শুভদীপ রায়ের গুচ্ছ কবিতা

চিরায়ত 


প্রতি নিঃশ্বাসে বিক্ষত করে, চিরুনি তল্লাশি থামিয়ে,

যদি মেঝেভর্তি আঁকিবুঁকি স্পষ্ট করার চেষ্টা কর,

তবে জেনে রাখো এই মুহূর্তে আমি বিদ্রোহ জানালাম।


তোমার সব গন্ধ-বর্ণ-ছন্দ সবটুকু ভুলে যাওয়ার আগে

আমাদের শেষবার দেখা হওয়া জরুরি ছিল;

কিন্তু এই পার্থিব বীতরাগ আমি ঘৃণা করি

আর ঘৃণা করি তোমার চুলের আড়াল পেরিয়ে-

তোমার ঠোঁটের কাছে  পৌঁছানোর পথে সব বহুব্রীহি অনুজ্ঞা।


তবু এসব নিরর্থক দৈন্য আমি বয়ে চলি রোজ,

আর অবজ্ঞাপ্রতি একটি গোলাপচারা পুঁতে যাই পৃথিবীর বুকে,

যাতে, তারা গোনার অছিলায় তোমার সন্ততিদের আমার স্পর্শটুকু স্বীকার করতে হয় প্রতিক্ষণ।




শৃঙ্গার


চোখে চোখ, আঙুলে আঙুল-

শব্দময় পৃথিবীর দূরতম বাতিঘরে আলো নিভে এলে,

ভালোবাসা নেমে আসে সমুদ্রের বুকে।

যেটুকু আড়াল করে দিশাহীন স্বপ্নেরা মুড়ে ফেলে গোটা মহাকাশ,

তার পাশে দেশকাল থমকে দাঁড়ায়;

এলো চুলে এলোমেলো ভাবনারা লুকোবার ছলে

ইশারায় ডেকে নেয় পূর্বকল্প শেষে,

উপোসী বাঁশির শব্দে শ্রীমতীর মতো তারা ভুলে যায় শরীরী খেয়াল-

সবটা গুলিয়ে গেলে আরেকটু আড়ালে, মুছে যায় পিছুটান যত…

নৌকাবিহারে শুধু  নিষিদ্ধ চাঁদ আর চোখে চোখ, আঙুলে আঙুল।



গান্ধর্ব্য


জন্মলগ্ন থেকে যে অস্থিরতা গ্রাস করেছে আমায়,

তার সব জটিল গুহামুখ সন্তর্পণে এড়িয়ে আমি ঝর্ণার ধারে এসেছি।

এত তৃষ্ণা কীভাবে এতকাল ভুলিয়ে রেখেছিলাম- বুঝে ওঠার আগেই

ছায়াপথ ধরে উল্কা নেমে আসে।

চতুর্দিকে শ্মশান দেখি শুধু , খুলি ফাটার শব্দে শুনি গূঢ় মীমাংসা,

এই দ্রোহকাল শেষ হওয়ার আগেই

চেরা আলজিভগুলো জানিয়ে যায় আমাদের নিষিদ্ধ জন্মবৃত্তান্ত।


কত সহস্র পরিণতির কথা ভেবে রাখা ছিল, সেসব মনে করতে গিয়ে

হিসেবে ভুল করছি বারবার,

আর ততই গভীরে ঢুকে ফালাফালা করেছে তোমার বিজয়ী তলোয়ার,

আমি এই মৃত্যুকে স্বীকার করেছি বহুযুগ ধরে।

তোমার অস্তিত্বকে ভুলিয়ে দেয় এমন সমস্ত কিছুই  প্রতিবার রক্তক্ষরণে ফিরে ফিরে আসে।

সমান্তরালের অবরোধ ভুলে,

স্বপ্নসঞ্জাত অক্ষরবৃত্তে মনে করিয়ে যায়-


এই পৃথিবী আমার নয়, ছিল না কোনোদিনই,


কেবল কোন  রাজষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে আমরা আজ শাপভ্রষ্ট,

তবু প্রতিরাত্রে তোমায় দেখি মিছিলের মাঝখানে, 

আর দেখি সেই দুর স্বপ্নলোকে দিনরাত সেজে চলেছে আমাদের অনন্ত বাসর।


স্পর্শকাতর

 

তুমি ছুঁয়ে দিলে আমার সবকিছু কেমন এলোমেলো হয়ে যায়।

অতলান্ত থেকে ঢেউ ওঠে আর বেসামাল নাবিকেরা জাহাজ ছেড়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে-

অতলে তলিয়ে যায়।

বিদ্রোহ হওয়ার আগে একে একে সকলেই ঘরে ফিরে আসে,

অধিকার দাবি করে সবটা নিঃশেষে।

আমিও দুচোখ ঘেঁটে যেটুকু বুঝেছি-  শিলালিপি পোঁতা আছে অনেক গভীরে।

তুমি ছুঁয়ে দিলে আমার দেশে দেশে যুদ্ধ শুরু হয়

আর সেসব সামলাতে গিয়ে আমার গভীরে জাগে গান।

রাজকোষে জমানো সঞ্চয় উজার করার ফাঁকে ফুরিয়ে আসে পুণ্যস্নান।


তুমি ছুঁয়ে দিলে নিজেকে বন্দি করে আনি বেঁধে,

মাতাল হওয়ার লোভে সমস্ত নেশাটুকু বুনে দিই ঠোঁটের গভীরে,

মনে হয় আরও শব্দহীন হয়ে আসে সমস্ত কবিতা…


তুমি ছুঁয়ে দিলে কী যেন কী হয়…

© শুভদীপ রায়

অঙ্কন : ঋতুপর্ণা খাটুয়া




Comments

Popular posts from this blog

অনিন্দ্য সরকারের গুচ্ছ কবিতা : গান ছুঁয়ে ছুঁয়ে

অয়ন হালদারের পাঁচটি কবিতা

মুন্নী সেনের গুচ্ছ কবিতা : সম্বোধন