে চোখের ইশারায় বলল রিসর্ট থেকে আসা চালকটিকে একটু নজরে রাখতে। রাগিনীকে নিয়ে সেই পুরুষ স্টাফ আবার স্ট্রেচারটি যত্ন করে সিঁড়ির পাশের ঢালু পথ দিয়ে ঠেলে নার্সিং হোমের গেট দিয়ে ভেতরে নিয়ে গেল। সঙ্গে আসা নার্স মহিলাটিও চলে গেল তার পেছন পেছন। টায়রা আর অনশুও গেল ওদের সঙ্গে। সেই ডাক্তার ভদ্রলোক বললেন ‘টেম্পারেচার, প্রেশার… এই দুটো দেখুন। আমি আসছি।… আর হ্যাঁ, চোখ-মুখ ভিজে কাপড় দিয়ে মুছিয়ে দিলে ভালো হয়!’ শেষের কথাগুলো একটু জোরেই বলতে হল, নার্স ততক্ষণে এমার্জেন্সি চিকিৎসার ঘরে ঢুকে পর্দা টেনে দিয়েছে। পুরুষ স্টাফটি বেরিয়ে এলো, এসে আবার বসে পড়ল ওর আগের চেয়ারে। সিকিওরিটি গার্ডও ততক্ষণে নিজের চেয়ারে সে বসে পড়েছে। তার মোবাইল ফোনে শুরু হয়ে গেছে চিনচিনে স্বরে হিন্দি গান। মাঝবয়সী ভদ্রলোক ঠিক কী, বোঝা যাচ্ছিল না। উনি আবার গেলেন রিসর্টের লোকটার কাছে। নিজেদের মধ্যে চাপা গলায় কী বলছেন ঠিক বোঝা গেল না। অপ্রতিম কৃষাণুকে চোখের ইশারায় বোঝালো ওরা কী বলছে শুনতে। কৃষাণু ওদের দিকে যেতেই নার্সিংহোমের মাঝবয়সী ভদ্রলোক বলে উঠলেন– ‘আমাদের কিন্তু লোকাল থানায় একটা খবর দিতে হবে। এটাই রুল। আগে হলে থানাকে এখনই জানাতে বলতাম। তবে এখন…’ কৃষাণু কথাটা শুনেই মেজাজ হারিয়েই বলে ফলল– ‘এক্সটারনাল ইঞ্জিওরি নেই, ব্লাড শেড নেই, কোনো রকম ট্রমা নেই… কীসের পুলিস কেস?’ অপ্রতিম সঙ্গে সঙ্গে নার্সিং হোমের সিঁড়ি থেকে নেমে এসে ওদের মাঝে গিয়ে বলল– ‘না না… উনি হয়ত এখানকার স্ট্যান্ডার্ড নিয়মের কথা বলছেন। ঠিক আছে দাদা, আগে ডাক্তারবাবু দেখুন… সেরকম কিছু মনে হলে নিশ্চয়ই জানাবেন। আমরা তো জানি কী ঘটেছে… দুশ্চিন্তার কোনো কারণই নেই।’
‘দুশ্চিন্তার কারণ ছাড়াই এত রাতে এখানে ছুটে আসতে হল?’-- প্রশ্নটা শুনেই ঘুরে দাঁড়ালঅপ্রতিম। সেই এমার্জেন্সির চিকিৎসক এখনো ভেতরে জাননি। ওখানেই দাঁড়িয়ে। প্রথমে মনে হল, একবার বলে– আগে ভেতরে গিয়ে পেশেন্টকে দেখতে, তারপর এসব জিজ্ঞেস করতে। তারপর মনে হল– আপাতত এদের দিয়েই কাজটা উদ্ধার করতে হবে। আর চটালে এখন থানা-পুলিশ করাবে, দেখবেও না ঠিক করে। উলটে আবোলতাবোল কিছু পুলিশের কানে তুললে সেটা ভাঙাতেই কাল-ঘাম ছুটে যাবে সবার। অফিসে তো যা হওয়ার হবেই, মিডিয়া অবধি চলে যাবে ব্যাপার। একসাথে এতগুলো কলীগের নাম জড়াবে ফর নাথিং। নিজের অসন্তোষটা গিলে নিয়ে যতটা সম্ভব উদ্বেগ আর উৎকন্ঠা মিশিয়ে অপ্রতিম বলল– ‘ডাক্তারবাবু… ওকে বাথরুমে ওভাবে আনকশাস পড়ে থাকতে দেখেই আমরা যথেষ্ট প্যানিকড হয়ে গেছিলাম। মাথায় চোট লেগে থাকলে, যদি কিছু একটা ভালো-মন্দ… সবাই মিলে রিসর্টে বেড়াতে এসছি, ডিনার করে ঘুমোতে যাব… আর এই বিপদ! কী যে যাচ্ছে আমাদের মনের ওপর দিয়ে!’
- আপনারা ওর কে হন? বন্ধু?
- কলীগস… অফিস কলীগ।
- পিকনিকে এসেছিলেন?
- না… অফিস স্পন্সর্ড টীম আউটিং। আপনাকে সবই বলব ডাক্তারবাবু। আমাদের কিছুই লুকনোর নেই। ফ্রিক অ্যাক্সিডেন্ট একটা… আপনি প্লিজ আগে একবার ওকে অ্যাটেন্ড করুন। তারপর যা জিজ্ঞেস করার, যা ফর্ম্যালিটিজ সব হবে।
রিসর্টের লোকটাও সুর মিলিয়ে বলল, ‘হ্যাঁ, আপনি একবার দেখে নিন। আমাদেরও খুব চাপ যাচ্ছে।’
‘আপনি?’ বলে সন্দেহর দৃষ্টি নিয়েই ওর দিকে তাকালেন চিকিৎসক। লোকটা কিছু বলার আগেই অপ্রতিম বলল, ‘উনি রিসর্টের কর্মচারী। আমরা এদিককার কিছুই চিনি না… উনিই আমাদের…’
‘আচ্ছা… আচ্ছা। আপনারা একটু ওয়েট করুন। আমি ডাকব একটু পরে। নিত্য দা, আপনি এখানেই থাকুন এঁদের সঙ্গে। নাম-ঠিকানা এগুলো একটু লিখে নিন। অ্যাড্রেস প্রুফ, আইডি কিছু আছে কি না দেখুন। পুলিশ এগুলো জানতে চাইবে, তখন ফাঁসব আমরা।’ ‘ফাঁসব আমরা’ কথাটা বলে অপ্রতিম আর কৃষাণুর দিকে একবার তাকিয়েই দ্রুত ভেতর দিকে হেঁটে চলে গেলেন চিকিৎসক। কিছুক্ষণ আগে অবধি যে ঘুমের ভাবটা চোখে-মুখে ছিল, সেটা কেটে গেছে একেবারেই। ডাক্তারকে দেখে মনে হয় ত্রিশেরই কাছাকাছি বয়স। এত অল্পবয়সে এইরকম অঞ্চলে এমন নামহীন নার্সিংহোমে কেন পড়ে আছে ভাবলে অনেকরকম চিন্তাই মাথায় আসে। এমন কি চিকিৎসকের যোগ্যতা নিয়েও। হয়ত মাথাটা গরম করে দিল বলেই যোগ্যতাকে ঘিরে প্রশ্নগুলো বেশি খোঁচাচ্ছে, এক রাশ বিরক্তির ইন্ধনে। ‘একটা সাধারণ এমবিবিএস, এই ফালতু নার্সিং হোমে রাতে ঘুমিয়ে কাটায়। বাঁশের চেয়ে কঞ্চি দড়… আসলে কোথাও পাত্তা পায় না যারা, তারা এইসব কেস-এ জাস্ট পাত্তা পাওয়ার জন্য এমন প্যাঁচে ফেলার চেষ্টা করে। এই কারণে যদি লোকে খোশামোদ করে, হাতে-পায়ে ধরে। জীবনে তো কেউ কোনো কিছুর জন্য রিকোয়েস্ট করে না এসব মালকে! হাজারটা ডাক্তার পাশ করছে প্রতি বছর, কোথাও কিছু জোটেনি বলে এইখানে পড়ে আছে! ‘গ্রীন অ্যাঞ্জেল নার্সিং হোম’... গ্রীন অ্যাঞ্জেল নাকি! নামও দিয়েছে দু নম্বরী হোটেলের মত।’ নিজের মাথায় এক রাশ বিরক্তি গিজগিজ করলেও অপ্রতিম কৃষাণুকে আবার চোখের ইশারায় বলল– বেশি রিয়্যাক্ট না করতে।
- আপনারাও এনার কলীগ?
- হুম।
- দুজনেই?
- হুম… কেন?
- ইনি যখন সেন্সলেস হয়ে গেছিলেন… আপনারা ছিলেন?
‘না’, ‘হ্যাঁ’-- টায়রা আর অনশুকে দুটো আলাদা উত্তর দিতে দেখে চিকিৎসক দুজনের দিকেই একবার করে তাকালেন। তারপর চুপ করে তাকিয়েই রইলেন ওদের দিকে। টায়রা বলল, ‘ও ছিল না… আমি ছিলাম। আমি দেখেছি।’
- আপনি ওনার রুমে ছিলেন?
- হুম…
- বাথরুমের ডোর খোলা ছিল?
কয়েক মুহূর্ত চুপ করে রইল টায়রা, তারপর বলল… ‘দরজা ভেতর থেকে বন্ধ ছিল না বলেই সঙ্গে সঙ্গে আওয়াজ পেয়ে ঢুকতে পেরেছি। না হলে লোক এনে দরজা ভাঙতে হত… কী হত জাস্ট ভাবতে পারছি না। থ্যাংক গড মাথা-টাথা ফেটে যায়নি।’ কথাগুলো প্যানিক করার মত করেই তাড়াতাড়ি বলে রাগিনীর দিকে তাকিয়ে রইল টায়রা। রাগিনীর ঘুম-ঘুম ভাবটা মনে হল কাটছে, ঝিমুনি আছে চোখে… তন্দ্রাচ্ছন্ন ভাবে শুয়ে আছে। অনশু আড়ষ্ট হয়ে বসে আছে, ইন্টেরোগেশনের সামনে বসার মত। ওকে দেখেই বেশি মনে হচ্ছে যে ওরা ভয় পেয়েছে। অস্বস্তির মধ্যে আছে। টায়রার মনে হল, অনশুকে বাইরে অপ্রতিমদাদের কাছে রেখে এলেই ভালো হয়। বা যদি কোনো ভাবে ওকে এখান থেকে বাইরে পাঠাতে পারে কিছু একটা ছুতোয়। এই ডাক্তারটা কেমন যেন লোক সুবিধের না, কিছু একটা সন্দেহ করছে… এর সামনে বেশিক্ষণ না থাকাই ভালো। ইচ্ছে করেই প্রসঙ্গ পালটানোর জন্য টায়রা বলে উঠল– ‘কেমন বুঝছেন স্যার? সিরিয়াস? স্ক্যান-ট্যান করতে হবে?’ চিকিৎসক নোটপ্যাডটা টেনে নিয়ে তাতে কলম ধরে বললেন ‘স্ক্যান তো এখানে সম্ভব নয়… ইকুইপমেন্ট নেই। করানোর কথাই রেকমেন্ড করব। কিন্তু… ’
কিন্তু?
- স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে… শি ইজ আন্ডার এফেক্ট অফ… আপনি তো রুম মেট, কী নেশা করছিল দেখেছেন?
-
- অবশ্য অফিসের পার্টি, কে কী খাচ্ছে, আর কে কাকে কী খাওয়াচ্ছে… কলেজেই বোঝা যায় না তার অফিসে…
-
- এনিওয়ে। যদি উনি এক ঘন্টার মধ্যে কিছুটা স্টেডি না হন, অথবা…
- অথবা?
- অথবা যদি কোনো প্রাইভেট পার্টস্-এর ট্রমা নজরে পড়ে… পুলিশ হয়ত ব্লাডে কিছু আছে কি না দেখতে চাইবে।
- হোয়াট?! প্রাইভের্ট পার্টস চেক করা হবেই বা কেন? কেউ বেড়াতে এসে পড়ে যেতে পারে না? আঘাত লাগতে পারে না? সব কিছুই কি ক্রাইমের অ্যাঙ্গেল থেকে দেখা হবে নাকি?
টায়রা রীতিমত উত্তেজিত হয়ে চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়ল। অনশু কাঁপা কাঁপা গলায় বলল ‘শুড উই কল আদারস?’ চিকিৎসক আবার প্যাডের দিকে তাকালেন, পেনের নিবটা কাগজের ওপর কিছুক্ষণ চুপচাপ ছুঁইয়ে রেখে বললেন ‘নাম?’
( চলবে)
© জয়দীপ চট্টোপাধ্যায়
অঙ্কন: ঋতুপর্ণা খাটুয়া
Comments
Post a Comment