ভালো থেকো নিশীথ অবশেষ : পর্ব ১৫ — জয়দীপ চট্টোপাধ্যায়
ভালো থেকো নিশীথ অবশেষ : পর্ব ১৫
যেখানে প্রশাসন, পুলিশ, রাজনৈতিক নেতা আর সমাজবিরোধীরা মিলেমিশে ঝালমুড়ির মত এক ঠোঙায় থাকে... সেখানে আলাদা করে অপরাধ আর অপরাধীকে শনাক্ত করার ব্যাপারটাই খুব গোলমেলে হয়ে যায়। এই নিয়ে কোনো পলিটিকালি কারেক্ট স্ট্যান্ড নেওয়ার মানেই হয় না। আজকাল তো আর কিছু রাখঢাক নেই। লাইভ ক্যামেরার সামনেই বুক চিতিয়ে যা করার করে যায় লোকজন। প্রজন্মের পর প্রজন্ম অপরাধ করেও কারো বিরুদ্ধে কোনো এফআইআর অবধি হয়নি। কেউ ঠাকুর, কেউ ব্রাহ্মণ, কেউ মাহান্ত, কেউ জেলা প্রশাসক... একটা লাইসেন্স আছে এদের নিজের ইচ্ছে মত চলার। এবং আইনকে কাঁচকলা দেখিয়েই জীবন কাটিয়ে দেওয়ার। আগেও হত, এখন প্রকাশ্যে সমর্থন এবং বাহবাও জুটে যায়। বাস্তব থেকে সিনেমায় ওয়েব-সিরিজে উঠে এসে, অপরাধ আর অপরাধীরা মনোরঞ্জনের মালমশলা হয়ে গেছে। তাদের ভাষা আর কাজ-কর্ম দেখে হাসছে শহরের দর্শক। কানে বন্দুক ঠেকিয়ে কারো প্যান্ট ভিজিয়ে দেওয়া দেখে হাসি পাচ্ছে। থার্ড ডিগ্রি দেওয়া দেখে হাসি পাচ্ছে। ভুল সময়ে ভুল জায়গায় এসে পড়ে মার খাওয়া বা মরে যাওয়া দেখে হাসি পাচ্ছে। সবার ওপরে ক্ষমতাশালী পরিবারদের দাপট উজ্জ্বল হয়ে উঠছে চোখ-মুখ। কী সহজেই নর্মালাইজ হয়ে যাচ্ছে এমন সব কিছুই... যা আসলে নারকীয়, পৈশাচিক, অন্যায়... পরিকল্পিত এবং সংগঠিত বঞ্চনা আর অত্যাচার।
ছোটোবেলা থেকেই গ্রামে দলিতদের লাথি খেতে দেখেছে কবীর। কারো হাত-পা ভেঙে দেওয়া স্বাভাবিক ঘটনা। বাড়ির চাল বা দোকান ভাঙচুর করে দেওয়া মানে, তারা এমন কিছু বলেছে বা করেছে যা তাদের সাজে না। স্পর্ধা বা দুঃসাহস মেনে নেয় না কেউ। মুসলিমদের গ্রামে অনেকেই গরীব, কিন্তু তারা নিজেরাই নিজেদের ভাগ্যবান মনে করত-- গরীব মুসলমান, কিন্তু দলিত হয়ে জন্মাতে হয়নি। অপরাধ, শোষণ আর বৈষম্যের আলাদা আলাদা মাত্রা। কিছু একেবারেই স্বাভাবিক এবং কেউ শুনবেই না অভিযোগ করলে। কিছু এমন, যা ঘটলে প্রশাসন বা পঞ্চায়েৎ একটু নড়েচড়ে সামাল দেওয়ার চেষ্টা করে। আর কিছু, যা একেবারেই চেপে রাখা যায় না-- আইন-আদালত অবধি যাওয়ার সম্ভাবনা এসে যায়। তারপর জলঘোলাও হয় সেসব নিয়ে। আসলে, এমনই সে টানাপোড়েন যে অভিযোগকারীরাই চায় না এসবের মধ্যে বেশিদিন থাকতে। পেরে ওঠে না। সামর্থ্য নেই বলেই তো শোষিত। পরিবারের একজন খুন হল, নিখোঁজ হয়ে গেল, ধর্ষিতা হয়ে আত্মহত্যা করল... সুবিচার আর দোষীদের শাস্তির প্রবল ইচ্ছে থাকে। কিন্তু ইচ্ছে থাকলেই বা কী? সামর্থ্য নেই বলেই তো শোষিত।
কলেজে পড়তে পড়তেও দেখেছে যুবনেতাদের দাপট আর সমান তালে ঘটে যাওয়া অপরাধ। গ্রামের মত না হলেও, শহরেও অপরাধের ধরণ চিনে নিতে পারত। কিছু চুপচাপ সামলে নেওয়া ছাত্রদের দল ছিল। কিছু নামাজী ছাত্রদের দল। এদের মাঝেই চুপচাপ সামলে কাটিয়ে দেওয়ার একটা কৌশল নিতে হয়েছিল। কোনো একটা দলের মুখ হয়ে গেলে সমস্যা, যে মুখ তার পাশে থাকাও। যারা পক্ষে বলছে, তারাও যে কখন কাজে ব্যবহার করে নেবে... বোঝা যেত না। এডুকেশন লোন নিয়ে পড়তে গেছিল কলেজে, মার খেয়ে বা কিছু বেচাল করে কলেজ-ছুট হয়ে গেলে ঘরে ফিরতে পারত না আর। কবীরের জীবনে সব থেকে কৃতিত্বের কাজই হল, এই জেলা আর রাজ্য ছেড়ে অন্য কোথাও চাকরি করতে আসা।
এখানে অন্ততঃ চোখের সামনে সেই সব দেখে সহ্য করতে হয় না, না দেখার ভান করে চলে যেতে হয় না। এরা জানেই না, সেই সব কিছুর মাঝে বড়ো হয়ে ওঠা কেমন। টিভির পর্দায় দেখা অপরাধজগত বা বাহুবলীদের দুবেলা দেখার অভিজ্ঞতা কেমন। অথচ তারাই সব, একটা রাজ্য পুরো তাদের নিয়ন্ত্রণে। মিডিয়ার সামনে, একজনকে ফেলে তার গালে বুটো জুতো চেপে কথা বলতে পারে। অভিযোগকারীদেরই গৃহবন্দী করে রেখে দিতে পারে। অভিযুক্তদের গলায় মালা পড়িয়ে বুক চিতিয়ে নিয়ে যেতে পারে সামনে দিয়ে। গত দশ-বারো বছরে আরোই বেড়ে গেছে এইসব কিছু। সরাসরি সমর্থন পাচ্ছে এরা। অর্থ আর লোকবল দুটোই ফুলে-ফেঁপে দৈত্যের আকার ধারণ করেছে। যারা প্রতিবাদ করে, কোন মনের জোরে পারে... সে-ও বিস্ময়। এক একজন পুলিশ, উকিল, চিকিৎসক, বা জেলা প্রশাসক... কীভাবে এসবের মাঝেই মাঝে মাঝে নিজের কর্তব্য করে যায়... বিস্ময়!
মানুষ পালাতে পারে না। কী আশ্চর্য মানুষের অত্যাচারে বেঁচে থাকার রেজিলিয়েন্স! ক্রমে এইসব কিছুই স্বাভাবিক মনে হয়। এইসব কিছু কেমন প্রজন্মের পর প্রজন্ম সামাজিক বলেই মনে নিয়েছে।
প্রত্যূষকে নিয়ে এখানে কয়েকজন জাজমেন্টাল কথাগুলো মনে করে হেসে ফেলল কবীর। ঘরে একা ছিল, ঘুমন্ত প্রত্যূষকে বাদ দিলে-- একাই। তাই, ওই দীর্ঘশ্বাসের সঙ্গে বেরিয়ে আসা হাসি কেউ দেখত পেল না। চোখের সামনে অপরাধ দেখার অভিজ্ঞতা না থাকলে, এমন হওয়াই স্বাভাবিক। 'ইয়েহি মিলা, তো ইসপেহি থোপ দিয়া সব কুছ!' খুব ভালো করে লক্ষ করেছে কবীর, প্রত্যূষের নিজের হাতে-পায়ে কোনো চোট-আঘাতের চিহ্ন নেই। এমনকি জামা-কাপড়েও এমন কোনো দাগ বা চিহ্ন নেই। চেহারাই এমন কিছুই আপাত ভাবে চোখে পড়ে না, যা দেখে মনে হয় কারো সঙ্গে ধস্তা ধস্তি হয়েছে। কাউকে ফোর্স করার চেষ্টা করে পালটা প্রতিরোধ পেয়েছে। তাহলে? 'জিসকে সাথ অ্যায়সে হি সব কুছ চলতা হ্যায়... ইতনি ইন্টিমেসি... উসে মার দিয়া... ইঁয়ু হি?'
এমন ঘটতেও দেখেছে কবীর, কেউ কোথাও অপরাধ করে। তারপর তাকে বাঁচাতে অন্য কারো ওপর দোষ চাপিয়ে কেস সাজানো হয়। কিছুক্ষেত্রে, সচেতন ভাবেই একজন অন্যের অপরাধ নিজের ঘাড়ে নিয়ে জেলে চলে যায়। সে অন্যের নামে হাজত খাটে, আর তার পরিবার মাসিক টাকা পায় বা এককালীন কিছুটা। তারপর লোকজন ভুলে গেলে একসময়ে ছাড়াও পেয়ে যায়। প্রজাতন্ত্র দিবস, গুড কনডাক্ট, প্যারোল... অনেক কলকাঠি নাড়া যায়। উকিলরা এসব জানে। ওর এক বন্ধু ক্রিকেট ম্যাচের ওপর বেটিং করে ধরা পড়ে গেছিল। বেটিং অনেকেই করে, খুব সাধারণ ঘটনা এখন জুয়া খেলা। কিন্তু ও কারো টাকা মেরে চোট করে দিচ্ছিল বলে তারা ওকে বড়ো কেসে ফাঁসিয়ে দিল। এক বছরের জেল, কমে ছ মাস হল। ওকে দেখতেও গেছিল জেলে। এই কথাগুলো অফিসের দুজনকে একবার বেটিং প্রসঙ্গে বলতে কেমন অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখছিল ওরা... যেন কবীর নিজেই জেল ফেরৎ!
এমনিতেই অন্তর্মুখী কবীর। কলেজে ভালো রেজাল্ট করেও সেই নিয়ে বলে না, অফিসে অ্যাপ্রিসিয়েশন পেলেও সেই নিয়ে বেশি জানায় না কাউকে। মাঝে মাঝে এমন কিছু কথা বলে বুঝে গেছে-- কোনো বাইরের প্রসঙ্গে কথা বলারও সময় নেই আর। খুব সহজেই সবাই জাজমেন্টাল হয়ে যায় এখন। যেমন এখন হচ্ছে, প্রমাণ ছাড়াই প্রত্যূষ গিলটি এদের কাছে। যে ছেলেটা ঠিক করে কিছুই বলতে পারেনি এখনো। নিজেই ট্রমাটাইজ্ড হয়ে ছিল।
--- --- ---
'জীবন খুব আনজাস্ট, তাই না অপ্রতিম দা?'
টায়রার গলার আওয়াজে চমকে উঠল অপ্রতিম। একটা ক্রমশ চাপ বাড়িয়ে চলা পরিস্থিতি আর দুশ্চিন্তা যেভাবে স্থিতিকে বিচলিত করে। কথাটা ঠিক বুঝতে পারেনি, এমন করে টায়রার দিকে তাকিয়ে রইল। দু-তিন সেকন্ড পর মুখ দিয়ে শুধু বেরলো 'হুম?' টায়রা চুপ করে তাকিয়ে রইল ওর দিকে, ভাবল প্রশ্নটা ঠিক ওভাবেই আবার জিজ্ঞেস করে। এইটুকুই যথেষ্ট, একই সঙ্গে ব্যপ্ত এবং বহুমাত্রিক। কিন্তু রেসর্টের পাশে পুকুরের ধারে হাঁটতে হাঁটতে যে অপ্রতিম টায়রার এক-একটা কথার উত্তর দিচ্ছিল, সেই অপ্রতিম এই প্রশ্নকে যেভাবে গ্রহণ করত... এই অপ্রতিম কি তা পারবে? জানতে ইচ্ছে করছিল খুব, সেই অদম্য ইচ্ছেকে স্ট্রোলের মত জড়িয়ে সামলে নিল টায়রা। বদলে গেল কথাটা, দু-তিন ধাপ নেমে এলো অভিঘাত। 'বলছিলাম... জীবন এতটা আনজাস্ট আর আনপ্রেডিক্টেবল না হলেই ভালো।' অপ্রতিম দুটো শব্দই শুষে নিল যেন, কোনো একটির ওপর ভর করে পালটা প্রতিক্রিয়া দিল না। উলটে জিজ্ঞেস করল, 'এখন আগের থেকে স্টেবল হয়েছে?' টায়রা হাসল, দেওয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে দাঁড়াল ঠোঁটে হাসি নিয়েই। সেই হাসির সঙ্গে অপ্রতিমের প্রশ্নের আদৌ কোনো সম্পর্ক থাকার কথা নয়। সেই দৃষ্টিও বিশেষ ভাবে কাউকে খুঁজছে না, শুধু তাকিয়ে আছে। সিকিওরিটি গার্ড ভাববে তাকে দেখছে, কৌতূহলী নিত্যবাবু ভাববেন তাঁকে দেখছে। গেটের কাছে কারো আসার অপেক্ষায় অস্থির হয়ে পড়া অনশু ভাববে ওকে দেখছে।
'ওরা তো ভালোবাসে দুজন দুজনকে... অপ্রতিমদা?'
টায়রার শুকনো হাসিটা একেবারেই মিলে গেছে। পরিবর্তে নেমে এসেছে একটা অব্যক্ত বেদনার ছায়া। কিন্তু ওর এই আঘাত অনুভূতি কেন? কথাগুলো বলার সময়ের ওর গলাটা কেমন অন্যরকম লাগল অপ্রতিমের। এই পরিবেশেও অন্যরকম লাগল খুব। একটা চাপা আকুতি, অন্য কোনো অপূর্ণতার অনুরণনে কেঁপে ওঠা। 'ওরা' বলতে কাদের কথা বলছে বুঝতে পারল অপ্রতিম। ওরা যেখানে আছে, সেখানে কোনো কথা নিচু স্বরে বললে গেটের কাছে বা রিসেপশনের কাছে থাকা কেউই স্পষ্ট শুনতে পাবে না। শুধু আন্দাজ করতে পারবে কিছু কথা হয়ত, মন দিয়ে লক্ষ করলে। ওদিকে তাকিয়ে অন্যদের এক নজর দেখে নিয়েই অপ্রতিম বলল, 'তো কী হয়েছে?' টায়রা এই প্রশ্নের কোনো উত্তর দিল না। চুপ চাপ মাথা নিচু করে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে অপ্রতিমের চোখের দিকে তাকিয়ে একই রকম বেদনার অনুরণন নিয়ে বলল, 'কাউকে ভালোবাসে এতটা কষ্ট দেওয়া সম্ভব?'
যেভাবে পরোক্ষ নির্দেশ দিয়ে কিছুক্ষণ আগে অপ্রতিমকে ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে বলেছিল টায়রা, তারপর আহত হওয়া ইগোটা আবার স্বাভাবিক হতে কিছুটা সময় দাবী করে। অপ্রতিম সেই সময়টাই চাইছিল, চুপচাপ বাইরে বসে। অভীক আর ভিভানের অপেক্ষায়। মনে মনে ভাবছিল করছিল-- এই দুটো মেয়ে গেলে বাঁচে। কৃষাণুকেও পাঠিয়ে দিতে হবে গাড়িতে,দৃশ্যতঃ ওর শরীর ভালো নেই। তা অনভ্যস্ত ভাবে বাড়তি মদ্যপানের কারণেই হোক, বা স্ট্রেসের কারণে। এমনিতেই, কৃষাণুর কাছে নিজেকে অপরাধীই মনে হয়। অতসী আসলেই কারো নয়, কারো হতে চাইল না। এটা ও বোঝে না। অতসী অপ্রতিমকে পাশে চেয়েছিল , অপ্রতিমই পারছিল না এভাবে কিছু টিকিয়ে রাখতে-- এটাও না। একটা ঐকিক হিসেব করে নিয়েছে কৃষাণু-- বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্ক, পরকীয়া। কৃষাণু নিজেকে চিটেড মনে করে, এবং অতসীর থেকেও বেশি দায়ী করে অপ্রতিমকে। অপ্রতিমের সঙ্গে এই নিয়ে আর কথাও চায় না। কথার কিছু নেইও আসলে। অতসী ফিরবে না কারো কাছেই। মিউচুয়াল ডিভোর্সটাও হয়ে গেছে ওদের মধ্যে। বাকি থেকে গেছে যা... তা ওই ফ্যান্টম স্পেস আর ফ্যান্টম পেইন। কৃষাণুকে দেখলে যে অপরাধবোধ জেগে ওঠে, তা যে কতটা সংগত-- ভেবে পায় না অপ্রতিম। নিজের কাছে নিজেকে জাস্টিফাই করার এই ইনভলিউন্টারি থট প্রসেস থেকে বেরোতেও পারে না। এই যে অতিরিক্ত হার্ড ড্রিংক খাওয়া, ওভাবে চুপচাপ অপ্রতিমের দিকে তাকিয়ে থাকা সারাদিন-- মাঝে মাঝে প্রবল ভাবে হন্ট করে। মনে হয় অতসীর কাছেই ছুটে যায় আবার, এবং এইসব কিছুর দায় নিয়েই স্পষ্ট ভাবে বলে-- যখন দোষীই হয়েছি, আর কেন এভাবে লুকিয়ে দূরে থাকা?
কিন্তু ওভাবে কী ফেরা যায়? অতসীযে স্পষ্ট সিদ্ধান্ত নিয়ে চলে গেছে। অতসী যে চায়নি-- ওর বা ওর সন্তনের প্রতি 'কর্তব্য' করার চেষ্টা করুক কেউ!
এইসব চিন্তার মধ্যে থেকেই অপ্রতিম বলে ফেলল -- 'সব কিছু এত লিনিয়ার হয়?'
টায়রা একই ভাবে দেওয়ালে পিঠ দিয়ে দাঁড়িয়ে রইল। ঠোঁট টিপে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল ওপর দিকে। তারপর চোখে চোখ না রেখেই বলল, ' জানি না... ভালোবাসার সঙ্গে এমন ফিজিকাল ব্রুটালিটি...'
- জানো না... তাই হয়ত।
- হতে পারে?
- তুমি অনেক সচেতন। সংবেদনশীলও... যতটা বুঝেছি। তুমি সত্যিই এই বিষয়ে সংশয়গ্রস্ত?
-
- ইয়ু রিয়েলি ডাউট... দ্যাট প্যাশন কুড বি ব্রুটাল অ্যান্ড ভেঞ্জফুল?
- এভাবে সম্পর্ক আহত হলে...
- আহত হলেও সম্পর্ক টিকে যায়। সে অন্য প্রশ্ন।
-
- আসলে যা বললাম, কিছুই অমন বাইনারিতে বসে যায় না। অত লিনিয়ার না।
-
- মানুষ যাকে তীব্রভাবে চায়, ভালোবাসে... জ্ঞাতে অজ্ঞাতে, তাকেও তীব্র আঘাতে জর্জরিত করে দেয়।
-
- জর্জরিত... সিভিয়ারলি উন্ডেড।
- ওটুকু বুঝি।
- তবে সব আঘাৎ এমন এক্সটার্নাল ব্লান্ট ফোর্সের চিহ্ন রাখে না। এমন ট্রমা বা ফিজিকাল অ্যাবিউজের চিহ্ন রাখে না।
-
- আগেন, লিনিয়ার নয়, আলাদা ডিমেনশন থাকে সব কিছুর। যাক গে... এসব কথা পরে কখনো...
- সেই ভালো অপ্রতিম দা, ছাড়ুন। তবে কি জানেন?
- কী?
- ভালোবাসার বা খুব কাছের মানুষের থেকে এমন আঘাৎ পেলে কী করব জানি না।
- আর অন্যরকম আঘাৎ পেলে?
-
- আঘাৎ চিনে, সচেতন ভাবে তা ধারণ করে, তার সঙ্গে রিকনসাইল করা... আলাদাই ব্লিডিং। না?
-
- আচ্ছা বাইনারি দিয়েই যদি ভাবো... হয় প্রত্যূষ ওকে ভালোবাসে না, তাই এমন করল। না হলে প্রত্যূষের পক্ষে এটা করা সম্ভব নয়... তাই না?
একটা অন্য খাতে বয়ে যাওয়া কথোপকথনের মাঝে হঠাৎ এই লজিকাল প্রশ্নের মাঝে এসে পড়তে হবে, বুঝতে পারেনি টায়রা। চমকে গিয়ে তাকাল অপ্রতিমের দিকে, কয়েক মুহূর্ত একই ভাবে ওর দিকে তাকিয়ে থেকে জিজ্ঞেস করল-- প্রত্যূষ নয়?!
- কান্ট সে। হোয়াট ইফ...
- ওই ঘরে আর কে ছিল?
- তুমি আর আমি তো ছিলাম না।
- স্যাম্পেল টেস্ট করলে...
- হুম, অতদূর গড়ালে...
- না হলে বুঝব কী করে? এটা তো ক্রিমিনাল অফেন্স। শি ইজ আ ভিক্টিম অফ ব্রুটালিটি লাইং ইন দেয়ার!
- বলতে চাইলাম, ইনভেস্টিগেশন এবং সব স্যাম্পেলের টেস্টের রেজাল্ট এলে বোঝা যাবে। যাওয়া উচিৎ।
-
- কিন্তু ভেবে দেখো, প্রত্যূষের ডিএনএ পাওয়া গেলেই যে ও-ই এটা করেছে, এমন তো নাও হতে পারে... না?
- আপনি বলছেন...
- অফকোর্স। ওদের মধ্যে কনসেনসুয়াল ইন্টিমেসি এক্সপেক্টেড। এটা তুমিও জানো।
- একটা কথা বলব? জানি খুব অড লাগবে... হয়ত বিকৃত, কিন্তু না বলেও পারছি না।
- কী?
- আই রিয়েলি হোপ, প্রত্যূষ এটা করেনি। ওর জন্য না... আসলে আমি নিজেই নিতে পারছি না...
- ...কেউ ভালোবাসলে এমন ব্রুটাল কী করে হতে পারে।
কথাগুলো বলে অপ্রতিম হালকা হাসল। তারপর মাথাটা দুদিকে নেড়ে হাতদুটো মাথার পেছনে রেখে চেয়ারে হ্যালান দিয়ে বসল সিলিং-এর দিকে তাকিয়ে।
'আমি এখান থেকে যাব না অপ্রতিম দা।'
কিছুক্ষণ চুপ করে ওভাবেই দাঁড়িয়ে ছিল টায়রা। তারপর হঠাৎই নীরবতা ভেঙে কথাগুলো বলল টায়রা। নিচু গলায় অথচ বেশ দৃঢ়তার সঙ্গেই বলল।
- মানে?
- অভীকদের সঙ্গে অনশুকে পাঠিয়ে দিন। কৃষদাকেও পাঠিয়ে দিতে পারেন... আমি যাব না।
-
- পুলিস ইনভেস্টিগেশন হলে ব্যাপারটা খুব কমপ্লেক্স হয়ে যাবে, না?
- সে তুমি থাকলেও হবে, না থাকলেও হবে।
- কিন্তু আমি যাব না। রাগিনীকে একা রেখে কিছুতেই যাব না আমি।
- রাগিনীকেও তো নিয়ে যাব আমরা।
- কোথায় নিয়ে যাবেন?
- ও কি এখানেই থাকবে নাকি? উই হ্যাভ টু শিফট হার...
- ওর বাড়ির লোককে খবর দিয়েছেন?
-
- শিফট ওরা এসে করলেই ভালো হয়ে অপ্রতিমদা। আমরা অনেক বেশি রিস্ক নিয়ে ফেলছি।
- বাড়ির লোকই করুক... সকালে ফোন করা হবে।
- পুলিশও এসে যাবে সকালে...
-
- ব্যাপারটা হাশ আপ করতে চাইছেন... না?
- হোয়াট আর ইউ সেইং?
- হোয়াট অ্যাম আই সেইং?! জাস্ট লুক অ্যাট ইয়োরসেলফ!
-
- রাগিনী ভায়োলেটেড হয়েছে অপ্রতিমদা। কিছু একটা হয়েছে... কেউ একজন করেছে।
- এই রুথলেস ছেলেগুলো নিজেরা যা করার করে...সবাইকে একেবারে নিয়ে...
- নিয়ে ডোবে। অন্যদের ইমেজ, অর্গ্যানাইজেশনের গুড উইল... এই কারণেই...
- এই কারণে কী?
- হাশ আপ করতে চাইছেন।
-
- আপনার কী মনে হয়, রাগিনীর জ্ঞান ফিরলে ও চুপ থাকবে? অন্যরা কেউ প্রত্যূষের কথা বলবে না?
- প্রত্যূষ এটা করে থাকলে রাগিনী নিজেই হয়ত কোনো স্টেটমেন্ট দেবে না... মিলিয়ে নিও।
- অপ্রতিমদা, এই কেস এনকোয়ারি হবেই। রেসর্ট হোক, রাগিনীর ফ্যামিলি হোক, এই ডক্টর হোক... দে উড স্পিক। দে হ্যাভ টু! হোয়াই আর ইয়ু বিকামিং দ্য রং গাই ফর নো গুড রিজন?
- বিকজ দ্য ফাকিং অ্যাকাউন্টিবিলিটি লাইজ উইথ মি। কম্পানি সব কিছুর জন্য আমাকেই স্লটার করবে!
অপ্রতিমের গলার আওয়াজটা এক ধাক্কায় দ্বিগুণ হয়ে গেল। সকলেই ওর দিকে তাকিয়েছে এইবার। অনশু চমকে উঠে ওদের দেখছে গেটের সামনে থেকেই। মনের মধ্যে অ্যাংজাইটি এসে গেছে, ভিভানরা এলেই এখান থেকে পালিয়ে বাঁচবে। টায়রা বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে রইল অপ্রতিমের দিকে। এই আউটবার্স্টটা হয়ত প্রত্যাশা করেনি। উত্তরটা এমনই কিছু হতে পারে, আন্দাজ করতে পারলেও... প্রত্যাশা করেনি। শুধু সংযত ভাবে সংক্ষিপ্ত উত্তর দিল। একটা প্রশ্নই ভাসিয়ে দিল উত্তরে -- 'ব্যস? এই কারণে?'
মাথা নিচু করে বসে রইল অপ্রতিম। রোগীদের পরিবারের সদস্যরা এইসব প্লাস্টিকের চেয়ারে বসে সারাদিন অপেক্ষা করে। দুশ্চিন্তা, উদ্বেগ অথবা উৎকণ্ঠা নিয়ে। দু-হাত দিয়ে নিজের মাথাটা ধরে মাথা নিচু করে বসে রইল। অসম সমরে একা পরাজিত সৈনিক। টায়রার থেকে এতক্ষণ যে মরাল এবং মেন্টাল সাপোর্টটা প্রত্যাশা করছিল, একটা আউটবার্স্টেই সেটা ভেঙে চৌচির হয়ে গেল। একটা অন্য অপ্রতিমকে চিনে ফেল টায়রা। আর কোনোভাবেই এই আত্মকেন্দ্রিক কর্পোরেট অপ্রতিমের চেহারাটা আর ভুলবে না কোনোদিন। টায়রার চোখের দিকে না তাকিয়েও বুঝতে পারল, ওর চোখে অবিশ্বাস আর হঠাৎ করেই একটা জেগে ওঠা দুঃখ। অপ্রত্যাশিত আঘাতের ব্যথা। 'অপ্রতিমদা... আপনিও?'
'আই কন্ট্যাক্ট' করার মত মনের জোর পেল না অপ্রতিম। এত দ্রুত সরি বলতেও ইচ্ছে হল না। একটা মিথ্যে দুঃখ প্রকাশ। একটা নিষ্ঠুর নির্লজ্জ সত্যিকে ঢাকতে একটা ফালতু পোষাকী মিথ্যে। তার বদলে বলল, ' যেটা ঘটার ঘটবে... ইনভেস্টিগেশন হওয়ার হলে হবে। রাগিনী সুস্থ হয়ে এখান থেকে ফিরলে...'
শব্দগুলো গুছিয়ে থেমে থেমে বলছিল অপ্রতিম। শেষ করার আগেই মাথা তুলে দেখল টায়রা ওখানে আর দাঁড়িয়ে নেই। চলে গেছে।
(চলবে)
© জয়দীপ চট্টোপাধ্যায়
পোস্টার : ত্রিবিন্দু
Comments
Post a Comment