নিরন্তর সমুদ্রমন্থনে যে গরল উঠে আসে : শাশ্বত বন্দ্যোপাধ্যায়
এই ধরুন আমার এই মুহূর্তে ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। সর্বাঙ্গ জ্বলে পুড়ে খাক হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু কষ্ট টা কোথায় হচ্ছে, কেন হচ্ছে কিছুতেই বুঝতে পারছি না। তাই ভাবছি আমার এই শরীরটা থেকে যদি আমি বেরিয়ে যাই। তারপর বসে বসে দেখি আমাকে। বেশ দারুণ হবে ব্যাপারটা।
এইবার আমি শরীর থেকে বেরিয়ে যাবো। দারুণ একটা সহজ পদ্ধতি পেলাম। আমি জানতে পেরেছি আমার শরীরে কতকগুলো চক্র আছে। নীচে থেকে উপরে যথাক্রমে মূলাধার, স্বাধিষ্ঠান, মণিপূরা, অনাহত, বিশুদ্ধি, আজ্ঞা, সহস্রার। এই যে চক্র গুলো এর মধ্যে আমি আছি মূলাধারে।
মূলাধারের সাধনাতে বসি। কিছুক্ষণ পরে চক্র টা খুলে গেল। এইবার আমি নীচে থেকে উঠে আসবো উপরের দিকে। সরু মাকড়শার জালের মতো পথ। এই যে রাস্তা বেয়ে আমি উপরের দিকে উঠছি, আমি জানি এটাকে বলে ব্রহ্ম নাড়ি।তো আমি উঠছি উপরের দিকে। অজ্ঞাতে এসে কেমন আটকে গেলাম। একি কথা হল। একটু হতবুদ্ধি হয়ে পড়লাম। আর যে পথ নেই। কোনো সুতো দেখতে পাচ্ছি না। থেমে যেতেই হবে।
আবার সাধতে শুরু করলাম। যা বুঝতে পারছি এবার আমাকে রাস্তা তৈরি করে নিতে হবে। তাছাড়া উপায় দেখছি না। তৈরী হল রাস্তা। বিশ্বাসের। কি দারুণ জোর বিশ্বাসের। মনে মনে মজা পেলাম।
সহস্রারে পৌঁছতেই হাউইয়ের মতো উড়ে গেলাম শরীর থেকে। এ তো মহাশূন্য। ছড়িয়ে পড়লাম। বেশ অদ্ভুত লাগছে। দেখতে পাচ্ছি সব। পুরাতন ভেঙে নতুন, নতুন ভেঙে পুরাতন হয়ে যাচ্ছে। হঠাৎ আমার দেহটা দেখতে পেলাম। ধ্যানে বসে আছে ও। ওকেই দেখবো এবার।
আমি দেখতে পাচ্ছি আমাকে। আমার সামনে। চুপ করে ধ্যান করছে। শিরদাঁড়া সোজা। চিবুক ঈষৎ উপর দিকে তোলা। মুখ হাঁ হয়ে আছে সামান্য। জিবটা (খেচরি মহামুদ্রায়) নরম টাকরা পেরিয়ে নাসা পথ বন্ধ করেছে। সম্ভবত এটাকে কুম্ভক বলে। চোখ অর্ধোন্মিলীত। ভ্রু মধ্যে তাকিয়ে আছে (শম্ভুভি মহামুদ্রায়)। শরীরটাকে ভার শূণ্য মনে হচ্ছে। কাগজের ঠোঙা যেন।
এইবার আমি খুঁজছি আমার ব্যথাটা ঠিক কোথায়।গলার কাছটা ব্যথা করছিল। কান্না পাচ্ছিল। আমি খেয়াল করলাম বিশুদ্ধির সাধনা করতে গিয়ে সেসব কোথায় উড়ে গেছে যেন। এ কি করে সম্ভব। আমার ব্যথা করছিল, সত্যি বলছি। বুকটা দেখলাম। স্পন্দন নেই। চাপড় মারলাম। এতো ঠান্ডা, অসাড়। এতো কিরকম বাসি মড়া মনে হচ্ছে। কি ঘেন্না লাগতো আমার ভেতরে থাকলে। এখন লাগছে না। এসবের মাঝে আবিষ্কার করলাম মন বলে কোনো বস্তুই নেই। ইনফ্যাক্ট ছিল, কিন্তু এই এখন নেই!
হাঁটুর কাছটা খেয়াল করলাম কালো মতো কি একটা। ভালো করে দেখলাম। পিঁপড়ে, কামড়ে ধরে বসে আছে। এখনই পিঁপড়ে ধরে গেল! এই তো সবে মাত্র বের হলাম। কিন্তু আমি অবাক হতে পারছি না। কোনো কিছু ভাবনা আসছে না। তবে দেখছি। নির্বিকার দেখছি পুরো বিষয়টা।
এতো টিপে টাপে যে দেখছিলাম, হাত বলে যে বিষয়টা ভাবছিলাম সেদিকে তাকিয়ে দেখলাম শূণ্যতা একরাশ। এবার দেহটাকে কাটবো আমি। কোথা থেকে শুরু করবো। আমার খুব পছন্দের জায়গা হচ্ছে ক্যারোটিড আর্টারি। দু হাতে দুটো স্ক্যালপেল আছে ভেবে চালিয়ে দিলাম। ফিনকি দিয়ে রক্ত পড়ছে। আচ্ছা এই রক্ত গুলো বোতলে ধরে রাখা যেতো যদি। তারপর ওই ভাবেই হাড়গুলো আলাদা করে একটা কৌটোয় পুরে রাখতাম। আর মাংস গুলো আরেকটাতে।
ব্যথা করছে না। কিন্তু এতো কান্ড করেও আমাকে আমি খুঁজে পেলাম না। অথচ আমি আছি। এই যে দর্শন পদ্ধতি তার মধ্যে আমি আছি। আমি যেখানে আছি সেখানে তাকালে শূন্যতা দেখতে পাচ্ছি। যেখানে আমার দেহ ছিল সেখানে তাকালে শূন্যতা দেখতে পাচ্ছি। অতএব এই শূন্যতা আমি। আমার অস্তিত্ব আমার দেহে নেই। শূন্যতায় রয়েছে।
© শাশ্বত বন্দ্যোপাধ্যায়
Comments
Post a Comment