ড. দিলীপ চট্টোপাধ্যায়ের গুচ্ছ কবিতা


মাটিতে বৈদেহী

সেদিন গাছের নিচে আমি বৃষ্টিতে ভিজেছি 
একটু বজ্রের জন্য একটু মৃত্যুর জন্য 
দুহাত পেতে রেখে আমি নতজানু হয়েছি
 অচেনা গাছ আমার প্রাণের প্রহরী ছিল! 

এখন গর্ভের আঁধার থেকে নিষ্পাপ ভ্রুণ
বাইরে বেরিয়ে সে একবিন্দু আলোর জন্য
জননীর কাছে এসে তাঁর দুহাত পেতেছে। 
কেন বৈদেহী মাটিতে ভ্রুণ কান্না মুছেছে! 
প্রেয়সী কি হারিয়ে গেল ক্ষুধিত এ পাষাণে
 ভ্রুণ কি পাথরে ফোটাবে ফুল যদি বৃষ্টি ঈশানে।



কেন ? 

হেলিয়া দুলিয়া 
মেয়ে
পেখম মেলিয়া
 ফুলে
 তুলিয়া ফেলিয়া
 ভুলে
 নূপুর খুলিয়া
 সুরে
দুপুর ভুলিয়া
দূরে
মরিয়া পড়িয়া
কেন
হৃদয় খুঁড়ে


 ঠোঁটৈ ঠোঁটে পাশা

ঈশ্বর ও জাতিস্মর
হাসিমুখে করমর্দন করছে করুক
আমি দেখছি না। 
কবিতা নীরবতা জন্ম দিচ্ছে দিক
আমি শুনছি না। 
অন্তরে নারী পোষে বাঈজীবাড়ি 
যে মূর্খ বলছে বলুক
আমি হাসছি না। 
 অরণ্যে কি জাতীয়সঙ্গীত নেই
আমি প্রশ্ন করছি না। 
মহাকর্ষের গর্ভে ঈশ্বর ঘুমে
আমি জাগাচ্ছি না। 
হাঁটু জলে ডুবে হৃদয় প্রাসাদ
বক্ষের কৃষ্ণা তৃষ্ণায় থাক
জাতিস্মর পথে পথে 
হাজার বছর তীর্থের কাক
 দ্রৌপদীকান্না তাঁকে দেব না
ভীষ্মে শরশয্যা অর্জুন ছোঁবে না।
 নারী শিখবে নিরক্ষর ভাষা
ঠোঁটে ঠোঁটে প্রেম খেলবে পাশা


 স্তবক প্রেমে

জন্ম নিলে আমার বুকেই
স্তবক প্রেমে দেবো ঝুঁকেই 
ফুলদানিতে
প্রথম আলোয় দুটি চোখ 
অরুন্ধতী বান্ধবী হোক
ধূপদানিতে!
ধূপদানি আর ফুলদানি
তফাৎ শুধু তুমি আমি
তবুও খুশি
রক্তে নিশি নৃত্যরত
ভালোবাসা সব অনাবৃত
তাঁকেই পুষি
ঝিনুকে আছে মুক্তো প্রাণ
কোথায় যে তার পাব ঘ্রাণ 
হারিয়ে গেল!
অরুন্ধতী কোথায় তুমি?
সত্যি বলো।


 অরণ্যে বিজয়ী 

জলপ্রপাতে অশ্রু থাকা 
মাধুর্য কি নয়?
হরিণী ছোটে বাঘ পিছনে
প্রথম পরিচয়।
অরণ্যে কেউ বিজয়ী হলে
গোপন করে রাখে
সানাই কাঁদে বিজয় বুকে
পাখিরা ডাকে শাখে। 

আমার ঠোঁটে মিলিয়ে ঠোঁট
বৃক্ষে ফোটে ফুল
অন্তরে সে অপরাজিত
বাইরে অঙ্কে ভুল। 

গহীন মনে করে প্রবেশ
অশেষ হয় যেখানে শেষ
কে ঈশ্বর অবিনশ্বর? 
ঘুমিয়ে পথের বাঁকে? 

যে পথ মানা মেলেছে ডানা
 উড়িয়ে দেখো তাকে।


 মুখচ্ছবি 

দণ্ডিত তো দাঁড়িয়ে থাকে প্রথম প্রেমের কিশোর যেমন
খণ্ডিত যে লাশের পাশের পাঁজর ভাঙ্গার মন দরদী দ্বিধার মতন!
দণ্ডিত সে হাল ছেড়ে এক নৌকা নাবিক খিদার মতন।

তাঁর সেই অন্তরাল বাষ্পাকুলে খুলছে
পুরানো সব মুখচ্ছবি সাঁকোর মতো দুলছে
ভুল ওষ্ঠ পথ হারিয়ে মুখ লুকিয়ে কাঁদছে 

এই অহনা রাখব কোথায় 
নিদ্রাতুর চোখে 
তোমায় কিছু বলেছিলাম স্পর্শে ইন্দ্রজালে 
সন্ধ্যাকালীন আকাশলীনা 
আঁধারপ্রিয় শোকে। 

মনে পড়ে ঝড়ের সাথী 
মোহন স্মৃতির পটে 
চাঁদের চোখে তোমার মণি  
আছ কি ভালো প্রেয়সী তুমি 
মানুষ ঘুমায় কখন ভূমায়
নভোনীল তারার শ্বাসে মাতৃহারা 
বাসার পাশে


 নক্ষত্রের কথোপকথন

 কোনো গভীর রাতে
 সমুদ্র সৈকতে শুনেছ কি নক্ষত্রের কথোপকথন?
বুকের ভাষা কাঙাল করেছ আঁচল উড়িয়ে জীবন যাপন, 
 শতাব্দীর শিলালিপি
নির্বাক স্ফুলিঙ্গে তুমিই প্রথম, 
তুমিই অনন্ত ছায়াপথে
অনন্ত অশেষ, 
এখানেই তোমার পরমাণু হয়েছে পরাগরেণু, 
এখানেই স্বর্গ নেমে এসে মর্ত্যে নতজানু ।
এখানেই স্বর্গ খোলে
 তার মিথ্যা আবরণ, 
 দ্রৌপদীই অর্জুনকে করে বস্ত্র বিতরণ।


 জাগো হে লুন্ঠিত তরঙ্গে সমুদ্র

 জাগো হে লুণ্ঠিত তরঙ্গে সমুদ্র। 
তোমার চপেটাঘাতে চূর্ণ করো তামসিক পর্বত চূড়া, 
সুন্দরকে দিয়েছে সে দাম্ভিক শঠতা, 
মূর্খ শিল্পরীতি, 
তাকে ডোবাও অতল জলে রোমাঞ্চ বিলীন। 
এবার ভাসিয়ে দাও তরঙ্গের মর্মঘাতে অরণ্যভূমি, 
মাধুর্যকে করেছে সে উলঙ্গ সমাজ,
 ধূর্ত অর্থনীতি, 
তাকে ডোবাও টালমাটালে প্রপঞ্চে মলিন। 
শৈত্য প্রবাহে এখন প্রেয়সীর বুক,
জেগে সেখানে আমার উদাসী চিবুক, 
এদের পাতালে দাও জগতের টিকা,
বসো সারা রাত, ফসফরাসে মুছে নাও
ধুরন্ধর সভ্যতার মুমুক্ষা প্রভাত। 
যত্নে রাখো উষ্ণ স্মৃতি
এখনো সম্ভবত জ্বলন্ত আলিঙ্গনে সে মর্মমূলে আছে। 
ভাসিয়ে দিয়ো না চন্দনচর্চ্চিত ফুল, 
করতল পেতে সে অনৈসর্গিক পাশে।


 নগ্ন নৃত্য করে 

মন্ত্রের কঙ্কাল নগ্ন নৃত্য করে নৈবেদ্যের থালায়
ঝালায় মত্ত হয়ে রাগের আসরে
ঝাঁপতালে ঝাঁপ দেয়
ঘন্টায় কাঁসরে। 
রাগিণী বাঘিনী হলে
মির্জা গালিব হাসে
ব্রহ্মাণ্ড পাশে এসে কেন থমকে দাঁড়ায়? 

কে যায় বৈরাগে ঝরে
বিশ্ব নিঃস্ব করে কৃষ্ণ গহ্বরে? 
এতকাল পরে অহমিকা হিমালয়
একটু বসে নড়েচড়ে। 
মন্ত্রের কঙ্কাল তবু
নগ্ন নৃত্য করে নৈবেদ্যের থালায়।

© ড. দিলীপ চট্টোপাধ্যায়
অঙ্কন : শাশ্বত বন্দ্যোপাধ্যায়
বিশেষ সহযোগিতা: ঋতুপর্ণা খাটুয়া

Comments

Popular posts from this blog

অনিন্দ্য সরকারের গুচ্ছ কবিতা : গান ছুঁয়ে ছুঁয়ে

অয়ন হালদারের পাঁচটি কবিতা

মুন্নী সেনের গুচ্ছ কবিতা : সম্বোধন