আইসক্রিম কথা : সোহম ভট্টাচার্য্য
আইসক্রিম শব্দটি শুনলে কার না জিভে জল আসে?সে শীত, গ্রীষ্ম , বর্ষা যাই হোক না কেন আইসক্রিমের অবদান কখনো কমবার নয়।ছেলে থেকে বুড়ো,সকলের এক বাক্যেই পছন্দ এই একটি নাম।বিভিন্ন ব্র্যান্ডের,বিভিন্ন স্বাদ,গন্ধ,ফ্লেভর এর আইসক্রিম বাজারে পাওয়া যায়।গরমের দিনে আইসক্রিম মুখে পুড়ে দিলেই যেন রাজ্যের শান্তি মনের মধ্যে ধরা দেয়।
তবে,মাঝে মাঝে প্রশ্ন জাগে কীভাবে এলো এই লোভনীয় বস্তুটি?কারই বা মাথায় এল এই লোভনীয় আইডিয়া?
(ইউ কে তে এক আইসক্রিম বিক্রেতা, ১৯৩৫,
ছবি: ইন্টারনেট)
তাহলে চলুন জানা যাক কি করে শুরু হল এই মন মাতানো খাবারের জন্ম পরিক্রমা।আইসক্রিম আবিষ্কারের ইতিহাস জানতে গেলে ফিরে যেতে হবে খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতাব্দীতে।আইসক্রিম আবিষ্কারকের বা আবিষ্কারের কোনও নির্দিষ্ট সন, তারিখ নেই। তবে এর উৎপত্তির প্রসঙ্গে নির্দিষ্ট কিছু মত আছে।
৬২ খ্রিঃ(আনুমানিক) রোমের সম্রাট নিরো তাঁর রাজবাবুর্চির কাছে নতুন মুখরোচক খাবার খেতে চাইলেন। বাবুর্চি তখন রাজার এক সৈন্যকে পাঠিয়ে অ্যাপেনাইন পর্বত-এর শৃঙ্গ থেকে কিছু বরফ নিয়ে এলেন এবং এই বরফ এর সঙ্গে আঙুর,চেরি,মধু মিশিয়ে রাজাকে খেতে দিলেন। আর সেই অপূর্ব ও নতুন স্বাদে বাবুর্চির ভাগ্য যে রাজানুগ্রহে খুলে গেলো তা বলাই বাহুল্য।
যদিও এই আইসক্রিমের ধারণা আরও প্রাচীনকালে খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চদশ শতাব্দীতে গ্রিসের তৎকালীন রাজধানী এথেন্সের বাজারে বরফকুচির সাথেমধু আর বাদামকুচি মেশানো এক বিশেষ রকম স্ট্রীটফুড পাওয়া যেত। এমনকি আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট ফুলের মধু ও বরফ দিয়ে দুধ খেতেও পছন্দ করতেন।
আবার, অপরদিকে বাইবেলে রয়েছে যে,সুলেমান শাসকরা ফসল কাটার মরসুমে বরফে বিভিন্ন দানাশস্য যেমন বার্লি,বাজরা,গম এর গুঁড়ো দুধ সহযোগে খেতে খুব পছন্দ করতেন।
রোম থেকে প্রথম সারা বিশ্বে বরফকুচির সাথে নানারকম মিষ্টি ফলের সিরাপ মিশিয়ে জমিয়ে খাওয়ার রীতি প্রচলিত হলেও, বাগদাদের খলিফারাই প্রথম দুধ ঘন করে তাতে নানারকম উপাদেয় শুকনো ফলের কুচি মিশিয়ে খাওয়া শুরু করেন।
ঐতিহাসিকদের মতে,এটিই ছিল আইসক্রিমের ঠাকুরদাদা।
চিনের তাং রাজবংশের শাসনকালে(আনুমানিক খ্রিঃ ৬১৮-৯০৬) বরফে ময়দা,নানারকম মুখরোচক সস,ডিম ও কর্পূর মিশিয়ে খাওয়ার রীতি প্রচলিত ছিল। তাং রাজাদের জন্য বরফ নিয়ে আসার কাজে নাকি ৭০০ জন বরফবাহক নিযুক্ত ছিল।
সুপরিচিত পর্যটক ও বনিক মার্কো পোলোর নাম আমরা কমবেশি সবাই শুনেছি। তিনি এই সময় চিনে এসে এই অপূর্ব রেসিপি খেয়ে সেই রন্ধনপ্রণালী নিয়ে গিয়েছিলেন নিজ দেশ ইতালিতে। এরপর নেপলসের ভইসরয় আন্তনিও লাতিনি সর্বোত্তর একটি রেসিপি লিখে রেখে গিয়েছিলেন যা স্বাদে মিষ্টি এবং বরফের মতই ঠাণ্ডা ছিল।
ফ্রান্স –এর শাসক মহারাজা অরিন-কে , নেপলসের রাজকন্যা ক্যাথরিন বিয়ে করেছিলেন। তাঁর হাত ধরেই চমৎকার এই রেসিপি এল নেপলস থেকে ফ্রান্সে, তাও আবার সরাসরি রাজদরবারে।
এমনকি ইংল্যান্ডেও আইসক্রিমের চাহিদা কিন্তু কম ছিল না। রাজা প্রথম চার্লস-এর প্রিয় খাবার ছিল টুটি-ফ্রূটি এর মতো আইসক্রিম।পরবর্তীতে তা আমেরিকা এমনকি ভারতেও মুঘল দরবারে এসে পৌছায়। মুঘল শাসক আকবর হিন্দুকুশ পর্বতে বেড়াতে গেলেই সেখানে বরফ ও শিমুই দিয়ে তৈরি এক বিশেষ মিষ্টি খাওয়ার খেতেন, যা আজকের দিনের ফালুদার আদি সংস্করন।
তবে ১৬৬০ সালের আগে আইসক্রিম সাধারন মানুষের জন্য ছিল না। আমেরিকাই প্রথম এর নানা রুপ যেমন ভ্যানিলা, ম্যাঙ্গো,বেরী এর বিভিন্ন ক্যাটেগরির আবিষ্কার করেছে।
১৭৬৮ সালে ফিলিপ লেনজি “THE ART OF MAKING FOREIGN DISH” শীর্ষক পত্রিকায় প্রথম জনসমক্ষে এর রেসিপি প্রকাশ করেন।
আইসক্রিমের প্রথম বাজারকরন করা হয় ১৭৭৭ সালের ১২ই মে নিউইয়র্কে। তখন এর দাম ছিল প্রায় দুই ডলার।
১৮৪৩সালে ন্যান্সি জনসন বরফ তৈরির যন্ত্র আবিষ্কার করলেন। এর সাহায্যে ঘরে বসেই বাড়িতে বরফ পাওয়া যেত।এরপরেই ১৮৫১ সাল থেকে আমেরিকার কিছু গ্রামে আইসক্রিম তৈরি একটি নামী কুটির শিল্পে পরিণত হয়।১৯৪০-৭০ সালের মধ্যে ভারতেই প্রায় দশটি আইসক্রিম পার্লার গড়ে উঠেছিল।এদের মধ্যে কলকাতাতেই ছিল ৬টি। এভাবেই শুরু হয় আইসক্রিমের পথচলা যে বিজয়রথ আজও চলছে।
© সোহম ভট্টাচার্য
Comments
Post a Comment