সীমিতা মুখোপাধ্যায়ের গুচ্ছ কবিতা
সিঁড়িভাঙা অঙ্ক
--------------------
কাশতে কাশতে ভেঙে-যাওয়া গলা সিঁড়িভাঙা অঙ্কের মতো
নেমে যায় পরিবাহার গাছের জাদুপল্লবে।
শিশিরে কেঁপে-ওঠা ঘাস, মর্মর মূর্তির হঠাৎ চোখ-মেলা—
আমি দেখে ফেলি আবার একাদশীর আবহসঙ্গীতে।
আমার জলটুঙ্গি সেজে ওঠে খড়ের পুতুল আর
অচেনা জোনাকি ফুলের মাধুর্যে। তোমার নিশ্চুপ এসে দাঁড়ায়,
একবার ছুটকারা পেলে উড়ে যাবে যে বেগানা বাতাস—
ঠিক তার পাশে।
তোমাকে কেমন দেখতে, তমসাপুরুষ?
কোনো এক তৃষিতবেলার কাহিনি শুনতে শুনতে
ঘুমিয়ে পড়ে চন্দ্রাহত ধু ধু বালুচর। আশ্চর্য-কঠিন
এক ছেলেখেলা, কয়েকটি তন্দ্রাচ্যুত তারকা, ম্লান
রাজহাঁসের দেহরেখা কুয়াশাস্তম্ভের ভিতর হেলায় হারায়।
স্খলন-নামা
------------------
ভ্রমরদীঘি ভেসে যায় বেহুলাভেলায়— ম্লান হয়ে আসা
মফস্সলের দিকে, ছায়াজালকের শিরস্ত্রাণ মাথায়
পূর্ণিমার চাঁদ— তাকে অনুসরণ করে আমরা
ধেয়ে যাই কবরখানার পাশে, যেখানে নিস্তারিণীতলা।
বুড়ো দর্জি আনমনে সেলাই-মেশিন চালায়,
সোনা দুটি চোখ নিয়ে কুয়াশাপুরুষ নেমে আসবে এইবার,
জোনাকিবাগান গাঢ় হয় বেকসুর অপেক্ষায়।
আমার তো কোথাও জুড়ে যাওয়ার নেই,
অঙ্গহানির ব্যথা জুড়োয় হাল্কা শীতের ছোঁয়ায়।
চেনা হাত আচমকা চেপে ধরে বুক, কামড় বসায় ওষ্ঠফলে,
খাদে পড়ে যেতে যেতে বুঝি— বন্ধুর অচেনা অসুখ
ঠেলে দিয়েছে আমায় লক্ষ্যহীন কোনো মৃত্যুর তিরে।
স্পর্শকাঠি
---------------
পাশের বাড়ির কুসুমলতা হাত বাড়িয়ে
এ-বাড়ির কার্নিশ ধরে নেয় যেই,
শহরের সবচেয়ে উঁচু টাওয়ারটি দেখে—
দেবদূত এবং রাক্ষসেরা উড়ে যাচ্ছে
পৃথিবী ভেদ করে, দূরে ধোঁয়া-ওঠা কারখানা,
আকাশময় ছড়িয়ে আছে নক্ষত্রের কোরাল-রিফ।
যোনিপাথর মশাল জ্বালে নোনা বালুকায়।
রাতের আলিঙ্গন খুলে ভোর আসে, বেলা বাড়ে।
অহল্যাবুড়ি ভাত মেখে বসে থাকে সন্তানের আশায়,
নৌকোগুলো ঘরে ফেরে ছলাৎছলে নেচে।
রাজপুত্র মলিনকুমার, কণ্ঠে পাইন কাঠের আতর,
আঁধারকাঠি ছুঁইয়ে ভর সন্ধেবেলা ঘুম দিয়ে যায়
কবেকার অপেক্ষা-ফুলের ব্যথাতুর পাপড়িতে।
ফাঁকা মেট্রো
----------------
মরে গেলে ক্ষমা করে দিতে হয় বুঝি?
ফাঁকা মেট্রোর পেটের ভিতরে দাঁড়িয়ে দেখি―
অনন্ত কামরাগুলো কেমন এঁকেবেঁকে যায়
মহাজাগতিক ঘড়ঘড় শব্দে,
প্রলাপের মতো আমার লেখা আসে।
কিন্তু, এই ভাবে লিখতে চাইছি না তোমাকে―
সেই মায়াবট, কুয়াশাঘন মুহূর্ত ...
হঠাৎ করেই বাঁ-দিকের দরজা খুলে যায়!
তারপর আবার
হলুদের লক্ষণরেখা পার করে আমি
ঝুঁকে পড়ি মৃত্যুর রূপালী ও পিচ্ছিল গতিপথে।
তুমি এবং অপেক্ষা
--------------------------
একটি অপেক্ষা
অনেক রাত্তির অবধি অপেক্ষা করে
আরেকটি অপেক্ষার জন্যে।
প্রয়োজনেরও তো প্রয়োজন থাকতে পারে—
এসব ভেবে তুমি আশকারা দাও,
মিষ্টি মিষ্টি কথা বলে মাথায় তোলো তাকে।
আসলে তুমি জান,
সব বন্ধু তোমার
পিঠ চাপড়ে দিয়ে একদিন
ট্রেনে উঠে যাবে
আর এই শহুরে কলকাতার
লক্ষ লক্ষ ঘরের মধ্যে
কোনো একটা ঘরের কোনায়
কোনো একটি অপেক্ষা তোমার জন্য
অপেক্ষা করে যাবে
চিরকাল!
© সীমিতা মুখোপাধ্যায়
অঙ্কন: ঋতুপর্ণা খাটুয়া
প্রতিটা কবিতাই সুন্দর। ফাঁকা মেট্রো, স্খলন নামা অন্য মাত্রা বহন করে।
ReplyDeleteধন্যবাদ।
Deleteআবার পড়লাম। সত্যিই খুব ভালো কবিতা।
ReplyDeleteআবার ধন্যবাদ।
Delete