শাম্বর মুক্ত গদ্য : দেবী



দেবী


‘উন্মাদের একটা সরল গুণ থাকে পুষাণ। সে আমাকে পাথর করতে চায় না, অপেক্ষা করে, কখন আমার সর্বস্ব সবুজ থেকে একফোঁটা জল গড়িয়ে পড়বে মাটিতে।’
          কথাটা বলতে গিয়ে যেন কোনো আদিম ঈশ্বর খেলে যায় সুতপার মুখে। কথিত আছে বটে, এ ঘাস জমির ওপরেই একদিন অগ্নির সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছিল গ্রাম্য যুবতী, তন্দ্রা। খানিক এগোলেই তার মন্দির।

 ২

         এক আলোকবর্ষ কে সাক্ষী করে ওরা চলেছে সেদিকেই।সুতপা আর পুষাণ। বর্ষার মেঘ ধরে আছে সন্ধ্যার আকাশে। নোনা মাটির চাতাল আর শুকনো নারকেল পাতার ছাউনির ভেতরে সত্যিই স্থাপিত একজন চকচকে ঈশ্বরী। কিন্তু এই সত্যের চাকচিক্যর নীচে যুগের পর যুগ রয়ে যায় এক একটা মিথ্যের স্তব গাথা। যেভাবে একদিন কবরের নীচে, দেহ থেকে মিথ্যে হয়ে যায় মাংসের আভরণ। আর উন্মুক্ত কঙ্কাল ক্ষয়ে উর্বর হয় মাটি। সে মাটিকেই তো আশ্রয় করে গুল্ম থেকে বৃক্ষ হয়ে ওঠা। কিশোরী থেকে যুবতী। সত্য মিথ্যার এই নীরব সমীকরণে মনুষ্য থেকে বৃক্ষ, চোখের পলক থেকে গাছের পাতা, হাতের আঙুল থেকে নতুন শাখা-প্রশাখা-কান্ডের অবাধ বিস্তার।
            কিন্তু , মানবী থেকে দেবী হয়ে ওঠা, সে আরেক ব্যাপার।যুগের পর যুগ শব সাধনায় মেতে যেভাবে জীব থেকে জীবাশ্ম তৈরি করে প্রকৃতি, সেই সুন্দরের অলক্ষেই তো রয়ে যায় ভয়ংকর নিষ্ঠুরের পদচিহ্ন।


মন্দিরের পাশের জারুল গাছে হেলান দিয়ে পেনসিলের সংযমী টানে মুর্তির অবয়ব খাতায় নামিয়ে আনছে পুষাণ। আর প্রতি মুহূর্তে সুতপার চোখ যেন মিলিয়ে আসছে তন্দ্রার চোখে। যেন সমস্ত অতীত ইতিহাস জরা জংলা সরিয়ে ও হাতড়ে খুঁজছে রক্ত মাংসের সেই যুবতী তন্দ্রাকে।
              ‘মানবী থেকে দেবী করা বড় স্বচ্ছল ব্যাপার। কিন্তু মানবী কে মানবী থাকতে দেওয়া সে বড়ো দুঃসহ ! না রে পুষাণ?’
       কথা বলতে বলতে বদলে যায় সুতপার চোখের রং।

যেন কলঙ্ককের কাজল আরও বিস্তার করে যায় সন্ধ্যার মেঘে।

     ‘আমি ঈশ্বর মানি না, সুতপা।তুই তো জানিস!’

         খাতায় দৃষ্টি স্থির রেখে উত্তর করে পুষাণ। সন্ধ্যা গড়িয়ে যাচ্ছে মেঘের অপার ঘনত্বের ভেতর।যেন রাত্রি আহ্বানের সনাতন মন্ত্র উচ্চারির হচ্ছে সমস্ত ঘাসজমি থেকে নিবিড় নক্ষত্র পর্যন্ত।নীরবতা আসলে এক অন্তর্হিত কোলাহল। তাকে শোনা যায় না, অনুভবের অতলে ডুব দিলে তবেই সে ঝংকার দেয় মনকে। এমনই এক নীরবতার নাম সুতপা।
              ‘তোর ঈশ্বর নেই, তবে সৃষ্টির আকাঙ্ক্ষা আছে। কিন্তু মানুষ যখন সৃষ্টির নেশায় বুঁদ হয়ে যায় তখন আগে সে ধ্বংসের সাধনা করে, পরে সৃষ্টির। এ বড় আদিম প্রথা। অধিকার আস্ফালনের কী সভ্য পদ্ধতি! যা কিছু আমার বলে মনে হয় তার সকল নিজস্বতাটুকু ধ্বংস করে মনের মতো পাথরে পরিনত করা।আর ভয়, ভক্তি, চাকচিক্য, প্রণতির আড়ালে রেখে দেওয়া তার যাবতীয় নিজস্ব অতীত যাপন। তুই এই মূর্তির স্তব্ধ অবয়ব কে বুঝে নিতে চাইছিস, কিন্তু তার ধ্বংসের অতীত? একগুচ্ছ লোকের অন্ধ মোহের আগুনে কিশোরী থেকে স্ত্রী, স্ত্রী থেকে সতী, সতী থেকে দেবী আর দেবী থেকে পাথর করে তোলার নিষ্ঠুর ইতিহাস। যেভাবে নরম মাটির ভাস্কর্যকে ভাটায় পুড়িয়ে তার অন্তরাত্মাটুকুকে দগ্ধ করে তৈরি হয় শিল্প। ঠিক সেভাবেই তো এই মন্দির-মূর্তি-পাথর।’


নিজের অজান্তেই ভারি হয়ে আসে সুতপার গলা। দৃষ্টি ফিরিয়ে সে দেখে আঙ্গুলের সংযম হারিয়ে ফেলেছে পুষাণ। অনিয়ন্ত্রিত পেনসিলের ঘষটানি যেন যুগ যুগান্তের ছাই চাপা আগুন থেকে তুলে এনেছে সেদিনের তন্দ্রাকে।ঘাষজমির ওপরে পড়ে আছে খাতা, আর ভরা সন্ধ্যার সকল তূণীর শূন্য করে যে রমণী উঠে আসছে সে কোনো দেবী নয়, ঈশ্বরী নয়। এক শান্ত যুবতী। এই আল থেকে একদিন যে হারিয়ে গিয়েছিল অগ্নির গহনে। আর যুগের পর যুগ তার মিথ্যে শব সাধনার আড়ালে রচিত হয়েছে নিস্তব্ধ অধিকার আস্ফালনের গুপ্ত ইতিহাস।


পুষাণের শ্রান্ত দৃষ্টি যেন ধুইয়ে যাচ্ছে সুতপার করতল। না সুতপা নয়, এখন সে তন্দ্রা। যার ঠোঁটের মাপ, বুকের অ্যানাটমির মধ্যে আটকে থেকেছে পুষাণের শিল্পী চোখ যা গড়তে চেয়েছে এক নিজস্ব ব্যক্তিগত পাথুরে প্রহেলিকা। কিন্তু তারও গহীনে রাখা ছিল যে আসমুদ্রহিমাচল, তার সন্ধান পায়নি পুষাণ। আজ এক সমুদ্র জলের ঝাপটা তার স্বার্থপর দৃষ্টিকে সম্পূর্ণ নস্যাত করে ওকে দাঁড় করিয়েছে এক সত্যের সামনে। নিজের দস্যুতার সামনে। এই সান্ধ্য নীরবতার মধ্যে যে অন্তরাত্মার কোলাহল তুলে বলছে ,
          ‘আমি তোমার সৃষ্টিতে পাথর হতে চাই না পুষাণ, আমাকে আমার মতো গড়িয়ে পড়তে দাও, ভালোবাসলে অপেক্ষা করো।’ সেই তো সুতপা।তন্দ্রাই তো সে।


ওরা বসে আছে মন্দিরের চাতালে। সুতপার চোখের জলের সঙ্গে মিশে যাচ্ছে সান্ধ্য বারিধারারা সশব্দ কোলাহল।অন্ধকারের মধ্যে যেমন লুকিয়ে থাকে আলোর উৎস, তেমনই এই বৃষ্টির মধ্যেও যেন স্থাপিত হয়েছে অগ্নির শুদ্ধতা। এই জলেই নিজেকে ভিজিয়ে পুড়িয়ে নিজের মিথ্যে অহংকে চূর্ণ করে বেরিয়ে আসছে এক অন্য পুষাণ। যে শিল্পী হতে না পারলেও উন্মাদ হতে পারে স্বচ্ছন্দে।

রোদনসুখ যেভাবে মানুষের মনকে হালকা করে দেয়, তেমনই মুষল বারিধারা সরিয়ে দিয়ে গেছে আকাশের মেঘভার। এখন অনেকটা পরিস্কার আকাশ।
ওই চলে যাচ্ছে ঘাষজমির ওপর দিয়ে চলে যাচ্ছে ওরা তিনজন, সুতপা, পুষাণ আর একটা সত্য।তন্দ্রা।
       ওদিকে সমস্ত আকাশ বিজ্ঞানীদের দৃষ্টি নস্যাৎ করে বড় কাছে চলে এসেছে আদি নক্ষত্র দুটি। স্বাতী আর বশিষ্ঠ।

© শাম্ব

অঙ্কন : শাশ্বত বন্দ্যোপাধ্যায়


Comments

Popular posts from this blog

অনিন্দ্য সরকারের গুচ্ছ কবিতা : গান ছুঁয়ে ছুঁয়ে

অয়ন হালদারের পাঁচটি কবিতা

মুন্নী সেনের গুচ্ছ কবিতা : সম্বোধন