ভালো থেকো নিশীথ অবশেষ: ৯ম পর্ব — জয়দীপ চট্টোপাধ্যায়
ভালো থেকো নিশীথ অবশেষ — ৯ম পর্ব
‘যা,ফ্রেশ হো কর আ… লেডিজ ওয়াশ রুম ইজ দ্যাট ওয়ে…নট ব্যাড, ম্যানেজেবল।’ কথাগুলো অনশুকে বলতে বলতেই রাগিনীর পায়ের কাছে বেডের ওপর বসল টায়রা, হাতের ইশারায় দেখিয়ে দিল 'দ্যাট ওয়ে'টা কোন দিকে। অনশু এক মনে ফোনে কিছু টেক্সট করছিল, 'দ্যাট ওয়ে'-টা ও খেয়ালই করল না। টায়রার গলার আওয়াজ পেয়ে মাথা তুলে বলল ‘হুম?’ বেচারাকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে, খুব চাপে আছে। টায়রা কিছুটা নিজের দায়িত্বেই মিথ্যে বলল ওকে, ‘অপ্রতিমদা সে বাত হুয়া, মৈনাক অ্যান্ড ভিভান আর অন দি ওয়ে… সামওয়ান উড টেক আস ব্যাক টু দ্য রিসর্ট।’
- অওর রাগিনী?
- বো ভি চলেগি না… গার্লস্ সব চলে যায়েঙ্গে!
- হোয়াই ওনলি গার্লস্?
- আই মিন, হম লোগ পহলে যায়েঙ্গে, দেন আদার্স উড ফলো।
- তু কুছ ছুপা রহি হ্যায় না মুঝসে? হোয়্যার আর আদার্স? হোয়াই আর এভরিওয়ান সো কোয়েট? হোয়াই আর উই স্টিল হিয়ার?
-শ্শ্... কাম ডাউন। রিল্যাক্স। অ্যায়সে প্যানিক করেগি তো ইট উড ডেফিনিটলি অ্যাফেক্ট ইয়োর হেলথ।
- আই অ্যা নট প্যানিকিং... শিওর উই আর ইন সাম মেস... অওর বো তুঝে ভি পতা হ্যায়। ইউ আর জাস্ট ট্রাইনিং টু পেসিফাই মি নাও।
-
- দেখ ইস কো... জাস্ট লুক অ্যাট হার! নর্মাল লগ রাহা হ্যায় কুছ ভি? ইসকি ঘরওয়ালে আয়েঙ্গে... অ্যান্ড এভিরিথিং উড বি কোয়েশচন্ড... বাওয়াল মচ চুকা হ্যায়... দ্য বল হ্যাজ স্টার্টেড রোলিং!
- তো হম আভি তো কুছ কর ভি নেহি সকতে না? কর সকতে হ্যায় কুছ? কুড উই গো ব্যাক ইন দ্য পাস্ট অ্যান্ড স্টপ দিস ফ্রম হ্যাপেনিং?
-
- ডিড ইয়ু সি এনিথিং? তুঝে ডর লগ রাহা হ্যায়?
-
- নথিং ক্যান বি আনডান নাও... সো?
- আই ডোন্ট নো! আই অ্যাম জাস্ট নট ফিলিং রাইট অ্যাবাউট দ্য হোল থিং... অ্যান আই ওয়ান্ট টু গেট আউট অফ ইট নাও!
- সো গেট আউট অফ দিস না?!... বতায়া তো তুঝকো... দে আর অন দেয়ার ওয়ে? থোড়া তো পেশেন্স দিখা লে ইয়ার! কেয়া হো কেয়া গয়া হ্যায় তুঝকো?
-
- যা,ফ্রেশ হো কর আ… চল। অ্যান্ড ট্রাস্ট মি... ইট ইজ নট দ্যাট ব্যাড। কুছ নেহি হোগা। তু যা… আই অ্যাম হিয়ার উইথ হার, ডোন্ট ওরি।
অনশু কোনো আর কথা বলল না। ঠোঁটা কামড়ে একবা নিদ্রাচ্ছন্ন রাগিনীর দিকে তাকিয়ে কিছু ভাবল, তারপর মোবাইল ফোনটা হাতে নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। দৃশ্যত উদ্বিগ্ন, দুশ্চিন্তাগ্রস্ত। হয়ত ঘর থেকে দূরে গিয়ে কাউকে ফোন করে জানাবে বর্তমান পরিস্থিতি। অফিস আউটিং-এ এসে এভাবে ফেঁসে গেলে অনেকেই অস্বস্তিতে পড়বে, প্যানিক করবে। সকলের পরিবারের অবস্থা এবং মানসিকতাও এক রকম না। তার ওপর অনশুর মত কত ছেলেমেয়েই আছে, যারা কেউ এই রাজ্যের মানুষ না। অনশু একাই থাকে শহরের একটা ফ্ল্যাটে... অন্য রাজ্য থেকে চাকরি করতে আসা ওর মত আরো অনেক ছেলেমেয়েরা যেভাবে চাকরির জন্য অচেনা শহরে অন্য ভাষায় কথাবলা, অন্যরকম খাবার খাওয়া মানুষদের মাঝে মানিয়ে নিতে নিতে এক একটা দিন কাটিয়ে দেয়-- সেভাবেই। বাড়ির লোকের সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ, বয়ফ্রেন্ড বা গার্লফ্রেন্ড যদি দূরে থাকে... সেই যোগাযোগটাও দূরেরই। কেউ কেউ পরিচিত কাউকে পেয়ে যায় শহরে, বা হয়ত ভালোবাসার চাড়াটাই বেড়ে ওঠে এই অপরিচিত শহরে। হঠাৎ করে, কেবল একটা মানুষের জন্যেই তখন অনেক কিছু ভালো-না-লাগা ফিকে হয়ে যায়। ছুটি পেলেও যেতে ইচ্ছে করে না। অনশু কীভাবে এক একটা দিন কাটায়, কতটা সুবিধে-অসুবিধের মধ্যে আছে একা এই অচেনা শহরের ভিড়ে-- তা নিয়ে কারো কি জাজমেন্টাল হওয়া সাজে? নিজে থেকেই হাসপাতালে রাগিনীর সঙ্গে আসতে চেয়েছিল মেয়েটা। কিন্তু এখন আর নিতে পারছে না, মনে মনে আতঙ্কিত হচ্ছে। যে মেয়ে এতজনের মাঝে একা... তার উদ্বেগ আর বাড়িতে কৈফেয়ৎ দেওয়ার দায়ও একটু বেশি। রক্ষণশীল পরিবারে, অন্যদের মর্জির বিরুদ্ধে একা অন্য শহরে চাকরি করতে আসা মেয়ে। পরিবারে যারা বয়সে ছোটো, তারাও হঠাৎ অভিভাবক হয়ে ওঠে মুখে কথা ফুটলে। এমন কি বিয়ের কথা পাকা জানার পর বয়ফ্রেন্ডও বাবা-জ্যেঠাদের মত শাসন করার অধিকার পেয়ে যায়। হাত ধরা থেকে হাত মুচড়ে দেওয়ার অধিকারে পৌঁছনো এক প্রকার সামাজিক পদোন্নতি। চাকরি থেকে যদি কোনো বিপদ আসে, আর সেই খবর যদি আত্মীয়রা অথবা প্রতিবেশীরা জানে-- তাহলে অনশুর কী হতে পারে, এটা অনেক সহকর্মীরাই বুঝতে পারবে না। শুধু ঠাট্টা করতে পারবে মাঝে মাঝে-- ইতনি সি বাৎ পর কাঁপ রহি হ্যায় খরগোশ কি তরহা!
অথচ খরগোশ হয়ে জন্মানো অন্যায় নয়। ভালো থাকার ইচ্ছে তাদেরও-- যারা দ্রুত শিকার হয়ে যায়। লড়াই করতেও করতেও শিকার হয়ে যায় একদিন। খাদ্য-খাদক তালিকায় তারা খাদ্যই... সে যত ভালো জীবন কাটানোরই যোগ্যতা অর্জুন করুক নিজের চেষ্টায়। দ্রষ্টারা জাজমেন্টাল হয়ে ওঠে, 'যে লড়াই করে এত দূর এসেছে, কেনই বা সে মেনে নেবে? একটা স্ট্যান্ড নেওয়ার মত ম্নের জোর নেই?' কিন্তু অনশুর মত ফসকে-পালিয়েও ভালো থাকার লড়াইটা যারা চালিয়ে যাচ্ছে, তাদের নিয়ে কারো কি জাজমেন্টাল হওয়া সাজে?
অনশু চলে যাওয়ার পর টায়রা একবার রাগিনীর দিকে তাকাল। দেখে মনে হচ্ছে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন... কিন্তু এই ঘুম একেবারেই স্বাভাবিক না, সেটা ও জানে। ওষুধ না অন্য কিছুর প্রভাব বুঝতে পারল না। ‘মেয়েটার সঙ্গে ওই ঘরে কী যে হল… কেনই বা মেয়েটা আনকনশাস হয়ে পড়েছিল… কেনই বা সেন্স আসার পরেও আবার…’-- খুব অস্বাভাবিক লাগছিল টায়রার। কাকে জিজ্ঞেস করলে কতটা জানা যাবে বুঝতে পারছিল না। আর কে যে কতটা সত্যি বলবে, কতটা চেপে যাবে– এটাই এখন সন্দেহ হচ্ছে খুব। অনশুকে কিছু জিজ্ঞেস করা মানে এখন ওকে আরো প্যানিকড করে তোলা। অথচ মেয়েটা কাছাকাছি ছিল, অবশ্যই কিছু একটা দেখেছে বা শুনেছে... যা অন্যরা জানে না। এমনিতেও রাগিনী আর প্রত্যুষের মধ্যে কিছু একটা চলছে-- সবাই জানে। মেয়েটা একটু বেশিই 'আউটগোইং'। কিন্তু যা ঘটে গেল... কেউই প্রত্যাশা করেনি। ‘কৃষাণুদার ওদিকে ওই অবস্থা, এর মধ্যে অনশুর যদি একটা নার্ভাস ব্রেকডাউনের মত কিছু হয়ে যায়– সব দিক থেকে ব্যাপারটা আরো বাজে দিকে যাবে।’... ‘আশ্চর্য ব্যাপার! এমার্জেন্সিতে কেবল একটাই মহিলা নার্সকে দেখা যাচ্ছে। সেও পেশেন্টের কাছে থাকে না। কোথায় আছে কে জানে! অনশুকেও জিজ্ঞেস করা হল না নার্সটা একবারও এর মধ্যে এসেছে কি না। রাগিনীর কিছু চেক করতে হবে কি না আবার।’... সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতে হঠাৎই টায়রার মনে হল, রাগিনীকেই একবার আসতে আসতে জাগানোর চেষ্টা করে… দেখে, এখন স্বাভাবিক হয়েছে কি না... অন্ততঃ গলার আওয়াজ বা স্পর্শে রেসপন্ড করছে কি ন। তারপর নিজেকেই একটা ধমক দিল মনে মনে টায়রা ‘তোর কি মাথা খারাপ? ও যদি এখন জেগে উঠে আনএস্কপেক্টেড কিছু বলে বা করে… সামলাতে পারবি?’ কাল সকালে ঠিক সময়ে বাড়ি না ফিরলে টায়রাকেও সব কিছু জানাতে হবে… এই ব্যাপার যদি খারাপ দিকে যায়-- সেটাও। অন্য কোনো সূত্রে থেকে মা-বাবা কানে পৌঁছনোর আগে টায়রাকেই জানাতে হবে। রোহিতও জানবে। ‘এভরিথিং উড বি মেসড আপ!’। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিজের ফোনটা আনলক করল টায়রা, চেষ্টা করল ভিভানের নম্বরে ফোন করতে… রিং হয়ে যাচ্ছে। এই ঠান্ডার মধ্যেও কেমন গরম লাগতে শুরু করেছে এখানে... একটা অস্বস্তি হচ্ছে ভেতরে। ঘরের ভেতরটা গুমট মনে হচ্ছে। রাগিনী ঘুমোচ্ছে দেখেই… আসতে আসতে ঘরের জানলার দিকে সরে এলো টায়রা… আবার একবার ফোন করার চেষ্টা করল ভিভানকে। ওপার থেকে পুরুষ কণ্ঠ ভেসে এলো, ভিভান না… অভীকের গলা।
‘উনি তো ঘুমিয়ে পড়লেন… সাউন্ড স্লিপ। আপনি খাবেন?’
ডঃ দত্তর প্রশ্নটা শুনে মুখের দিকে তাকাল অপ্রতিম। অল্পবয়সে অনেক নাইট-শিফট করেছে। চব্বিশ ঘন্টা জেগে ক্রিটিকাল সাপোর্ট দিয়েছে ক্লায়েন্টকে… কিন্তু এখন আর সে সব করার অভ্যেস নেই, বয়সও চলে গেছে। অথচ এখন ওকেই জেগে থাকতে হবে, একটা কিছু মীমাংসা না হওয়া অবধি। তাই এক কাপ কেন… মাঝে মাঝেই যদি একটা চা-সিগারেটের ব্যবস্থা হয়… ভালো হয়। তাও খুব একটা উৎসাহ প্রকাশ না করে বলল ‘আমাদের সঙ্গে যে ড্রাইভার... ওঁকে বরং...’
- উনি গাড়ির কাচ তুলে ভেতরে ঢুকে পড়েছেন… ঘুমোচ্ছেন দেখে এলাম। সিকিওরিটি গার্ড নজর রাখছে।’
- ঘুমোচ্ছেন?
- কেন? গাড়ি নিয়ে পালাতে পারে?
- কে জানে!
- ও প্রব্যাবলি ম্যানেজারকে ফোন করে জানিয়ে দিয়েছে… আর তার ইনস্ট্রাকশন মতই…
- কই, আমাকে তো রিসর্ট থেকে কেউ ফোন করেনি।
- সে ওরা কী ভেবে রেখেছে! হয়ত ওরাও এক্সপেক্ট করছে আপনারা ফোন করে জানাবেন।
- তাহলে কী ডিসিশন নিলেন?
- ডিসিশন?... ডিসিশন তো নেবেন আপনারা।
-
- একটা সাজেশন দিই বরং... একা কোনো সিদ্ধান্ত নিতে যাবেন না। মেয়েটির বাড়িতে জানান কাল সকালে। তারাই এসে...
- ওকে কি স্টেবল লাগছে? কাল সকাল অবধি...
- কাল সকাল অবধি এখানে রাখাটাই রিস্ক হবে ভাবছেন?
-
- আপনার চিন্তা ভ্যালিড। এমন নার্সিংহোমে আমিও বাড়ির কাউকে আনব না! কিন্তু শিফট করতে গেলে আমার সাজেশন অন্য...
- লোকাল থানা আসবে, তারপর...
- বা থানাকে জানিয়ে তাদের কাউকে সঙ্গে নিয়ে...
-
- এই কারণেই বলছি। ডোন্ট টেক ইট অন ইয়োর শোল্ডার। আরো কিছু জনকে টানুন অন্ততঃ...
-
- আসুন, আমার রুমে বসে চা খেতে খেতে ভাববেন... চলুন। চিন্তা করবেন না… এনার জন্য আমি মেল হাউজ স্টাফ পাঠিয়ে দিচ্ছি। এখানে বসে কথা বললে এমনিতেও ওঁর অসুবিধে হচ্ছে… তার চেয়ে চলুন, বাইরে যাই একটু…
অপ্রতিমের ইচ্ছে করছিল না কৃষাণুকে ঘরে একা রেখে যেতে, অনিচ্ছা সত্ত্বেও ডঃ দত্তর সঙ্গে ঘর থেকে বেরিয়ে এলো। রিসেপশনের ওখানে চেয়ারে বসে থাকা লম্বা লোকটা হাই তুলতে তুলতে এসে ঘরে ঢুকল, কৃষাণুর ওপর নজর রাখতে। চেয়ারে বসে পা দুটো সামনের টুলে তুলে দিল। অপ্রতিম বা ডঃ দত্ত কী ভাবছে, তা নিয়ে বিশেষ ভ্রূক্ষেপ আছে বলেও মনে হল না। এমন একটা স্ট্র্যাটেজিক ছেলের সঙ্গে রাতটা থাকতে হবে ভেবে অপ্রতিমের একটা অস্বস্তি হচ্ছিল। বয়স কম, অথচ কী ঠাণ্ডা মাথায় দৃঢ় ভাবে কথাগুলো বলছে... তাও মুখে একটা প্রফেশনাল হাসি নিয়ে। বিনয় নয়, ঔদ্ধত্য নয়, একটা মাপা পেশাদারী হাসি-- যেমন করপোরেট ট্রেনিং-এ বডি-ল্যাঙ্গুয়েজ নিয়ে জ্ঞান দিতে গিয়ে শেখায়। ওকে পুরোপুরি ইগনোর করে বেরিয়ে গেলে পুলিশে ফোন করবে, করবেই। আর নিজেরা পুলিশে ফোন করে আগে থেকে জানালে সিদ্ধান্তটার জন্য উত্তর দিতে হবে কোম্পানিকে। 'ডোন্ট টেক ইট অন ইয়োর শোল্ডার।'-- ডঃ সায়ক দত্তের কথাগুলো খুব একটা হেলাফেলা করার মত নয়। এটাও একটা কর্পোরেট বেস্ট প্র্যাক্টিস-- ডিসিশন মেকিং আর রিস্ক টেকিং এর সময়ে কিছু ক্ষেত্রে এটা একটু ভেবে নিতেই হয়। সাফল্য সবার, ব্যর্থতা একার।
অপ্রতিমকে দরজার কাছে দাঁড়িয়ে পড়তে থেকে ডঃ দত্ত আবার একবার বলল, ‘চলে আসুন মিঃ মিত্র… কোনো প্রবলেম হবে না। ওকে ঘুমতে দিন।’
— — — —
- কে ফোন করেছিল?
- টায়রা।
- কী বলছে? রাগিনী স্টেবল এখন?
- স্টেবল-ফেবল সব… ওদিকটা চ, বলছি…
মৈনাককে নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে বারান্দার দিকে চলে গেল অভীক, অন্য সহকর্মীদের থেকে দূরে, সিগারেট খাওয়ার অছিলায়। ‘লাইটার আছে?’, সিগারেটটা ঠোঁটে নিয়ে সতর্কভাবে চারদিক দেখতে দেখতে অভীক জিজ্ঞেস করল। মৈনাক চটপট লাইটারটা বার করে আগুন জ্বালিয়ে ওর ঠোঁটের ফাঁকে ধরে - থাকা সিগারেটের দিকে এগিয়ে দিতে দিতে বলল ‘চাপের কিছু নাকি?’
- একদম আসতে কথা বল, আর কারো সঙ্গেই বেশি আলোচনায় যাস না…
- না না… পাগল!
- তুই এখানে থাক… আমি আর ভিভান যাচ্ছি। মেয়েদের নিয়ে আসতে হবে। বাইকে যাব, গাড়িতে ফিরে আসব।
- কোথায় যাবি?
- ওই নার্সিংহোমে, আবার কোথায়!
- তাহলে ভিভানকেও তো জানাতে হবে…
- ওর বাইক নিচ্ছি, ওকে তো জানাতেই হবে।
- দেন?
- দেন কী?
- এখানে কি এইটা বলতেই ডেকে আনলি?
- না না… ব্যাপার আছে।
‘ব্যাপার আছে’ বলে চুপ করে কিছুক্ষণ বারান্দার বাইরে তাকিয়ে রইল অভীক। অন্যরা যথেচ্ছ নেশা করলেও, ও এক বোতল বিয়ারের বেশি খায়নি। সেসব অনেক আগেই কমোডে ফ্লাশ করা হয়ে গেছে। এইখানে সন্ধ্যে থেকে অনেক কিছুই দেখেছে, শুনেছে… যা অন্যরা হয়ত অনেকেই খেয়ালই করেনি। সতর্কও থেকেছে, ‘অপ্রতিমদা লোকটাকে ঠিক বোঝা যায় না। কৃষদা একরকম, ম্যানেজ করা যায়…কিন্তু অপ্রতিমদা হাসতে হাসতে যে কী ভেবে নেবে, কী মনে রেখে দেবে!’। এমনিতেই প্রথম দিকের কয়েক বছর দক্ষিণের শহরে পোস্টিং ছিল অভীকের, ওখানে অন্য রকম লবি দেখেছে। নিজের রাজ্যের লোক নিজের রাজ্যের লোককে ব্যাক করে। এখানে সেই ব্যাপার নেই। বরং কেউ কেউ হঠাৎ জাজমেন্টাল হয়ে যায়, তুলনা করার ব্যাপার চলে, নিজেকে মাঝে মাঝেই মনে হয় পিছিয়ে পড়ছে… জাজড হচ্ছে। অন্যদের কথা জানে না… অনেকেই তো চায় নিজের শহরে পোস্টিং। কিন্তু অভীকের মনে হচ্ছে, এই জায়গা… এই প্রজেক্ট ওর জন্য নয়। কয়েক মাস কাটিয়ে বেরিয়ে যেতে হবে– ব্যাঙ্গালোর, অথবা পুনে। অপ্রতিমদা আর কৃষদা, দুজন সিনিয়র… দুজনেই চলে গেল। তখনই ব্যাপারটা স্ট্রেঞ্জ লাগছিল। এখানে প্রত্যুষকেও একদম ঠিক লাগছে না… মদ না… অন্য কিছু নেশা করেছে মালটা। তখন থেকে উলটোপালটা বকে যাচ্ছে। কথাগুলো উলটোপালটা লাগলেও-- শুনতে ভালো লাগছে না। ছেলেটা রিপেন্ট করছে না কনফেস করছে-- যা-ই করছে নেশার ঘরে, আর খুব এর্যাটিক ভাবে। কখনো কাঁদছে, কখনো গুম খেয়ে যাচ্ছে। রাগিনীও কেমন অদ্ভুত ভাবে পড়ে ছিল… আনকনশাস! কী যে হয়েছিল ওই ঘরে…
আর কেউ না জানলেও, অভীক ওদের দেখেছিল সন্ধ্যেবেলা একসাথে দোতলায় যেতে। তখন পাত্তা দেয়নি ব্যাপারটা। কে-ই বা জানত যে একটা অফিস আউটিং-এ এসে হুল্লোড় করতে করতে হঠাৎ এই রকম কিছু ফেস করতে হবে! একটু আগেও বাইরেটা কেমন আলো-মিউজিক-ডান্স… জমজমাট লাগছিল। এখন সব খাঁ খাঁ করছে। অন্য যে দলগুলো এসেছে… ওরাও বোধহয় কিছু জেনেছে কানাঘুষো, এই নিয়ে অতিরিক্ত কৌতূহল দেখাবে, খোঁজ খবর শুরু করবে কাল সকালে। স্বাভাবিক।
‘আরে ওই! ব্যাপারটা কী?!’... মৈনাকের গলার আওয়াজে চমকে উঠল অভীক। হাতের সিগারেটটা ট্যাপ করে ভীষণ রকম বিরক্তি প্রকাশ করে বলল ‘আসতে বলো না বাঁ!’, তারপর আবার খুব সতর্ক ভাবে চারদিকে তাকিয়ে দেখে নিল, কেউ ওদের দেখছে কি না, বা ওদের দিকে আসছে কি না। মৈনাকও ওর দেখাদেখি একবার চারিদিকে তাকিয়ে দেখে নিল, তারপর আবার গলাটা নামিয়ে বলল– ‘সরি… কিন্তু কেসটা কী? প্রেগন্যান্ট নাকি?’ কথাটার মধ্যে একটা চড়া কৌতুক ছিল, অভীক হাসিটা সামলাতে গিয়ে খুক খুক করে দু-বার কেসে সিগারেটের ধোঁয়াগুলো মুখের সামনে থেকে উড়িয়ে দিতে দিতে বলল ‘সে আমি কেমন করে জানব বাঁ!’
- দেন?
- কিছু জিনিসে খটকা লাগছে… বুঝলি?
- ওরে ফেলুদার জাঙিয়ারে! আবার খটকা লাগছে নাকি!
- শোন, কিছু একটা ঠিক নেই বুঝতে পারছি… হঠাৎ কী হল রাগিনীর? ওই ঘরে কী করছিল ও? ও একা ছিল, নাকি প্রত্যুষও…
- ওরা একসাথে থাকতেই পারে… কিছু একটা করছিল… মানে কী করছিল তুইও বুঝতে পারছিস, আমিও পারছি…
- দেন হোয়াট হ্যাপেনড সাডেনলি? রাগিনী সেন্সলেস হয়ে গেল কেন?
- সেই… আর প্রত্যুষটাও কী সব বলছে শুনলি?
- হুম… সেটাই তো রে…
- কিন্তু টায়রা কী বলল? তোরা ওখানে গিয়ে কী করবি?
- ওটাই তো চাপ রে… নার্সিং হোমের ডাক্তার বলছে পুলিশকে রিপোর্ট করবে, রাগিনীর বাড়ির লোক ডাকতে…
- ঘাড় ভেঙেছে!...
- আসতে… যেটা বলছি শোন। আমি আর ভিভান যাই, টায়রা আর অনশুকে নিয়ে আসি। অনশু নাকি একে-তাকে ম্যাসেজ করে বেড়াচ্ছে। প্যানিকে ফেটে গেছে ওর।
- এক্সপেক্টেড। অনেকেরই ফাটছে। আমিও চাপেই আছি।
- কৃষদা নাকি অসুস্থ হয়ে পড়েছে ওখানে ডাক্তারের সঙ্গে তর্ক করতে করতে…
- কৃষদাও ডাউন?!
- হুম!
- মানে অপ্রতিম মালটার এখন হেল্প চাই, নাইট-শিফটের রিসোর্স চাই… একা পড়ে গেছে। এইটা হল আসল কথা।
- না রে… ব্যাপারটা এতটা সহজ না। পুলিশ কেস হলে সত্যিই সবার নাম আসবে। আর আমার নিজের, অনেস্টলি ব্যাপারটা এমনিতেও নর্মাল লাগছে না। সো… - আই ডোন্ট নো।
- দেন… হোয়াটস নেক্সট?
- অপ্রতিমদাকে একটা কল করি… মনে হয় না আমাদের ওখানে থাকতে বলবে। ওই মেয়েদের নিয়ে আসার জন্যই…
- ঝামেলা হতে পারে বলছিস?
- আমাদের ঝামেলা করার জন্য ডেকে লাভ আছে? আমরা আউটসাইডার এখানে…
- স্টিল… এতগুলো ছেলে, চাইলে…
- আরো বাজে দিকে যাবে মাথা গরম করে কিছু করতে গেলে। ওসব চিন্তা ছাড়। তুই এখানে প্রত্যুষ আর অন্যদের দেখ। মেয়েগুলোকে বলিস একা কোথাও না যেতে। একটু একসাথে থাকতে। অ্যান্ড ইয়েস… ওই ঘরে যেন কেউই না যায়। যেমন বাইরে থেকে বন্ধ আছে, তেমনই থাকবে। কেউ যেন না যায়!
- আমার কথা কি কেউ শুনবে? সবাই গ্রোন আপ। তবে আমি চেষ্টা করব রে। আর ওই ঘরটায় এখন কেউ যেতে চাইবে বলে মনে হয় না। রিসর্টের লোকজনই তালা মেরে দিয়েছে বাইরে থেকে। ম্যানেজারটা লোকজনদের ওপর হেবি চেল্লাছিল, বুঝলি?
- চেল্লাছিল? কী বলছিল?
- অত মন দিয়ে শুনিনি… বাট ওই ঘর খোলা নিয়ে ঝাড় দিচ্ছিল মনে হল।
- আই সি…
- ঠিক আছে বস… আমি কশাস থাকব। বেশি কথায় যাব না কারো সাথে। আর কোনো প্রবলেম হলে জানাব তোকে। তুই তাহলে ভিভানকে গিয়ে বল…
- ও জানে…
- মানে?
- ওর ফোনেই ফোনটা করেছিল টায়রা।
- অ! তোকে করেনি?
- না।
‘না’ বলেই হাতের সিগারেটটা ছুঁড়ে বারান্দার বাইরে ফেলে দিয়ে চলে গেল অভীক। মৈনাক পেছন থেকে একবার জিজ্ঞেস করল, ‘তাহলে তোর সঙ্গে টায়রার ডিরেক্ট কথা হয়নি?’। ওর কথার কোনো উত্তর না দিয়েই এগিয়ে গেল মৈনাক, যেন শুনতেই পায়নি প্রশ্নটা। মৈনাক সামান্য হেসে মাথাটা নাড়ল, তারপর পকেট থেকে লাইটারটা বার করে আগুনটা জ্বালাল আর নেভাল কয়েকবার। গ্রামের দিকে ঠান্ডা একটু বেশি পড়ে। আর এই ঠান্ডায় যে যার ঘরে লেপ-কম্বলের মধ্যে ঢুকে না ঘুমিয়ে এইভাবে ল্যাঠা সামলাচ্ছে! ‘অভীকটা নিজেকে বেশি চালাক ভাবে, সেই তো যাচ্ছিস ল্যাজ হয়ে ইমপ্রেস করতে। হয় অপ্রতিমদা, নাহলে কৃষদা, না হলে টায়রাকে। একটা এনগেজড মেয়ে, ক মাস পরে বিয়ে হবে… তোকে বলেও নি আসতে! আর…’ হা হা হা করে একাই হেসে উঠল মৈনাক। সঙ্গে সঙ্গে কোনো একজনের দ্রুত চলে যাওয়ার পায়ের শব্দ শুনতে পেল। আবার সতর্ক হয়ে একবার চারদিকটা দেখে নিল মৈনাক, কিন্তু কাউকে দেখতে পেল না।
© জয়দীপ চট্টোপাধ্যায়
অঙ্কন : ঋতুপর্ণা খাটুয়া
Comments
Post a Comment