ভালো থেকো নিশীথ অবশেষ —পর্ব ১২ : জয়দীপ চট্টোপাধ্যায়
ভালো থেকো নিশীথ অবশেষ: পর্ব ১২
- আরে চোখ লেগে গেছিল... বুঝতে পারিনি।
- চোখ লেগে গেছিল মানে? তোমেক কি এমনি এমনি পাঠালাম ওখানে?
-
- যাক গে! এখন কী সিন বলো।
- খুব একটা ভালো মনে হচ্ছে না।
- মানে?
- মানে, একটু আগে কথা কাটাকাটি হচ্ছিল... একটা মেয়ে একা বেরিয়ে যাচ্ছিল নার্সিং হোম থেকে।
- কে বেরিয়ে যেতে চাইছিল? কী বলছ ঠিক করে বলো!
- আরে অন্য মেয়েটা, রোগা মত যেটা।
- যে অজ্ঞান হয়ে গেছিল তার কী অবস্থা?
- বুঝতে পারছি না ঠিক, এখনো তো ভেতরেই আছে।
- মানে? তুমি ভেতরে থাকছ না?
- গেছিলাম তো বার দুয়েক, তোমাকে তো জানালাম তখন।
- তাহলে? থাকতে দিচ্ছে না নাকি?
- না... ডাক্তারই বেশি লোক ঘরে থাকতে দিচ্ছে না।
- ঘরের ভেতর থাকতে হবে না, নার্সিংহোমের ভেতরে থাকো। চোখে চোখে রাখো... এত করে বলে দিলাম, এত বার বুঝিয়ে দিলাম... কী যে করছ গিয়ে! এর চেয়ে আমি নিজে গেলেই ভালো হত। ধোর!
- আমি যাচ্ছি এখন একবার। জানাচ্ছি তোমাকে।
- দয়া করে ওদের সামনে ফোন করো না।
- আচ্ছা
- আর শোনো...
- কী?
- কতটা সিরিয়াস কেস জানিও। অন্য গেস্টরা আছে। চাপ হয়ে যাবে সকালে ব্যাপারটা অন্য দিকে গেলে।
- ঘাপলা তো আছেই কিছু।
- হুম, কিছু তো ঘাপলা আছেই। যাক গে, তুমি আবার ঘুমিয়ে পড়ো না। গ্যাঁট হয়ে বসে থাকো ভেতরে... জানাও।
- হ্যাঁ হ্যাঁ...
নিজের মত কথাটা শেষ করেই ফোনটা কেটে দিল রেসর্টের নাইট শিফটে থাকা ম্যানেজার। সাধারণতঃ রাতের ডিউটিতে চাপ কম থাকে। নিয়মের কিছু কাজ দেখেই ঘরে গিয়ে পছন্দ মত জমিদার-বাড়ির একটা রাজকীয় ঘরে গিয়ে কেদারায় শুয়ে-বসে কেটে যায়। অনেকে পছন্দ করে নাইটে কাজ করতে। কাজের চাপ কম থাকে, আর এই বিলাসীতার কিছু কিছু অংশে ভাগও বসানো যায় সকলের অজ্ঞাতে। অথচ আজ যে কী থেকে কী হয়ে গেল! তার ওপর যাকে পাঠিয়েছে, সেও ঠিক মত খবর দিতে পারছে না। ফোনটা নামিয়ে টেবিলের ওপর রেখেই বসে রইল সচেতন হয়ে, যদি কিছুক্ষণের মধ্যেই একটা ফোন আসে।
দুটো ছেলে কিছুক্ষণ আগে বাইক নিয়ে চলে গেল, সিকিওরিটির সঙ্গে কথা হল... ওদের ডেকে পাঠিয়েছে নার্সিং হোমে, মেয়েদের রেসর্টে ফিরিয়ে আনবে।
ঠিক বিশ্বাস হল না কথাগুলো। ওরা থাকবে, মেয়েরা গাড়িতে ফিরে আসবে... কেন?
গেটের কাছে সিকিওরিটি গার্ডদের জানিয়ে দেওয়া হয়েছে, রাতে কেউ বেরোতে চাইলে যেন অফিস-ডেস্কে সঙ্গে সঙ্গে খবর দেওয়া হয়। ওরা জানে, একটা পার্টির মধ্যে কিছু একটা হয়েছে। শুধু সিকিওরিটি গার্ড নয়, জমিদারবাড়ির কর্মচারীরা প্রায় সকলেই জানে, এখানে ওখানে থাকা ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরাগুলোর কথা। কেউ যাওয়া আসা করলে, তাদের ওপর নজরদারি চালানোর ব্যবস্থাও আছে একটা সিকিওরিটি সার্ভেলান্স রুম থেকে। যদিও, কেউ সব সময়ে তাকিয়ে থাকে না, ওগুলো শুধু ব্যবস্থা করে রাখার জন্যই করে রাখা। ফুটেজ স্টোর হয়ে যায় হার্ড ডিস্কে নিয়মিত। এইসব জানে বলেই, কর্মচারীরা সেইসব দিকে গেলে সচেতন থাকে, যেখানে ক্যামেরাগুলো আছে। কিন্তু অতিথিরা সবসময়ে খেয়াল করে না। তারা কোথায় কী করছে, নিজেদের অজ্ঞাতেই কী করে ফেলছে-- সব কিছু দেখতে দেখতে , লুকিয়ে লুকিয়ে মানুষের ঘরে উঁকি দেওয়ার মত কৌতুক অনুভব করে কোনো না কোনো নিরাপত্তারক্ষী। একটা নেশার মত হয়ে যায়, কিছু বিশেষ বিশেষ স্থানে থাকা ক্যামেরার ওপর নজর রাখা। মানুষ নিজের কৌতূহলকে জয় করতে পারে না। রাগ আর বিরক্তি লুকোতে পারে না। সংযম কত ঠুনকো। বেড়াতে এসেও কত কিছুর মধ্যে জড়িয়ে থাকে... সবই ধরা পড়ে যায় ক্যামেরায়। বিশেষ করে, বেড়াতে এসে আড়াল খোঁজে যারা, তাদের সেই গোপন মুহূর্তগুলো তাদের অজ্ঞাতেই দেখে মুচকি মুচকি হাসছে কেউ... তারা বুঝতেই পারে না।
এভাবেই, রাতেও এখানে ওখানে ছুটোছুটি, কান্না আর ব্যস্ত হয়ে কিছু লোকজনের একটি সংজ্ঞা হারনো মেয়েকে নিয়ে দ্রুত গাড়ি করে চলে যাওয়া-- সবটাই ধরা পড়ে গেল সিসিটিভি ফুটেজে। অথচ, ওই কোণের দিকের ঘরটার কাছে এমন কোনো সিসিটিভি ক্যামেরাও নেই। ওদিকে সব থেকে কাছাকাছি যে ক্যামেরা, তার নজরে আসা ব্যক্তিদের আসা-যাওয়া দেখে বোঝা সম্ভব না যে ঠিক ওই ঘরটায় কে কখন গেল, আর এলো। নাইট ডিউটি থাকলেও, কানে ইয়ারফোন দিয়ে নানারকম ভিডিও আর সিনেমা দেখে যায় বিহারী সিকিওরিটি গার্ড ছেলেটা। দেখতে দেখতে অন্যমনস্ক হয়ে যায়...
' ঘরটায় কাউকে থাকতে দেওয়া হয়না। তালা বন্ধ থাকে। আর কোনো ঘর পেল না? কী এমন ঘটে গেল ওই ঘরে?'
গাড়ি করে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে একটা মেয়েকে, এখনো ফেরেনি ওরা। রাতে এসে নেশা করে মাঝে মাঝে এদিক-ওদিক হয়। কিন্তু এত রাতে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার মত ঘটনা এই প্রথম। অন্য গেস্টদের মধ্যে কেউ কেউ দেখেছে... কিছু একটা আন্দাজ করেছে। রেসর্টের ম্যানেজার এটাও বলে দিয়েছে সবাইকে-- কেউ কিছু জিজ্ঞেস করলে বলবে, আমরা জানি না। ম্যানেজারবাবুকে জিজ্ঞেস করুন। অবশ্য সবাইকে এক উত্তর শেখানো হয়নি এভাবে। একটু ঘুরিয়ে-পেঁচিয়ে বলতে হবে।
কেউ বলবে-- জানি না।
কেউ বলবে-- দেখলাম গেল, বুঝতে পারলাম না।
কেউ বলবে-- বেশি মদ খেয়ে ফেলেছিল, বাড়ি নিয়ে গেল।
কেউ বলবে-- বাড়ি থেকে ফোন করেছিল, চলে গেল।
তবে কথা শেষ হতে হবে ওখানে-- ম্যানেজারবাবুকে গিয়ে জিজ্ঞেস করুন।
অনেক কিছু থেকে একটা-দুটো রাতের জন্য পালিয়ে এসে, কেউই আর নতুন করে সমস্যা নিয়ে ভাবতে চায় না বেশি। এই বিলাসবহুল জমিদারবাড়ির রেসর্টে ভালো থাকার একটা মূল্য আছে। সবাই চায়, খরচটা উসুল করে নিতে। অথচ, কিছু একটা অস্বাভাবিক ঘটে গেছে জানলে... কৌতূহলটাও সরাতে পারে না মন থেকে। একজনের সমস্যা, আর একজনের কাছে কৌতূহলের বিষয়। এই অতিথিদের মাঝেই, কেউ কারো কাঁধে হাত রেখে হয়ত বুঝিয়েছে-- ছেড়ে দাও, তুমি এত জেনে কী করবে? চলো ঘরে চলো। দেখো কী সুন্দর লাগছে চাঁদটা... অন্য কিছু নিয়ে কথা বলো, প্লিজ। অন্য কিছু শুনতে ইচ্ছে করছে আজ।
কাউকে কাছে ডেকে, আজ আমি খুব ভালো আছি... এসো, শোনো আমি কতটা ভালো আছি আজ-- এটুকু বলার মত মানসিক প্রস্তুতিই কী কঠিন হয়ে উঠছে এখন। ইচ্ছে করলেও, সবাইকে সব সময়ে মন থেকে মনের কথাটা বলা যায় না। আর যখন বলতে ইচ্ছে করে, যাকে বলতে ইচ্ছে করে... সেও যদি শুনতে না চায়...
একটাই রাত, তাও কী দ্রুত বদলে যায়! এখন সারাদিনের ছবি, ছোটো ছোটো ভিডিও, আর নেশার আচ্ছন্নতা নিয়ে যার যার ঘরে ঘুমিয়ে পড়ার কথা। কেউ কেউ অনেক রাত অবধি জেগে থাকতে চাইলেও, এতক্ষণে চোখ জুড়িয়ে আসার কথা। কেউ কেউ হয়ত ইচ্ছে করেই চাইবে, এই ঠান্ডায় একটাই ব্ল্যাঙ্কেট ভাগ করে নিতে। অথচ একটাই রাত... কয়েক ঘন্টার ব্যবধানেই কী দ্রুত বদলে যায়।
সারা সন্ধ্যে এতরকম ভাবে হুল্লোড় করে, দারুণ একটা ডিনার করে সকলেই যে যার মত ঘরে ফিরে এসেছিল। তিন-চারজন ছেলে একসাথে আড্ডা দিচ্ছিল বিয়ারের বোতল অথবা সিগারেট হাতে নিয়ে। সেরকমই তিন-চারজন মেয়ে, নিজেদের মতই একটা ঘরে বসে ভাবছিল-- কীভাবে রেসর্টের রাতটা আর একটু ভালো ভাবে উপভোগ করতে করতে ঘুমিয়ে পড়া যায়। যে যার মত একে একে রাতের পোশাক পরে হালকা হয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছিল। তারই মাঝে কখনও উঠে আসছিল অফিসের টিমের এখনকার অবস্থার কথা। কে কী করবে ভাবছে, সে সব ইঙ্গিত। নিজেদের ভালো লাগা আর না লাগাকে কৌশলে কাটিয়ে প্রসঙ্গান্তরে চলে যাচ্ছিল কেউ কেউ। রাগিনী আর টায়রার এই আড্ডায় না থাকা নিয়েও কথা উঠল। ডিনারের পর অনেকক্ষণ কেটে গেল... অথচ রাগিনী আর টায়রার দেখা নেই। প্রত্যূষের ঘরেই কি রাতটা কাটিয়ে দেবে টায়রা? নাকি দুজনে অন্য কোনো ঘরের ব্যবস্থা করে নিল? এই নিয়ে এক রাউন্ড হাসির রোল উঠল। টায়রার সারা সন্ধ্যে অপ্রতিমের কাছে কাছে থাকা নিয়েও দু একটা মন্তব্য এলো। রাগিনীর ব্যাপারটা না হয় বোঝা গেল, কিন্তু টায়রা... সেও কি কোনো ঘরে চলে গেল নাকি? প্রাজক্তা টায়রাকে টেক্সট করতে যাবে... ঠিক তখনই বাইরে থেকে একটা চেঁচামেচির শব্দ ভেসে এলো! সবাই একসাথে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। কথায় কথায় এখনো প্রশ্নটা চলে আসছে মাথায়, কারা ছিল না ঘরে? রাগিনীকে বাদ দিলে আর কারা ছিল না ঘরে তখন?
কোথাও নাইট-স্টে করতে গেলে এখনো হিসেব করে দেখে নিতে হয়, গ্রুপে কজন মেয়ে আছে। তারা কারা। তারাও রাতে থাকবে নাকি আগেই চলে যাবে বাড়ি। সাত-আট জন মেয়ে যাচ্ছে, এটা অনেকের কাছেই একপ্রকার গুরুত্বপূর্ণ যুক্তি ছিল বাড়িতে অনুমতি পাওয়ার ব্যাপারে। এখন ছাত্রী নেই, অফিসে কাজ করে... তবুও একটা অনুমতির টোলগেট এসে যায়। বাড়িতে লুকিয়ে অথবা বাড়ির অসম্মতিতে যা কিছু রোমাঞ্চকর অভিযান, তারও একটা উপস্থাপনযোগ্য মোড়ক দরকার হয়। এখন অনেকেই ভাবছে মনে মনে, ভাগ্যিস বাড়িতে জানানো ছিল। সাত জনের মধ্যে এই মুহূর্তে কেবল চার জনই আছে রেসর্টে। প্রায় দুঘন্টা হয়ে গেল, দোতলার একটা ঘরের ভেতর নিজেদের একরকম অবরুদ্ধ করে রেখে দিয়েছে। রাতে দায়িত্বে থাকা রেসর্টের এক কর্মী একবার খোঁজ নিয়ে গেছিল এসে। একজন পরিচারিকাকে ডাকতে বলে গেছে কিছু দরকার লাগলে। সে নাকি দোতলাতেই থাকে কোণের দিকের ঘরে।
কিন্তু ওরা আর কাউকে ডাকেনি। খালি মনে হচ্ছে, কথা হলেই প্রশ্ন আসবে। অস্বস্তি বাড়বে। কথা বলতে গেলেই সামনে দাঁড়িয়ে থাকা ব্যক্তির চোখে হয় সংকোচ, না হলে প্রশ্ন দেখতে পাচ্ছে। ছেলেদের ঘরের দিকেও যাবে না ওরা আর রাতে, ঠিক করে নিয়েছে। কেউই যাবে না। কোনো বাড়তি কথা, অথবা বিব্রতকর পরিস্থিতি এড়িয়ে চলাই কাম্য। ফোন ব্যাপারটা এড়িয়ে গিয়ে মাঝে মাঝে চুপাচাপ ম্যাসেজ করছে কথার মাঝে। কে কাকে কী বলছে, কার থেকে কী জানছে... তা ব্যক্তিগত গোপনীয়তার আওতায় রাখা হচ্ছে সচেতন ভাবেই। হয়ত ঘনিষ্ঠ কাউকে, ভরসাযোগ্য, অথবা পরিবারের একজনকে কিছুটা জানিয়ে রাখা গেল। হয়ত কিছু খবর এলো টায়রা অথবা অনশুর থেকে, যা আপাতত নিজের কাছেই থাকবে। সকলে সকলকে যে খুব পছন্দ করে, এমনও না... রাগও হচ্ছে মাঝে মাঝে। নিজের ওপর, পরিস্থিতির ওপর... অন্য কোনো ব্যক্তিদের ওপরেও।
প্রাজক্তা চুপচাপ শুয়ে আছে সিলিং-এর দিকে তাকিয়ে। ঘরে নাইট ল্যাম্প জ্বলছে। ব্রততী, অন্তরা, স্মিতা... বাকি তিন জন সহকর্মীও একই ঘরে। ঘেঁষাঘেঁষি করে একটাই কুইন সাইজ বিছানায় শুয়ে আছে। পুরনো আমলের নকশা করা রানিমাদের খাট। খাটে ডিম্বাকৃতি আর্শি বসানো। আর্শির কাচ মুছে পরিষ্কার করা হলেও পুরনো দিনের দাগ ধরে আছে। সময়ের দাগ। কিছু কিছু বদলে যাওয়া রাতের স্মৃতি। জড়বস্তুর স্মৃতি থাকলে, এবং সেই স্মৃতির নাগাল পাওয়া গেলে ভয়ানক অস্বস্তিতে পড়ত মানুষ। এমন অনেক কিছু দেখা বা জানা হয়ে যেত, যা অজ্ঞাত থাকাই ভালো।
অন্য যারা একই বিছানায় গায়ে চাদর অথবা কম্বল টেনে শুয়ে... তাদেরও চোখে ঘুম নেই। কেউ বালিশে মাথা রেখে শুয়ে, কেউ আধশোয়া। নিজেদের মধ্যেই একটা বোঝাপড়া করে নিয়েছে, সকাল হওয়া অবধি সবাই এই একটা ঘরেই থাকবে। ঘরেই ওয়াশরুম আছে, খাওয়ার জল আছে। খুব দরকার পড়লেও, একা কেউ বাইরে যাবে না। ভয়ের থেকেও বেশি একটা অজ্ঞাত অনিশ্চয়তা চেপে ধরেছে। অচেনা জায়গা, অনেকের মনেই অনেক রকম প্রশ্ন আর সন্দেহ কাজ করবে। তারপর আবার কালকে সকাল। ঠিক কী ঘটবে, কী ভাবে ফেরা হবে। কী জানা যাবে এত কিছুর পর! কী যে হয়ে গেল হঠাৎ রাগিনীর!...
ওরা চারজনেই যে যার মত করে একটা সম্ভাব্য পরিণতির কথা ভেবে নেওয়ার চেষ্টা করছে। একটা ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার ছক প্রস্তুত করতে চাইছে,কোন পরিস্থিতিতে কী করবে। রাগিনী আর প্রত্যূষের মধ্যে ব্যাপারটা অনেকেই জানে। ওদের ব্যক্তিগত ব্যাপার, একটা হালকা কানাকানি হলেও কেউ এই নিয়ে বেশি বাড়াবাড়ি করে না। পার্সোনাল স্পেসকে সম্মান করে। ওরা দুজন যে এই রেসর্টে এসে সন্ধ্যের পর থেকে আলাদা আলাদা চলে যাচ্ছিল, এটাও নজরে এসেছে কারো কারো। কিন্তু তারপর?
কী এমন ঘটে গেল ওই ঘরে? কী করল প্রত্যূষ মেয়েটার সঙ্গে? ওদের মধ্যে তো কবে থেকেই ফিজিকাল রিলেশন আছে বলে গসিপ চলছে... আলাদা করে রেপ কেন করতে যাবে হঠাৎ? হয়ত নেশার ঘোরে ফোর্স করতে গিয়ে এমন অ্যাক্সিডেন্ট হয়ে গেল! রাগিনীই চাইছিল না, নাকি অন্য কোনো কারণে?
প্রত্যেকের মাথার ভেতরেই ঘুরে ফিরে একটা প্রশ্নের শৃঙ্খল তৈরি হচ্ছে আলাদা আলাদা ভাবে। যার কাছে যে বিষয়টা গুরুত্বপূর্ণ, তা-ই আগে মাথায় আসে। সবাই সত্যিটা খুঁজতে চায় না, অনেকেই চায় বিশ্বাসযোগ্য একটা ঘটনাকে রূপ দিতে। অনেকক্ষেত্রে তাতে কাউকে দ্রুত অভিযুক্ত করতেও সুবিধে হয়।
ওরা জানে, ওদেরই মত... কিছু ছেলেও একটা ঘরেই রয়েছে এখন। সকলেরই দায়িত্ব পালা করে প্রত্যূষের ওপর নজর রেখে যাওয়া। যতক্ষণ না অপ্রতিমদারা ফিরছে, প্রত্যূষ কার্যত ওই ঘরে নজরবন্দী!
'মনে পড়লেই কেমন অস্বস্তি হচ্ছে। কীভাবে পড়েছিল মেয়েটা অসাড় হয়। এখন কেমন আছে কে জানে!' কথাগুলো বলেই উঠে বসল ব্রততী। ওর কথাগুলো বুঝতে অসুবিধে হল না প্রাজক্তার। শুয়ে শুয়ে একই ভাবে ছাদের দিকে তাকিয়ে উত্তর দিল, 'টায়রা টেক্সটেড মি। আগের থেকে ঠিক আছে। শি ইজ রেসপন্ডিং'।
- ওকে নিয়ে এখানে ফিরে আসবে?
- দ্যাট আই ডোন্ট নো।
এইরকম পরিস্থিতিতে আসলে খুব স্পষ্ট মনে আসা প্রশ্নটাও সহজে করা যায় না। প্রতি দুজন অতিথির জন্য একটি করে রুম বরাদ্য ছিল। ওরা ইচ্ছে করেই একসাথে বসেছিল আড্ডা দিতে, রাত বাড়লে যে যার ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়ত। কিন্তু এখন সাড়া রাতই এভাবে কাটাতে হবে। হালকা হাসি, অফিস নিয়ে নিন্দে, কিছু চটুল ইয়ার্কি, মেয়েলি গসিপ... এই সব কিছুর বদলে দীর্ঘ নীরবতা আর ঘুরেফিরে আবার রাগিনীর প্রসঙ্গ উঠে আসা-- অস্বস্তি হচ্ছিল প্রাজক্তার। তাই জানে না বলে একটা সম্ভাবনাময় বার্তালাপের চেষ্টা খারিজ করে দিল। ও তখনো মনে মনে চেষ্টা করছিল ঘটনাগুলি সাজানোর, রাগিনীকে ওভাবে আবিষ্কার করার আগে শেষ এক ঘন্টায় ঠিক কী কী ঘটেছিল... কাকে কেমন দেখেছিল। ডিনারে প্রত্যূষ ছাড়া আর কাকে দেখে মনে হচ্ছিল-- ঠিক স্বাভাবিক নয়। কারো কাছে কথা প্রসঙ্গে অদ্ভুত বা অন্যরকম কিছু শুনেছিল কি না। সেই চিন্তাটা কেটে গেল ব্রততীর এই আরও একবার একই কথা জিজ্ঞেস করে দীর্ঘশ্বাস ফেলার কারণে।
আবার সেই নীরবতা ফিরে এলো ঘরে। চাদরটা আরো ভালো করে টেনে নিয়ে খাটের একপাশ থেকে স্মিতা বলল, 'ইটস অলমোস্ট থ্রি, বেটার উই টেক আ ন্যাপ নাও। নেহি তো ইট উড গেট ওর্স ইন দ্য মর্নিং। আই অ্যাম অলরেডি গেটিং আ ব্যাড হেডএক গার্লস।' স্মিতার কথাগুলো শুনে ব্রততী ওর দিকে তাকাল। একপ্রকার সম্মতি জানানোর জন্যই শব্দ করে হাই তুলল। কিন্তু শুলো না, আধশোয়া হয়েই হ্যালান দিল একটা কোল বালিশে। খাটের গায়ে আর্শিগুলো অদ্ভুত। বোঝা যায় কেউ আছে, কিন্তু তার মুখ স্পষ্ট বোঝা যায় না।
'প্রত্যূষকে সাথ অভি কৌন হ্যায়?', প্রাজক্তার প্রশ্নটা শুনেই চমকে উঠল অন্যরা। অন্তরা এতক্ষণ চুপ করে শুয়েছিল। প্রত্যূষকে নিয়ে ঘটে যাওয়া পুরো ব্যাপারটাই এক প্রকার ট্রমার মত লাগছে ওর। প্রত্যূষ-ভিভান, এই ছেলেগুলোকে ওর ভালো লাগে না। একটু বেশিই উচ্ছৃঙ্খল মনে হয়। কিছুই বুঝতে অসুবিধে হচ্ছে না, কী হয়েছে ওই ঘরে। এদের সার্চ করলে যে কী না কী পাওয়া যাবে তার ঠিক নেই! কিন্তু কাউকে বলতে পারছে না। কিচ্ছু বলতে চায়ও না। চুপচাপ বেরিয়ে যেতে চায়, নতুন করে কোনো ঝামেলায় না জড়িয়ে। প্রাজক্তার প্রশ্নটা শুনেই মনে হল, প্রত্যূষ এক বিপজ্জনক প্রাণী... যাকে পাহারা দেওয়ার মত কেউ আছে কি না, সেই ব্যাপারে প্রাজক্তা সংশয় প্রকাশ করছে। প্রশ্নটা শুনে অনেকটা নিজেকে আস্বস্ত করার জন্যই কাঁপা কাঁপা গলায় বলার চেষ্টা করল-- 'মতলব?... হ্যায় না, দোজ পিপল আর উইথ হিম... অভীক, মৈনাক, ভিভান...'
ওর কথাটা শুনে একটা অদ্ভুত শব্দ করে হাসল প্রাজক্তা। আর কিছু বলল না। হাসির মধ্যে স্পষ্ট তাচ্ছিল্যটা বুঝতে পারল অন্যরা। কিন্তু কেউ কিছু জিজ্ঞেস করল না। হয়ত ইচ্ছে করেই, অথবা সেই প্রাসঙ্গিক ক্লান্তি। অন্তরা জোর করে স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করে বলল, 'জানলাটা খুলে দিলে কি খুব মশা আসবে?... কেমন দমবন্ধ লাগছে ভেতরে। এসিটা মনে হয় না কাজ করছে না।' ওর এই কথারও উত্তর দিল না কেউ। ব্রততীর দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল, সমর্থনের আশায়। ব্রততী হাত আর চোখের ইশারায় বুঝিয়ে দিল-- যা পারিস কর।
একটা অস্বাভাবিক নীরবতার মাঝেই, আসতে আসতে গিয়ে জানলার একটা পাল্লা খুলে নীচের দিকে তাকাল অন্তরা। মনে হল... দুটো ছায়া সরে গেল গাছের আড়ালে। হতে পারে এদের এখানকার লোক। অথবা চোখের ভুল। শুধু ছায়াই সরে গেল, কারা ঠিক বুজতে পারল না। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে বাইরের খোলা হাওয়ায় শ্বাস নিয়ে ফিরে এলো ঘরের ভেতর। 'মশা ঢুকলে বন্ধ করে দেব। অ্যাঁ?' ব্রততীর দিকে তাকিয়ে কথাগুলো বলে কাচের গ্লাসটা হাতে নিয়ে খাওয়া জল ঢালতে শুরু করল অন্তরা।
হঠাৎই প্রাজক্তা একটা তীব্র তাচ্ছিল্য নিয়ে বেশ জোরে বলে উঠল, 'কাহে কা অভীক, ভিভান... দে হ্যাভ লেফট লং ব্যাক।'
কথাটা শুনেই অন্তরার হাত থেকে কাচের গ্লাসটা মাটিতে পড়ে ভেঙে গেল।
-------------------------------------
প্রত্যূষের দিকে তাকিয়ে চুপ করে বসে আছে কবীর। ওকে দেখে মনে হচ্ছিল ও যেন এই মুহূর্তে লাস্ট গার্ড। সবাই চলে গেছে এক এক করে, এখন শেষ ওর ওপরই গুরু দায়িত্ব-- প্রত্যূষকে পাহারা দিয়ে যাওয়ার। পুরনো দিনের সেগুন কাঠের পাল্লা, দরজায় আলগা চাপ পড়তেই শব্দ হল। মৈনাককে ঘরে ঢুকতে দেখে ওর দিকে তাকাল কবীর। উত্তরপ্রদেশে বিজনৌরের ছেলে কবীর আহমেদ। ছোটোবেলা থেকে দিল্লিতে বড়ো হচ্ছে। কম কথা বলে,নেশা ছোঁয়ে না। সবার মাঝে থেকেও, অন্যদের থেকে একটা সচেতন দূরত্ব বজায় রাখে। ও যে রেসর্টে এসেছে, এটাই আশ্চর্য ব্যাপার। মৈনাকের সঙ্গে খুব একটা কথাও হয়নি আজ অবধি... ওই টিমে আছে বলেই কাজের সূত্রে যতটুকু কথা। সবাই চলে গিয়ে শুধু এই কবীর আর নেশাগ্রস্ত প্রত্যূষের সামনে পড়ে একটু অস্বস্তিই হচ্ছিল মৈনাকের। সতীশ আর নীলেশেরও থাকার কথা ঘরে। ওরা কোথায়?
'ডোর খুলা কিঁউ হ্যায়?', মৈনাক আর কী বলবে ভেবে না পেয়েই সরাসরি এই প্রশ্নটাই করে বসল। পরের প্রশ্নটা হওয়ার কথা, বাকিরা কোথায়। কবীর শান্ত ভাবে হেসে বলল, 'কলিগ হ্যায় ব্রো, নট আ কনভিক্ট। নট ইয়েট।' এই কথার কী উত্তর দেবে বুজতে পারল না মৈনাক। এখন কবীরের সঙ্গে এই নিয়ে কোনো পয়েন্ট প্রুভ করার সময় নয়। তার ওপর বাকি দুটো ছেলেও নেই ঘরে। প্রত্যূষের দিকে তাকিয়ে দেখল, ও দুটো পায়ের ফাঁকে মাথা রেখে বসে থাকতে থাকতেই ঘুমিয়ে পড়েছে। ভাবল বলে, 'কনভিক্ট নেহি হ্যায় তো হেল্প কিঁউ নেহি কিয়া? হোয়াই ডিড ইয়ু নট হেল্প হিম টু বেড?' কিন্তু সেসব না বলে নিজেই প্রত্যূষের দিকে এগিয়ে গিয়ে ওকে তুলে বিছানায় নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করল। দেখে মনে হচ্ছে নেশার ঘোরেই ঘুমিয়ে পড়েছে। ওকে এভাবে চেষ্টা করতে দেখে কবীরও উঠে এগিয়ে এলো। দুজনে মিলেই আসতে আসতে শুইয়ে দিল প্রত্যূষকে বিছানায়। গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন, বেহুঁশ।
'ডিস্টার্ব নেহি কিয়া। নশে মেঁ আউট অফ কনট্রোল কুছ কর দিয়া তো...' কিছুটা আত্মপক্ষ সমর্থনের মতই কথাগুলো বলল কবীর।
- ভায়োলেন্ট হো গয়া থা কেয়া? আই স হিম ক্রাইং আ লট।
- হি ওয়াজ... আই মিন, হি ওয়াজ ক্রাইং। রাগিনীকে পাস জানে কা জিদ কর রহা থা।
- ইস লিয়ে বোলা, কিপ দ্য ডোর লকড।
- ইট ওয়াস। নীলেশ অ্যান্ড সতীশ ওয়েন্ট আউট... ব্যস কুচ হি দের পহলে।
- লেট মি কল দেম। কহাঁ চলে গয়ে দোনো?
কবীর চুপ করে বসে রইল। একটা কম্বল টেনে ঢেকে দিল প্রত্যূষকে। ঘরে এই ঠান্ডাতেও এসি চলছে। জানলা-দরজা সব বন্ধ ছিল বলে। নীলেশের ফোনে কানেক্ট করার চেষ্টা করতে করতেই প্রত্যূষের ঘুমন্ত মুখটার দিকে তাকিয়ে ছিল মৈনাক। একরকম নিশ্চিন্ত হয়েই ঘুমোচ্ছে। তবে নিষ্পাপ আর মনে হচ্ছে না মুখটা। স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে-- মেয়েটাকে কোনোভাবে অ্যাবিউজ করতে চেয়েছিল প্রত্যূষ। সময় বা সুযোগের অভাবে পারেনি। অথবা কিছু বিপদ ঘটে ব্যাপারটা হাতের বাইরে চলে গেছে এভাবে। ফেঁসে গেছে। অথচ রাগিনী এতটাই গুরুত্ব দেয় ওকে, এতটাই ক্লোজ... ইচ্ছে থাকলেও সাহস করে বলতে পারেনি যে ছেলেটা একটা লুম্পেন অ্যাডিক্ট। বড়োলোকের স্পয়েল্ট ব্র্যাট!
কবীর এখনো প্রত্যূষের দিকেই তাকিয়ে বসে আছে, ঘুমন্ত প্রত্যূষকে পাহারা দিচ্ছে। ওদিকে তিন চার বার রিং হয়ে গেল... নীলেশ বা সতীশ-- কেউই ফোন তুলছে না। নীলেশ মারাঠি আর সতীশ তামিল, দুজনেই বাংলা বোঝে না। গেলটা কোথায় এত রাতে! ভেবেই বিরক্ত লাগল মৈনাকের। একবার বাইরে গিয়ে দেখা দরকার, অথচ কবীরের একার ভরসায় প্রত্যূষকে এভাবে রেখে যেতেও ইচ্ছে করছে না। হঠাৎ উঠে কবীরকে ইঞ্জিওর করে পালানোর চেষ্টা করলে?
কথাটা মনে হতে নিজেকেই অবাক লাগল... নেশার ঘোরে ঘুমোচ্ছে, কোথায় পালাবে? বাইরে গেটেও সিকিওরিটি। একবার মনে হল, একটা উদ্বেগ থেকেই ওভার-থিংক করে ফেলছে পুরো বিষয়টা নিয়ে। আবার মনে হচ্ছে-- ফেঁসে গেছে বুঝতে পারলে মানুষ সব পারে। সে যতই নিজেকে বাঁচাতে রাগিনী রাগিনী করে নাকে কাঁদুক। মৈনাকের একটা স্পষ্ট ধারণাই হয়ে গেল, সকালে পুলিশ আসবেই। আর একা প্রত্যূষ না, অনেককে নিয়েই টানাটানি হবে তখন। কথাটাই মনে হতেই প্রত্যূষের ওপরে রাগ আর বিরক্তিটা একসাথে ফিরে এলো। দাঁতে দাঁত চেপে অস্পষ্ট ভাবে বলল মৈনাক-- স্পয়েল্ট ব্র্যাট!
কথাটা বোধহয় কবীর শুনতে পেল, একবার ওর দিকে তাকিয়ে আবার মুখ ফিরিয়ে নিয়ে বলল-- "সতীশ কা ফোন সুইচড অফ হ্যায়। অওর নীলেশকা নট রিচেবল।"
(চলবে)
© জয়দীপ চট্টোপাধ্যায়
Comments
Post a Comment