ভালো থেকো নিশীথ অবশেষ — পর্ব ২ : জয়দীপ চট্টোপাধ্যায়


ভালো থেকো নিশীথ অবশেষ -- ২য় পর্ব 




‘অপ্রতিমদা কোথায়?’
কৃষাণুর গলার আওয়াজ পেয়ে চমকে উঠে পেছন ফিরে তাকাল টায়রা। বার্বিকিউয়ের এখানে একেবারে জমে উঠেছিল আড্ডাটা। ককটেল, মকটেল, বিয়ার ঘুরছে হাতে হাতে। রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে পাল্লা দিয়ে শীত নামছে বলে কেউ কেউ স্ট্রোলটা জড়িয়ে বা মাথায় হুডি টেনে কলেজ জীবনে ফিরে যেতে চাইছে। দুজন অভিনেত্রীর একেবারে  অপ্রত্যাশিত ভাবে অন্য কাউকে বিয়ে করে নেওয়ার প্রসঙ্গে টায়রার নিজস্ব মত প্রকাশ করে প্রতিবাদ জানানোর প্রয়াসটা থমকে গেল কৃষাণুর ডাক শুনে। ওকে দেখে মনে হচ্ছিল বলবে ‘আমি কী করে জানব!’ সঙ্গে সঙ্গে মুখ খুললে হয়ত তাই-ই বলে ফেলত। কিন্তু দু সেকেন্ড থমকে চেয়ে রইল, যেন ঠিক বুঝতে পারেনি প্রশ্নটা। ওর চোখে প্রশ্ন দেখে কৃষাণু আবার জিজ্ঞেস করল, ‘অপ্রতিমদা কোথায় গেল? দেখেছিস?’। ততক্ষণে দলের অন্যরা কৃষাণুর দিকে তাকিয়ে, প্রশ্নটা সকলেই বুঝতে পেরেছে। টায়রাকে জিজ্ঞেস করার কারণটাও… কেউ কেউ। প্রত্যুষ হাসি চাপার জন্য অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে বিয়ারের বোতল মুখে নিল। রাগিনী ইচ্ছে করেই রিপিট করল প্রশ্নটা ‘কাঁহা গ্যায় অপ্রতিম স্যার! তেরে সাথ হি তো থে?!’ টায়রা ওর দিকে তাকাল না, উঠে দাঁড়িয়ে একদম স্বাভাবিকভাবেই ফর্মাল অ্যাপলজি চাওয়া রিসেপশনিস্টের মত বলল, ‘দেখিনি গো… আমি উঠে চলে এসেছিলাম এদিকে, উনি ওদিকটা হাঁটছিলেন স্মোক করতে করতে… দেন আই ডোন্ট নো।’ ‘ওদিকটা মানে?’, পেছন ফিরে ‘ওদিক’-এ তাকাল কৃষাণু... টায়রার চোখের ইশারা অনুসরণ করে। এদিক ওদিক বিচ্ছিন্ন ভাবেই টিমের কেউ না কেউ ছড়িয়ে আছে। রিসর্টে ওরা একা আছে এমনও না, আরো দু-তিনটে পরিবার, গ্রুপ আছে। তাদের লোকজনও নিজস্ব অঞ্চলে হেঁটে বেড়াচ্ছে। অপ্রতিমদাকে দেখা যাচ্ছে না। ভিভান বলে অল্প বয়সী অবাঙালী ছেলেটা কানের ইয়ারফোন খুলে, হুডি নামিয়ে বলল– ‘অপ্রতিমদা উস তরফ গয়া হ্যায় কৃষাণুদা… দ্যাট সাইড। থোড়া হাই লগ রাহে থে।’ ‘উস তরফ’ মানে কিছুটা দূরে… রিসর্টের একটা প্রান্ত, যেদিকে আলো কম, গেস্টরা কেউ নেই… একটা অব্যবহৃত, পরিত্যক্ত অঞ্চলের মত। দুপুরের দিকে ওদিকটা দেখেছে কৃষাণু। কটা পুরনো মার্বেল পাথরের স্ট্যাচু, গাছ… একটা ছোট পুকুরের মত অযত্নে পড়ে থাকা জলাশয়। মনে হচ্ছিল ওদিকে রিনোভেশনের কাজ শুরু করবে। একদিকে ইট-বাঁশ-বালির বস্তা, কোদাল, বেলচা… এসব রাখা। একে অন্ধকার, রাত হয়ে গেছে… তারপর অমন একটা নির্জন দিকে পোকা-মাকড় সাপ-খোক থাকলেও অসম্ভব কিছু না। ‘এই লোকটা চিরকাল আনপ্রেডিকটেবল আর অস্বস্তিকর থেকে যাবে!’, মনে মনেই কথাগুলো বলে সেদিকে এগিয়ে গেল। পেছন থেকে ভিভান বলে উঠল ‘শুড আই জয়েন ইয়ু?’। কৃষাণু শুধু হাতের ইশারায় দরকার নেই বলে এগিয়ে গেল ।  ভিভান একবার হাঁক দিয়ে বলল, ‘প্লিজ কল মি ইফ নীডেড… হি সীমড হাই হাঁ! কুড  বি পিউকিং অর আউট!’ কানে ইয়ারফোনে গান চললে অনেকেই বুঝতে পারে না সে কতটা চেঁচিয়ে কথা বলছে। কৃষাণু পাত্তা না দিয়ে এগিয়ে গেলেও, আশেপাশে বসে থাকা সকলেরই কানে গেল কথাগুলো। টায়রা কেমন উদ্বিগ্ন হয়েই উঠে দাঁড়াল, তারপর অন্যদের কৌতূহল এড়াতে বলল… ‘ওয়ান মিনিট হাঁ… বাড়িতে একটা ফোন করে আসি।’ তারপর হাতের ফোনটায় নাম্বার ডায়াল করে, ফোনটা কানে নিয়ে রিসর্টের ইনডোরের দিকে এগিয়ে গেল দ্রুত। রাগিনী আর প্রত্যুষ একে অপরকে দেখে চোখ টিপে হেসে উঠল, একবার হাই-ফাই করে নিল হাসতে হাসতে। অন্যরা কেউ বুঝল, কেউ দেখাল বুঝেছি… তারাও হেসে উঠল একসঙ্গে।

     ‘একা একা এখানে বসে কী করছ?’
অপ্রতিম নিজের জ্যাকেটের জিপটা ভালো করে গলা অবধি টেনে শান বাঁধানো জমির ওপর বসেছিল, জলাশয়ের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে। একটা পা লম্বা করে ছড়ানো, আর একটা পা ভাঁজ করা, তারই ওপর হাতের ভর দিয়ে মাথাটা রাখা। পেছনের দেওয়াল থেকে পড়া হলুদ আলোয়, ছবি তুলে রাখার মত একটা অবয়ব হয়ে উঠেছে অপ্রতিম আর ওর লম্বা তেরচা ছায়া। সে শুধু কারো একটা গলার আওয়াজ পেয়ে সেইদিকে মুখ ঘুরিয়ে বলল ‘উঁ?’ কৃষাণু অপ্রতিমের দিকে এগিয়ে এলো চারদিক সাবধানে দেখতে দেখতে। রিসর্টের এই দিকটা একদম নিঝুম, এত নাচগান শোরগোল… সব কিছু ফিকে হয়ে গেছে এই কোণে এসে। এক বিচ্ছিন্ন নির্জন দ্বীপ। কেউই এদিকটায় আসা-যাওয়া করে বলে মনে হয় না। টীমের কোনো যুবক-যুবতী জুটি গোপন মুহূর্ত খুঁজতেও এদিকে আসবে না। ‘অপ্রতিমদা সত্যিই বেশি টেনে নিয়েছে নাকি?’ অপ্রতিমের কাঁধে আলগা করে হাতটা রেখে কৃষাণু বলল, ‘আমি… এখানে একা একা কী করছ? ওঠো! চলো… বার্বিকিউ হচ্ছে! লোকজন খোঁজ করছে!’
- খোঁজ করছে নাকি! লোক না পোক!
- হিম পড়ছে, ঠান্ডা লাগবে… ওঠো ওঠো!
- তুই কি আমার মা? আমাকে কি দেখে মনে হচ্ছে আউট হয়ে গেছি?... যা না, আমি আসছি।
- বলছ হওনি, কিন্তু করছ ওরকমই।
- হাহ্‌… হা হা হা… কখনো দেখেছিস অফিস আউটিং-এ এসে আউট হওয়ার মত খেতে? নেভার!
-
- বস বস… তুইও দুমিনিট এখানে চুপ করে বস… দেখ কী সুন্দর লাগবে!
একরকম হাত ধরে টেনেই কৃষাণুকে বসিয়ে দিল অপ্রতিম। কৃষাণু অনিচ্ছা সত্ত্বেও হাতে টান অনুভব করে বসে পড়ল। কথা জড়িয়ে যাচ্ছে এমন না, কিন্তু কেমন যেন গুম খেয়ে আছে মনে হল অপ্রতিমকে দেখে। কেন হঠাৎ এই মুড চেঞ্জ হল, বুঝতে পারল না কৃষাণু। দিব্যি তো বাচ্চা মেয়েটার সঙ্গে ফ্লার্ট করছিল গলাটা হাস্কি করে।  
- ওই তো বালের জিনস, অত দেখছিস কি… উঠে ঝেড়ে নিলেই হবে।
-
- এই বাড়িটা একটা পুরনো জমিদারবাড়ি, রিনোভেট করেছে… জানিস তো?
- হ্যাঁ, কী সামথিং সিংহ রায়, সে এই রিসর্টকে দিয়ে দিয়েছে লিজে। 
- আদিত্যনারায়ণ।
- হ্যাঁ, ওই… এখানে থাকে না এখন কেউ।
- হিউসটনে… মেয়ের কাছে। মেয়ে ওখানেই সেটল্ড।
- তুমি এত হাঁড়ির খবর পেলে কোথা থেকে?
-  ওই সকালে ম্যানেজারের সঙ্গে… আচ্ছা, তুই এখানে ছুটে এলি কেন? সত্যিই ভেবেছিলি আমি আউট হয়ে পড়ে আছি?
- না না… কেউ বলতে পারছিল না…
- সেই তুই-ই এলি… এত কিছুর পরেও…
-
- জানি… ইচ্ছে করেই এড়িয়ে যাস আজকাল। ঠিকই করিস। অন্য যে কেউ হলে তাই-ই করত। ইনফ্যাক্ট…
- থাক না ওসব কথা।
- তৃতীয় ব্যক্তির জন্য নিজেদের স্বাভাবিক সম্পর্ক নষ্ট হয়ে যায়। মিস আন্ডারস্ট্যান্ডিং… ইগো… - স্ক্যান্ডল…
- তৃতীয় ব্যক্তি?
- কৃষ… আই ডোন্ট হ্যাভ এনি কনট্যাক্ট উইথ হার… অ্যাট লিস্ট ফর লাস্ট ওয়ান ইয়ার।
-
- ফালতু সাফাইয়ের মত শোনাচ্ছে। বাট ইউ শুড নো। হোয়াটেভার… হোয়াটেভার ইজ গোইং অন বিটুইন ইউ টু… হ্যাজ নাথিং টু ডু উইথ মি!
- ওহ রিয়েলি!

কৃষাণু ফোঁস করে উঠল অপ্রতিমের 'হ্যাজ নাথিং টু ডু উইথ মি' শুনে , সান্ত্বনা দিতে কাঁধের দিকে এগিয়ে আসা অপ্রতিমের বাঁ হাতটা পিছিয়ে গেল, গুটিয়ে গেল নিজের ভেতরে… একটা অব্যক্ত গ্লানিবোধ থেকে। কৃষাণু আর কিছুই বলল না, দাঁতে দাঁত চেপে পুলের জলের দিকে তাকিয়ে রইল। জলের রঙ কালো মনে হচ্ছে। নিকষ কালো। তাতে পদ্মপাতা না ওয়াটারলিলির পাতা ভাসছে। পদ্ম আর ওয়াটারলিলি এক না… কৃষাণু জানে, কিন্তু আলাদা করে কোনটা কী মনে থাকে না। পদ্মপাতার তলায় অনেকসময়ে সাপ লুকিয়ে থাকে– এটাও জানে। তবে গোখরো না জলঢোঁড়া, বুঝতে পারে না। এটা তো পাঁক নয়, টলটলে জল। কোনো সাপ কি এখানেও লুকিয়ে আড়ি পাতছে ওদের ব্যক্তিগত অতীত জানতে? ইচ্ছে করছিল অপ্রতিমদাকে অনেক কিছু বলতে… একেবারে ভেন্ট আউট করতে পারলে হয়ত হালকা লাগত। কিন্তু দুজনের মধ্যে এখানে কথা কাটাকাটি হলে এতগুলো জুনিয়র দেখবে। এখানে তো বাজে সিন হবেই, অফিসেও এই নিয়ে চর্চা চলবে অনেকদিন। সিনিয়র কলিগদেরও কানে যাবে… হয়ত অতসীও জানবে, কারো কারো ওয়াইফের সঙ্গে তো ভালোই টাচ ছিল!

- তোর জায়গায় আমি হলেও এভাবেই রিয়্যাক্ট করতাম।
- তুমি কেন এখানে এসে এই টপিকটা টানছ, বুঝতে পারছি না। কোনো মানে আছে কি?
- হুম… আমারই ভুল। নাথিং কুড বি আনডান এনি ওয়ে, ওয়ান্স দ্য ড্যামেজ ইজ ডান।
- দেন?
- এই সিংহ রায়দের কেসটা শুনেছিস তো?

এত দ্রুত অপ্রতিম প্রসঙ্গ বদলে ফেলবে বুঝতে পারেনি কৃষাণু… মনে হচ্ছিল ওরই নেশা হয়ে গেছে যেন, ধরতে পারছে না অপ্রতিমের কথা। অপ্রতিমের কথায় অসংলগ্নতা নেই, যা বলছে যেন ভেবেই বলছে। একটু টেনে কথা বলছে, মাঝে একটু বেশিক্ষণ থামছে একটা কথা থেকে আর একটা কথায় যাওয়ার মাঝে। কিন্ত এটুকু হয়েই থাকে। কৃষাণু কোনো উত্তর দিচ্ছে না দেখে চোখের সামনে দুবার তুড়ি বাজিয়ে অপ্রতিম আবার জিজ্ঞেস করল ‘কীরে… শুনেছিস? কেসটা?’
- কেস?
- ওই কেস বল… কেচ্ছা বল…
- না… কী কেস?
- এই যে এখনকার সিংহ রায়, দ্য লাস্ট আয়ার… তার বাবার দুটো বিয়ে। এবং দুজন স্ত্রীই নাকি এই বাড়িতেই থাকতেন।
- এইসব জমিদার বাড়িতে ঘটেই থাকে।
- কেস সেটা না… কেস হল এই সিংহ রায় যে, এ ওই দুজনের স্ত্রীয়ের কারোর ছেলেই না।
- অ্যাঁ?!
- ইয়েস স্যার!
- তাহলে?
- অ্যাডপ্টেড। প্রথম বউ নিঃসন্তান বলে আবার বিয়ে করে… তার হল পর পর দুটি কন্যা সন্তান…  তারপর অবশেষে একটা ছেলেকে দত্তক নেওয়া হয়।
- তারপর?
- তারপর আবার কী… দেওয়ালের কথা– দত্তক-ফত্তক নয়, ওই সিংহ রায়দেরই ছেলে… বাট নট ফ্রম দ্য জমিদার গিন্নিজ।
- এগুলোও ম্যানেজার বলেছে?
- নাহ…
- ফালতু গল্প সব।
- তাহলে তাই… কিন্তু গল্প তো! আমার এমন পুরনো বাড়ির আনাচে কানাচে এমন গল্প খুঁজে নিতে ইচ্ছে করে। কিছুটা শোনা, কিছুটা ভাবা, কিছুটা মিলিয়ে নেওয়া…
- সেই দুই মেয়ের কী হল?
- বিয়ে করে সংসার করছে… একজন কানপুর, আর একজন শ্রীরামপুর… প্রপার্টিতে শেয়ার আছে, টাকা পায় তারাও… ভাগ ছাড়েনি। যে কানপুরে থাকে তার বর বিশাল হনু নাকি। আইআইটির প্রফেসর ছিলেন, বেশ নামডাক। তবে শ্রীরামপুরের জন তেমন কিছু না, উচ্চবংশ… কিন্তু এখন তালপুকুর নামেই। তাই টাকার দরকার তার একটু বেশিই। ভাই বলে তো মানেই না বোনেরা… বুঝছিস না? নেহাত বাপ একেবারে লিগালি বাড়িটা দিয়ে গেছে এই ছেলেকে, তাই…
- তুমি একদিনের জন্য মস্তি করতে এসে এদের ব্যাপারে এত খোঁজ নিয়েছ?
- হা হা হা হা…

অপ্রতিমকে এভাবে হঠাৎ এভাবে হাসতে দেখে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল কৃষাণু। হা হা করে হাসতে হাসতে শুয়ে পড়েছে ধুলোয় অপ্রতিম। পেট হাত দিয়ে হো হো করে হাসছে পাগলা দাশুর মত। যেন খুব মাথা খেলিয়ে বানানো একটা প্র্যাংক সফল হল। কৃষাণুর মনে হল, ইচ্ছে করেই অপ্রতিম এই মজাটা করছে ওর সাথে, অতসীর বিষয় থেকে মনটা ঘুরিয়ে দিতে। এগুলোও একরকম পিপল ম্যানেজমেন্ট। অপ্রতিম ভীষণ ভালো ম্যানেজার ছিল… এখনো আছে। হাসা থামিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল অপ্রতিম। কৃষাণু শান্তভাবে বলল ‘হয়েছে?’ অপ্রতিম আবার একটা ফোঁস করে দীর্ঘশ্বাস ফেলে চুপ করে গেল, কিছুক্ষণ আগেরই এত হাসি, একদম এক মুহূর্তে দপ করে জ্বলে ওঠা আলেয়ার মত মিশে গেল আঁধারে। চিত হয়ে শুয়ে রইল অপ্রতিম আকাশের দিকে তাকিয়ে, চোখ দুটো বন্ধ করে দিল। চোখ বন্ধ বলে দেখতে পেল না– কৃষাণু ততক্ষণে উঠে দাঁড়িয়েছে। শুধু শুনতে পেল–
‘তোমাকে আমি বিশ্বাস করেছিলাম অপ্রতিমদা! ওকে করিনি… তোমাকে করেছিলাম!’
তারপর জুতোর শব্দটা ক্রমে দূরে চলে গেল।
অপ্রতিম বুঝতে পারল, সিমেন্টে বাঁধানো জায়গাটা হঠাৎই খুব ঠান্ডা লাগছে, হিমঘরে রাখা বরফের চাঙরের মত ঠান্ডা!
মনে হল এই পুলটা একসময়ে কোনো পরিত্যক্ত ইঁদারা ছিল। হয়তো এখনো ভালো করে খুঁড়লে গুম খুন হওয়া কারো কংকাল উঠে আসবে! গভীরে খনন করলে স্তরে স্তরে কত কী যে উঠে আসতে পারে!
হিম পড়ছে বলেই হয়ত গা-টা ভারী হয়ে যাচ্ছে, মাথাটাও ভারী হয়ে আসছে… ঠিক জ্বর আসার আগে যেমন লাগে।
 

---- --- ----


- কী হল কৃষ দা? অপ্রতিমদাকে দেখতে পেলে?
- হুম, আসছে।

প্রশ্নটা যে করেছে, তার মুখটা ভালো করে না দেখেই উত্তরটা দিয়ে পাশ কাটিয়ে  চলে গেল কৃষাণু... রিসর্টের বিলাসবহুল অ্যাকোমডেশন হয়ে ওঠা জমিদার বাড়ির ভেতর, সিঁড়ি ধরে গটগট করে উঠে গেল নিজের ঘরের দিকে। এমন মাঝে মাঝেই কেউ না কেউ যায় ঘরের দিকে… ব্যক্তিগত কারণে। একটু আগে তো সকলের চোখ বাঁচিয়ে রাগিনী আর প্রত্যুষও চলে গেছে টেরেসে। তারপর সেখান থেকে জমিদার বাড়ির দোতলার কোণের দিকের একটা ঘরে। দুজন আলাদা আলাদা গেছে, কেউই বোঝেনি ব্যাপারটা। জানে না ওরা এখন কোথায়। ডিনারের সময়ে না দেখতে পেলে অবশ্য খোঁজ শুরু হবে। ততক্ষণ সময় আছে ওদের হাতে।

- ইয়ে রুম তুমহে ক্যায়সে মিলা?
- মিলা আবার কী? ম্যানেজ করেছি কেয়ারটেকারকে টিপ দিয়ে, সকালে চাবি ফেরত দিতে হবে।
- কেয়া বতায়া উসে? কিঁয়ু চাহিয়ে?
- উতনা এক্সপ্লেনেশন জরুরি নেহি হ্যায়। সমঝদার হ্যায় ইয়ে লোগ। এক্সপিরিয়েন্সড ভি। এইসব করেই ওদের উপরি আসে।
‘উপরি’-র অর্থ রাগিনীর কাছে স্পষ্ট নয়, কিন্তু প্রত্যুষ তর্জনী আর বৃদ্ধাঙ্গুষ্ট দিয়ে যে ইঙ্গিতটা করল সেটা পরিচিত। রাগিনী বেশ ইম্প্রেশড হওয়ার ভঙ্গি করে ‘আরে ওয়াহ!’ বলে প্রত্যুষের হাঁটুর কাছে এগিয়ে গেল শিকারী চিতাবাঘের মত, তারপর দুহাত দিয়ে ওর আন্ডারওয়ারটা নামিয়ে মুখটা ঝুঁকিয়ে দিল নীচের দিকে। অথচ চোখে-চোখ রেখে তাকিয়ে রইল প্রত্যুষের দিকেই। তার জিভ খুঁজে নিতে লাগল শিকার… সাপের মত।
     ঘরটা বাড়ির দোতলায় এক কোণের দিকে। এদিকের ঘরে অতিথিরা থাকে না, সেভাবে প্রস্তুত নয়। সামান্য কিছু পুরনো আসবাব জমিদারি আমলের– একটা মাঝারি খাট, খুব সাধারণ তোশক, সুতোর কাজ করা সাদা চাদর দিয়ে ঢাকা। একটা খাটো টেবিল। আর একটা কাঠের আলমারী, তার ওপর পুরনো দিনের পেতলের ফুলদানি রাখা। ওই খাটের ওপরে ঝাঁপিয়ে উঠেছিল দুজন। দরজাটা ভেতর থেকে বন্ধ করা। এত কোণের দিকে ঘর… না এদিকে কেউ আসবে, না বাইরে থেকে কান পেতে কিছু শুনতে পাবে। রিসর্টের কর্মচারীগুলোর বদমাইশি বুদ্ধি থাকলে তা আলাদা ব্যাপার। ওরাও তো গন্ধ পায়, বুঝতে পারে কিছুটা। তবে ঘরের দরজা ভালো করে বন্ধ থাকলে প্রাইভেসি নিশ্চিৎ। বেশ মোটা সেগুন কাঠের দরজা। আর জানলার বাইরে পেছন দিকের পাঁচিল… তার বাইরে মাটির সরু রাস্তা আর একটা দীঘি। দীঘি কেমন, তার জলে কেমন চাঁদের ছায়া দুলে উঠছে মাঝে মাঝে… সেসবে এদের আগ্রহ নেই। হাতে সময় কম। এই নিভৃতের জন্য এত উদ্যোগ, এত উত্তেজনা চেপে রাখা অপেক্ষা। আবেগ, রোম্যান্টিসিজম, ফোরপ্লে কোনো কিছুকেই তত গুরুত্ব না দিয়ে দ্রুত একে অপরের শরীরকে দখল করে নিতে হবে। তারপর আবার স্বাভাবিক ভাবে ফিরে গিয়ে ডিনার, পার্টি, ডিজে…

‘ইজ এভরিথিং অলরাইট?’
প্রশ্নটা শুনে অপ্রতিম থমকে দাঁড়াল। দলের অন্য ছেলেমেয়েদের থেকে অনেকটাই দূরে এসে একা দাঁড়িয়ে আছে টায়রা। এই অন্ধকারে, এইদিকের পথে ওকে আশা করেনি অপ্রতিম । ‘ও কি তাহলে কৃষাণুর পিছু পিছু এসে এখানে দাঁড়িয়ে শুনছিল সব কিছু?’

- তুমি এখানে?
-
- হাসছ যে?
- আপনি ভাবছেন আমি ইভ-ড্রপিং করছিলাম… নট দ্যাট। কৃষাণুদাকে দেখলাম মিনিট পাঁচেক আগে একা ফিরতে। গা ঘেঁষে চলে গেল, অথচ আমার দিকে তাকাল না... সোজা রুমে চলে গেল।
-
- সো… আমি একটু এদিকে এসে দেখলাম…
- এভরিথিং অলরাইট কি না…
- হুম।
- আমরা ঠিক আছি গো… আমি তো বটেই। কৃষাণুও… হোপফুলি।
- আপনাদের মধ্যে কি কিছু…
- একটু আগেই ঘরে সরি বললে… সেই আবার…
- ওহ… আচ্ছা। আগেন… সরি। ডিনারে আসবেন তো এবার?
- হুম… চলো।
- হুম।
- ডিনারের জায়গাটা খুব কাছে… না? দু-পা হাঁটলেই পৌঁছে যাব।
- মানে?
- এরকম একটা নিরালা রাত, হেমন্ত বিদায় নেবে কদিন পরেই।  ইভনিং ওয়াক করতে  তোমার ভালো লাগে না?
-
- হাসলে যে?
- আপনি আমাকে কোজি করতে চাইছেন… যেহেতু বিব্রত করেছি।
- তুমি যে কনভার্সেশনের মাঝে ‘বিব্রত’-র মত একটা শব্দ ব্যবহার করলে, এটাই অভিভূত হওয়ার মত ব্যাপার। অন্য কেউ অফেন্ড বা এমন কিছু বলবে।
- আপনি বাঙালীদের সঙ্গে বাংলায় কথা বলতে ভালোবাসেন, আমি জানি।
-  হা হা হা… বাঙালী বাঙালীদের সঙ্গে বাংলাতে কথা বলবে… সেটাও একটা নজরে পড়ার মত ব্যাপার নাকি… কী দিন কাল!
- নট দ্যাট… ইয়ু নো হোয়াট আই মেন্ট!
- হাঁটবে?
- হুম?
- ডিনারের পর… হাঁটবে আমার সাথে?
- যদি না আর মদ খান। কথা দিতে হবে।
-
- এই যে দু পা এগোলেই পার্টি-মিউজিকের আলো এসে পড়বে গায়ে… তার আগে ভেবে বলুন। যদি কথা দেন, কথা রাখেন… তবেই!
- তোমার তো মদ্যপান নিয়ে কোনো প্রিজুডিস নেই?!
- নেই… কিন্তু আমি চাইছি না, আপনি আর রাতে ড্রিংক করেন। যদি হাঁটতে চান তো।
- ওকে… ডান। নো মোর ড্রিংক।
- আমি নজর রাখব কিন্তু!
- হা হা হা…
পুরুষ সচেতন বা অবচেতনে অভিভাবিকা খোঁজে। টায়রার মত অল্পবয়সী কারো চোখে এই অযাচিত বা অনভিপ্রেত অভিভাবকত্বের ছায়া, ভান হলেও উপভোগ্য। অপ্রতিম প্রকাশ করে না, কিন্তু মাঝে মাঝে এই বয়সে এসেও তো ইচ্ছে হয়… কেউ এমন শাসনের চোখে দেখুক! হঠাৎ করে জন্মানো এমন শাসনের দৃষ্টি কেমন দুর্বল করে দেয় মনকে। মুহূর্তে সঁপে দিতে ইচ্ছে করে এমন শাসকের পায়ে। শাসকের হাসিই যেন বলে দেয়– এবারে আত্মসমর্পণ শুধু সময়ের অপেক্ষা। ঠিক এমন সময়ে জোরে হেসে ওঠা , গাছের ডালে বসে থাকা পাখি হাততালি দিয়ে উড়িয়ে দেওয়ার মত। মুহূর্তের আচ্ছন্নতা কেটে বেরিয়ে আসার এক টোটকা। বুক খুলে হা হা হা করে হেসে ওঠা। নিজের কানেই মাঝে মাঝে কেমন লাগে এই হাসির শব্দ। হাসি থামিয়ে হঠাৎ থমকে দাঁড়াল অপ্রতিম, টায়রার দিকে সামান্য ঝুঁকে পড়ে বলল, 'একবার দেখবে, কপালটা গরম কি না?' টায়রা প্রশ্নটা শুনে সামান্য ইতস্ততঃ করে বলল 'আমার হাত এমনিতেই ঠান্ডা।' তারপর কিছু একটা চিন্তা করে হাতের দুটো পিঠই কপালই ঠেকিয়ে বলল, 'তেমন কিছু লাগছে না... কেন? আপনার কি শরীর খারাপ লাগছে?' 'নাহ... এখন ঠিক আছি' বলে আবার সোজা হয়ে হাঁটতে শুরু করল অপ্রতিম। একটু দূরত্ব রেখেই সঙ্গে সঙ্গে এগিয়ে গেল টায়রা, মাঝে মাঝে একটা সপ্রশ্ন দৃষ্টি নিয়ে  অপ্রতিমকে দেখতে দেখতে ।
দূরে দাঁড়িয়ে থাকা অন্যরাও দেখল– অপ্রতিমদা অবশেষে ফিরছেন, সঙ্গে সেই টায়রা… টায়রাই যেন মানিয়ে নিচ্ছে, ফিরিয়ে আনছে অভিমান ভাঙিয়ে।
(চলবে) 

© জয়দীপ চট্টোপাধ্যায়

Comments

Popular posts from this blog

অনিন্দ্য সরকারের গুচ্ছ কবিতা : গান ছুঁয়ে ছুঁয়ে

অয়ন হালদারের পাঁচটি কবিতা

মুন্নী সেনের গুচ্ছ কবিতা : সম্বোধন