ভালো থেকো নিশীথ অবশেষ — পর্ব ৫ : জয়দীপ চট্টোপাধ্যায়

ভালো থেকো নিশীথ অবশেষ ৫ ম পর্ব:  

‘কী হল অপ্রতিম দা?’ অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল টায়রা, অপ্রতিমের দিকে চেয়ে। হাতটা ধরার পর বেশ কয়েক পা চুপচাপ ছিল অপ্রতিম, কথা বলছিল না। টায়রাও নীরবেই পা বাড়াচ্ছিল। ভাবছিল-- মানুষটার সঙ্গে এমন নীরবে হাত ধরে হাঁটাও একটা ভালোলাগার মুহূর্ত হয়ে থাকুক। সব সময়ে কিছু বলাও তো জরুরি নয়! নেচার পার্কের নিরাপদ অঞ্চলে ক্যাম্পিং এবং ফরেস্ট-ট্রেকিং করতে গিয়ে সবার আগেই যা অনুভূত হয়... তা হল 'তোমরা প্রাথমিক ভাবে দুধভাত'। অভিজ্ঞতা আর প্রয়োজনীয় দক্ষতা ছাড়া এই নিরাপদ অঞ্চলের বাইরে যাওয়া সম্ভব না। এখানেই নিজেদের মত রোমাঞ্চ কল্পনা করে নিতে হয়... উপভোগ করে নিতে হয়। কেউ কেউ বুঝিয়েও দেয়, সাময়িক অ্যাড্রেনালিন রাশকে তৃপ্ত করার কোনো খেলা নয় গভীর জঙ্গলে প্রবেশ করা। 'যে অরণ্য  তোমার কাছে যতটা অপরিচিত, তুমি সেই অরণ্য এবং অরণ্যবাসীর কাছে তার থেকেও বেশি অপরিচিত'। এতক্ষণ, এই জ্যোৎস্না রাতে গ্রামের শব্দহীন পরিবেশে পথ চলতে চলতে হঠাৎ করেই সেই অরণ্যের যাপনের ঘ্রাণ পাচ্ছিল টায়রা। কষ্টকল্পিত মনে হচ্ছিল না। ঝিঁঝিঁ ডাক, দূরে কোথাও পেঁচার ডেকে ওঠা, মাথার ওপর দিয়ে কোনো রাত-চরা পাখির উড়ে যাওয়া, পাতার ওপর দিয়ে কোনো সরীসৃপ অথবা ছোটো প্রাণীর দ্রুত চলে যাওয়ার শব্দ... এই সব কিছুই। এক নিরাপদ ফরেস্ট-করিডোরের মধ্যে দিয়ে কিছুটা ঘন থেকে উজ্জ্বল খোলামেলা বনস্থলির দিকে এগিয়ে যাওয়ার মত। হাঁটা শেষ হলেই সেই অনুভূতি মিলিয়ে যাবে আসতে আসতে। অন্য কেজো চিন্তা তাদের জায়গায় ফিরে আসবে গোঁতাগুঁতি করে। ইচ্ছে করলেও, কিছুক্ষণ একাকী নীরব থাকা যাবে না।
     নিজেরই নির্মিত এই মায়াপথ ধরে এগোতে এগোতে যখন বনস্পতিদের আড়াল কাটিয়ে আকাশের নক্ষত্রপুঞ্জ খোঁজার চেষ্টা করছিল দিক নির্ধারণের জন্য... মনে হচ্ছিল এই বুঝি আপাত-শান্ত জলাশয়ের গভীরতা থেকে মাথা তুলে উঠবে এক অরণ্যকণ্যা, হাতে সদ্যপ্রস্ফুটিত পদ্মফুল নিয়ে, একটা ময়ূর এসে কাঁধের পাশ ছুঁয়ে চলে যাবে তার,  ঠিক তখনই অপ্রতিম ওর হাত-টা ছাড়া দিল। অপ্রতিমের চমকে ওঠার অনুরণন অনুভব করল টায়রাও। কিন্তু জিজ্ঞেস করতে পারল না কিছু। ইচ্ছে হলেও... পারল না। অপ্রতিম দেখতেও পেল না, নিখুঁত শিল্পীর অভিব্যক্তি পরিবর্তনের মত বিস্ময়, কৌতুহল আর হতাশা পর পর এসে চলে গেল টায়রার চোখে। শুনেও শুনল না যতি চিহ্নের মত অবশেষে জন্মানো দীর্ঘশ্বাস।

  কয়েক মুহূর্ত অস্বস্তি-তরঙ্গের পর জলতলে স্থিতি ফিরতে চায়। প্রকৃতির নিজস্ব একটা রেজিলিয়েন্স আছে। স্থিতি ফিরলে, পার্থিব চিন্তা আর অসাম্য-সংশয় থেকে জাত প্রশ্নরাও ফিরে আসে।  পথ তো ফুরিয়ে এলো, একটু পরে এমনিই ছেড়ে দিতে হত হাত। কিন্তু এভাবে হঠাৎ হাতটা এক ঝটকায় ছাড়িয়ে নেওয়ায় একটু অপমানিতও বোধ করল টায়রা, সচেতন হল। অফিসের সিনিয়র, কখন যে কী মাথায় ঘোরে! সেফও থাকতে চায় হয়ত। রেসর্টের গেটের কাছাকাছি এসে হাতটা ছাড়িয়ে নিল এই ভাবে। মাথায় এটা-সেটা ঘুরলেও মুখে কিছু বলল না, বলা যায়ও না বোধহয়। চোখে অপ্রস্তুত চাহনি নিয়ে তাকিয়ে ছিল কয়েক মুহূর্ত, সেটাও সরিয়ে নিয়ে এগিয়ে গেল স্বাভাবিক পদক্ষেপে। হাতটা ওভাবে ছেড়েই অপ্রতিম বুঝতে পারল খুব অসৌজন্যের কাজ হয়ে গেছে। এটা অপ্রতিমের নিজের চরিত্রের সঙ্গে যায় না। টায়রার হাতটা আবার টেনে নেওয়াও সম্ভব না। আসলে... এভাবে ছাড়ার পর, কারো হাত অতটাই তৎপরতার সঙ্গে আবার টেনে নিতে যতটা অধিকারশক্তি আবশ্যিক– তা এখানে অনুপস্থিত, দুজনেই জানে। কোনোরকম লুকোছাপা না করে অপ্রতিম সরাসরিই ক্ষমা চাওয়ার উদ্দেশ্যে বলল– ‘আ-আই অ্যাম এক্সট্রিমলি সরি… একটা ভুল হয়ে গেছিল, জানো… হঠাৎ সেই ভুলটা…’
- কী ভুল?
- আমার একার না, আমাদের। তোমার হাতটা ধরে এতদিন পর হঠাৎ মনে পড়ে গেল আর…
'আপনি ঠিক আছেন তো অপ্রতিম দা?' পেছন ফিরে তাকাল টায়রা। অপ্রতিমের চোখে ক্ষমা-প্রার্থনা খোঁজার চেষ্টা করল না, কিন্তু 'ভুল' প্রসঙ্গে একটা উদ্বেগ যেন মনের ভেতর থেকে নিজেই বেরিয়ে এলো ওকে অপ্রস্তুত করে। এমন প্রশ্নের অধিকারবোধকে সহসা প্রশ্রয় দিতে নেই। সমস্যা হয়। অপমান ভুলে অপ্রতিমের দিকে উদ্বিগ্ন হয়ে তাকিয়ে রইল টায়রা। দেখে মনে হল সত্যিই মানুষটার মনের ওপর দিয়ে একটা ঝড় বয়ে গেছে যেন কয়েক মিনিটের ব্যবধানে। শুধু আচরণ নয়, গলার আওয়াজও কেমন অন্যরকম লাগল হঠাৎ করে।  দু পা ফিরে এসে অপ্রতিমের কাঁধে আলতো করে নিজের হাতটা রেখে আবার জিজ্ঞেস করল টায়রা, ‘ইজ এভরিথিং অলরাইট?’ অপ্রতিম একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল ‘নাথিং ওয়াজ এভার মেন্ট টু বি অলরাইট... সিন্‌স উই লস্ট দ্য প্যারাডাইস। বাট উই গেট রিলিভড, উই লাইকড টু গেট রিলিভড… হোয়েন উই হিয়ার ইয়েস।’
টায়রা আর কথা বাড়াল না। হাতটাও বাড়িয়ে দিল না ধরার জন্য আর। বরং সামান্য দূরত্ব রেখেই পাশাপাশি হেঁটে এগিয়ে গেল রেসর্টের গেটের দিকে। হাতের মোবাইল ফোন এক অতুলনীয় অজুহাত। খুব সহজেই পাশের মানুষের অস্তিত্বকে এড়িয়ে থাকা যায়, বা এড়িয়ে যাওয়ার অভিনয় করা যায়... মোবাইল ফোনের পর্দায় চোখ রেখে।

— — — —

রেসর্টের গেটে তখন অন্য একজন  সিকিউরিটি গার্ড দাঁড়িয়ে। অপ্রতিমদের আসতে দেখে উঠে দাঁড়াল। ওদের মুখগুলো ভালো করে দেখার চেষ্টা করল। অপ্রতিম গেটের  কাছে এসে পরিচয় দিল ওরা কোন দলের অংশ, আর বুক-পকেটে গুঁজে দিল একটা একশ টাকার নোট। টায়রা সিকিওরিটি গার্ডের দিকে না তাকিয়ে মাথা নীচু করে হনহন করে হেঁটে এগিয়ে গেল, স্ট্রলটা ভালো করে জড়িয়ে নিয়ে। ওর সঙ্গে কিছুটা দূরত্ব রেখেই পেছন পেছন এগিয়ে এলো অপ্রতিম। জমিদারবাড়ির জানলাগুলো ভালো করে একবার দেখে নিল হাঁটতে হাঁটতে… তখন শুধু দুটো ঘরেই আলো জ্বলছে। মাঝে মাঝে কারো কথা বলার আওয়াজও শোনা যাচ্ছে। রেসর্টে ঢোকার দরজার কাছাকাছি পৌঁছতেই হঠাৎ দোতলা থেকে একটা চাপা গুঞ্জন শোনা গেল। যেন কিছুটা দূরে বেশ কয়েকজন একসাথে কথা বলছে।  টায়রা সিঁড়ি দিয়ে উঠতে গিয়ে থমকে দাঁড়াল ওপর দিকে তাকিয়ে। অপ্রতিমও পেছন থেকে দ্রুত এগিয়ে এলো সিঁড়ির দিকে, ঠিক কী হয়েছে সেটা বোঝার জন্য দোতলার করিডোরের দিকে তাকিয়ে কান পাতার চেষ্টা করল। অফিসের গেট-টুগেদার বা পার্টিতে একজন দুজন ঠিক অতিরিক্ত মদ খায়, বমি করে, অসুস্থ হয়ে পড়ে… বা নেশাগ্রস্ত অবস্থায় এমন কিছু বলে বা করে যাতে বচসার সৃষ্টি হয়। ঠিক সেরকম কিছু ঘটে গেছে কি না, বোঝার চেষ্টা করল অপ্রতিম। ও সিনিয়র, ওর যাওয়া দরকার সে ক্ষেত্রে। টায়রাকে পাশ কাটিয়ে দ্রুত সিঁড়ি দিয়ে উঠেই দেখলে বাঁদিক প্রাজক্তার সঙ্গে আরো কিছু মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কারো চোখে স্পষ্ট দুশ্চিন্তার ছাপ, কাউকে দেখে মনে হচ্ছে শক্‌ড। চোখের দৃষ্টিগুলো দেখে ভালো লাগল না অপ্রতিমের। প্রাজক্তাকে জিজ্ঞেস করল-- কী হয়েছে? প্রাজক্তা কাঁপা কাঁপা গলায় দূরে অন্যদিকের ঘরটা দেখিয়ে কিছুটা হিন্দিতে, কিছুটা ইংরেজীতে যা বলল, তা শুনে অপ্রতিম আর ওখানে দাঁড়িয়ে থাকতে পারল না। জাস্ট স্টে কাম… নোন নীড টু প্যানিক– বলতে বলতে ছুটে চলে গেল সেই দিকে… যেদিকে প্রাজক্তা দেখাচ্ছিল। টায়রাও ততক্ষণে ধাপে ধাপে উঠে এসে প্রাজক্তার পাশে। ওর কাঁধে হাত রেখেই সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকাল। প্রাজক্তা আরো একবার বলতে শুরু করায়, কিছুটা শুনেই সেখান থেকে হন্তদন্ত হয়ে ওই দূরের ঘরের দিকে এগিয়ে গেল টায়রা। প্রাজক্তার কথা শেষ হল না।

     এই সেই কোণের দিকের ঘর, যা পর্যটক বা অতিথিদের থাকার জন্য নয়। প্রত্যুষ কিছু টাকা দিয়ে কাউকে ম্যানেজ করে চাবি জোগাড় করেছিল। রাগিনী আর প্রত্যুষ এই ঘরেই নিজেদের জন্য কিছুটা সময়ে চুরি করে নিয়েছিল, সকলের চোখের আড়ালে। ভারী মেহগনি কাঠের দরজাটা এখন খোলা। ভেতরে দুটো মেয়ে আর তিনজন ছেলে বসে আছে। অপ্রতিম আসতে আসতেই, আরো দুজন ছেলে পেছন পেছন এলো। অভীক আর মৈনাক… অপ্রতিমের পেছন থেকে মাথা তুলে দেখার চেষ্টা করল, ঘরের ভেতরে ঠিক কী ঘটেছে। ঘরের ভেতরে মেয়ে দুটো, রাগিনীর দুই ঘনিষ্ঠ বান্ধবী অনশু আর হনসিকা… দুজনেই অবাঙালী। একজনের কেঁদে কেঁদে চোখের মাসকারা গলে গলে গালে এসে পড়েছে। আর একজন অপ্রতিমকে আসতে দেখে মুখ তুলে ওর দিকে অসহায়ের মত তাকালো একবার, আর একবার সামনে শুয়ে থাকা রাগিনীর দিকে তাকাল। নিথর হয়ে পড়ে আছে মেয়েটা। শ্বাস-প্রশ্বাস চলছে কি না বোঝা যাচ্ছে না। ঘরের অন্য দিকে কৃষাণু হাঁটুর ওপর ভর দিয়ে বসে, ঝুঁকে পড়ে দেখার চেষ্টা করছে, সম্ভবত এটাই বোঝার চেষ্টা করছে… রাগিনী শুধুই অচৈতন্য, না আরো সিরিয়াস কিছু! ওর পেছনে দাঁড়িয়ে ভিভান আর নাদিম। কিছু দূরে… একটা কাঠের আলমারিতে পিঠ দিয়ে পা ছড়িয়ে বসে আছে প্রত্যুষ।  চোখের জল মুছতে মুছতে কান্না-জড়ানো গলায় বলছে– আই ডিনট নো ম্যান… সিরিয়াসলি আই ডিনট নো শিট অ্যাবাউট অল দিস!  অভীক আর মৈনাকের পেছন পেছন টায়রাও এসেছে দরজার কাছে… অপ্রতিমকে পাশ কাটিয়ে ঘরের ভেতর ঢুকে কৃষাণুকে জিজ্ঞেস করল– 'চোখে মুখে জল দিয়েছ?... ডাক্তার ডাকতে হবে নাকি? হোয়াট ওয়েন্ট রঙ… হল টা কী এখানে?'
যতটা সম্ভব শান্ত ভাবে বলার চেষ্টা করলেও, ওর গলায়  অভিযোগের রেশটা চাপা পড়ল না। গ্রুপ আউটিং-এ এসে একটি মেয়ের এভাবে পড়ে থাকা… অনেক রকম প্রশ্নের জন্ম দেয়। অপ্রতিম তাড়াতাড়ি রাগিনীর শরীরের পাশে বসে ওর হাতটা ধরে নাড়ীর গতি বোঝার চেষ্টা করল। দুটো আঙুল নাকের কাছে রেখে দেখল ভুরু কুঁচকে। তারপর ফোঁস করে একটা শ্বাস ছাড়ল… যে কেউ বলতে পারে স্বস্তির শ্বাস। কৃষাণু কারো দিকে না তাকিয়ে, রাগিনীর দিকে তাকিয়েই মাথা নীচু করে বলল– ‘আমি পালস চেক করেছি, চোখে-মুখে জল ছিটনো দরকার। অ্যাপারেন্টলি কোনো ফিজিকাল ট্রমার সাইন দেখছি না। তবে পড়েছে মেঝের ওপর সজোরে। মনে হচ্ছে দেখে– শি ড্রপড সেন্সলেস’। টায়রা একই রকম উদ্বেগ নিয়ে বলল– ‘প্লিজ… ওকে কেউ আগে খাটে শোয়ানোর চেষ্টা করো! ওর সেন্সটা ফেরানর চেষ্টা করা দরকার! উই নীড মেডিক্যাল হেল্প!’ অপ্রতিম সঙ্গে সঙ্গে বলল, ‘হ্যাঁ হ্যাঁ… এই তোরা রাগিনীকে আগে বিছানায় শোয়া। প্লিজ!’ কথাটা বলল বটে, তবে অন্যদের এগিয়ে আসার আগে নিজেই রাগিনীকে কোলে তোলার চেষ্টা করল। রাগিনী অচৈতন্য বলে ওর মাথা-ঘাড় দুটোই তখনই কাত হয়ে যাচ্ছে। কৃষাণু মাথা আর ঘারটা সাপোর্ট দেওয়ার জন্য ধরল। দুজনে মিলে এনে শোয়ালো বিছানায়। ততক্ষণে হনসিকা  ওর সঙ্গে আনা জলের বোতল থেকে আবার চোখে মুখে জল ছেটানো শুরু করল। রাগিনী চোখ খুলছে না। রাগিনীর পরনে একটা ঢিলেঢালা সাদা টপ আর কালোর ওপর হলুদ নকশা করা একটা শর্ট। দেখেই বোঝা যাচ্ছে, টপের নীচে কোনো অন্তর্বাস নেই। অপ্রতিম অনশুর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল– ‘ইস্কো ইয়াঁহা প্যাহলে কিসনে দেখা? অ্যায়সে হি আনকনশাস মিলি থি?’ অনশু প্রশ্নটা শুনে ঠিক জেরার মুখে থতমত খাওয়ার মত কাঁপা কাঁপা গলায় অসংলগ্ন ভাবে বলার চেষ্টা করল– রাগিনী এখানে কী করছিল ওরা জানে না। প্রত্যুষ ওদের ফোন করে ডেকেছে।  
অপ্রতিম কৃষাণুর দিকে সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকাল। কৃষাণু  একবার প্রত্যুষের দিকে আড়চোখে তাকিয়ে চাপা গলায় বলল ‘অনেক ব্যাপার… কিন্তু আগে মেডিকাল হেল্প দরকার। দেরি হয়ে যাবে!’ টায়রা  এগিয়ে এসে রাগিনীর পাশে বসল, ওর ডানহাতের তালুটা নিজের হাতে নিয়ে বলল– ‘প্লিজ! ফর গডস সেক!... ওকে এখান থেকে নিয়ে যেতে হবে। এই গ্রামে এত রাতে ডাক্তারও পাওয়া যাবে না!’ কথাগুলো বলতে বলতে ক্রমাগত রাগিনীর হাতের তালু ঘষে গরম করার চেষ্টা করে যাচ্ছিল টায়রা। ওর দেখাদেখি অনশুও এসে বসল পায়ের তলাটা ঘষে গরম করতে... যদি কোনো সুফল হয়।  দরজার কাছ থেকে অভীক হঠাৎ বলে উঠল ‘ফিট হয়ে গেলে কিছু হোম-মেড রেমেডি কাজে দেয়, অজ্ঞান-টজ্ঞান হলে সেসব ট্রাই করে... আমি অনলাইন সার্চ করে দেখব? কিছু অ্যারেঞ্জমেন্ট করার থাকলে রেসর্টের লোকগুলো...' ওর কথা শেষ হওয়ার আগেই মৈনাক ওর কাঁধে হাত রেখে ইশারায় চুপ করতে বলল। অভীকের কথাগুলো শুনে হোক বা অন্য কোনো কারণে, প্রত্যুষ আবার হাউহাউ করে কেঁদে উঠল, ঘরে উপস্থিত যে কেউ বুঝতে পারবে ওর জড়ানো কথা শুনে... প্রকৃতিস্থ নয়। অপ্রতিম ভিভানদের দিকে তাকিয়ে ইশারা করল, ওকে তুলে নিয়ে যেতে রুমের বাইরে। প্রত্যুষকে ঘরের বাইরে নিয়ে যাওয়ার পর আর  একবার রাগিনীর পালস দেখতে দেখতে অপ্রতিম বলল, ‘সিংক করতে শুরু করলে বড়ো সমস্যা হবে… কৃষ, তুই কেয়ারটেকার আর ম্যানেজারকে কল কর, জিজ্ঞেস কর এমার্জেন্সি মেডিকেল ফেসিলিটি কেউ আছে কি না। এলস এখনই গাড়ি নিয়ে নিয়ারেস্ট হাসপাতালে যেতে হবে ওকে নিয়ে। সেখানে পৌঁছনোও একটা সময়ের ব্যাপার… হাতে সময় নেই অত। আর একটা কথা… ঘরে সকলে বুঝতেই তো পারছ, ব্যাপারটা সিরিয়াস? এমন কোনো ছেলেমানুষী করো না যাতে সকলের বিপদ বাড়ে। প্লিজ। একজনের ভুল অনেকজনের সমস্যার কারণ হতে পারে। অ্যান্ড আই উইল নট হেজিটেট টু টেক সিরিয়াস মেজারস এগেন্সট দ্যাট একজন… ইফ নীডেড।’ কথাগুলো শেষ করে কিছুক্ষণ কৃষাণুর দিকে তাকাল অপ্রতিম। ও চাইছিল কৃষাণু কিছু বলুক এই কথাগুলো শুনে। কিন্তু কৃষাণু কিছুই বলল না। একটা প্রচ্ছন্ন্য বিরক্তি নিয়ে মুখটা ফিরিয়ে নিয়ে তাকিয়ে রইল ঘরের জানলার দিকে… জানলা দিয়ে তখনও চাঁদটা দেখা যাচ্ছে, গাছের পাতার আড়ালে চলে যাচ্ছে। ভিভানরা প্রত্যুষকে নিয়ে যাচ্ছে ওর ঘরে, করিডোর থেকে প্রত্যুষের কান্নার শব্দ ভেসে আসছে, ও যেতে চাইছে না রাগিনীকে এভাবে ফেলে রেখে... কিছু একটা বুঝতে না পারার কথা বার বার বলছে, নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করতে চাইলে মানুষ যেমন করে। ভীষণ অস্বস্তিকর আর প্রেডিক্টেবল লাগছে এই ব্যবহার। এতে সকলের সন্দেহ আরো দৃঢ় হয়। ছেলেটা এতটাই নেশার ঘোর আর শকের মধ্যে আছে, যে কেউ কিছু বোঝালেও সুবিধে হবে না। কোনো কথা না বাড়িয়ে, চুপচাপ কোনো ঘরে টেনে নিয়ে গিয়ে মুখ বন্ধ করা একমাত্র পথ। অপ্রতিম চোখের ইশারায় অভীক আর মৈনাককে বলল ওদিকটা গিয়ে দেখতে।
রেসর্টে আরো অন্য দল আছে, এইসব অস্বাভাবিকতা, গভীর রাতে কারো অসংযত ব্যবহার– দ্রুত কারো না কারো দৃষ্টি আকর্ষণ করে। অপ্রতিম একবার ঘরে উপস্থিত সকলের চোখ-মুখ দেখার চেষ্টা করল চারদিক দেখার ছলে। বুঝতে পারল টায়রা আর অনশু অপ্রতিমকেই দেখছে, ওদের সঙ্গে চোখাচুখি হলে রাগিনীর দিকে দৃষ্টি সরিয়ে নিল দুজনেই। স্বাভাবিক, একটা আচমকা আসা বিপদ সকলকেই আশঙ্কিত করে, উদ্বিগ্ন করে... একটা নিরাপত্তাহীনতাও জেগে ওঠে কোথাও। তার ওপর এরা সকলেই অল্পবয়সী, এমন কিছুর জন্য কে-ই বা মানসিক ভাবে প্রস্তুত থাকে? অপ্রতিম আর কৃষাণু ছাড়া সে অর্থে সিনিয়রও আর কেউ নেই। অল্প বিস্তর নেশাও করেছে সবাই। অপ্রতিম নিজেও বুকে হাত দিয়ে বলতে পারবে না, যে ও ঘুমলে সকালে হ্যাং-ওভার হবে না। ''আর ঘুম!'... ঘুমের কথা মনে হতে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো নিজে থেকেই। কৃষাণুকেও দেখে মনে হচ্ছে ক্লান্ত, অথবা কোনো কারণে দুর্বল– দু-হাতে কপালটা ভর করে মাথা নিচু করে বসে আছে... মুখ ঢেকে। খারাপই লাগছিল ওকে দেখে... অথচ পরিস্থিতিই এমন– ইচ্ছে থাকলেও কৃষাণুকে এখন আলাদা করে সময় দিতে পারবে না অপ্রতিম। মেয়েটার সঙ্গে যা-ই ঘটে থাকুক, স্বাভাবিক লাগছিল না অপ্রতিমের। হয়ত টায়রা আর অন্য মেয়েরাও এটা বুঝতে পারছে... আন্দাজ করছে কিছু, কিছু একটা সন্দেহ করছে মনে মনে। কিন্তু সব থেকে বড়ো দুশ্চিন্তার কারণ-- মেয়েটার জ্ঞান ফিরছে না। নিজের মনে জট বেঁধে আসা দুশ্চিন্তাগুলো একসাথে ঝেড়ে ফেলে খাট থেকে উঠে পড়ল অপ্রতিম, কৃষাণুকে 'তুই থাক, আমি আসছি।' বলে ঝড়ের  বেগে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে।

        রাত একটার সময়ে রেসর্টের সব অতিথিদের উদ্বিগ্ন করে, ম্যানেজার আর কর্মচারীদের ভয় এবং দুশ্চিন্তার কারণ বাড়িয়ে ওরা জমিদারবাড়ির উষ্ণ পরিবেশ ছেড়ে চলে গেল একটা এসইউভি করে, নিকটতম হাসপাতালের দিকে… যা এই অঞ্চল থেকে প্রায় দশ-বারো কিলোমিটার দূর। এত রাতে কাছাকাছি কোনো মেডিকাল এমার্জেন্সির দায়িত্ব ম্যানেজার নিতে পারল না। জানিয়ে দিল, সকালের আগে কারো খোঁজ পাওয়া যাবে না। আরোই ভয় পেলো, মেয়ে ঘটিত কিছু কেলেঙ্কারির সঙ্গে যদি রেসর্টের নাম জড়িয়ে যায়। প্রাথমিক ভাবে একটা ছোটো ঝামেলাও হল... ওই বিশেষ ঘরটি খোলা পাওয়া, তার চাবি কোথা থেকে পেলো-- এইসব প্রশ্ন নিয়ে। ওই ঘরটি অতিথিদের জন্য নয়, কাউকে থাকতে দেওয়া হয় না ওই ঘরে। তারপরেও যে ওই ঘরের চাবি নিয়ে ঘরটি খোলা হয়েছে, সেই ঘরেই কিছু ঘটেছে-- এতে রেসর্টের কর্মচারী এবং এই অফিস থেকে আসা দল দুপক্ষেরই সমান দায় থাকে। দায় মেনে নিয়েও সেই নিয়ে তদন্ত করা, বা উপযুক্ত পদক্ষেপ নেওয়ার সময় তখন নয়। অভিযোগ পাল্টা-অভিযোগের মাঝেই কৃষাণু আর অপ্রতিমকে দিয়ে একটা লেটার-প্যাডে সই করিয়ে লিখিয়ে নিল রেসর্টের রাত্রিকালীন শিফটে দায়িত্বরত ম্যানেজার– ওরা নিজেদের সিদ্ধান্তে এবং দায়িত্বেই  সঙ্গে করে অসুস্থ মেয়েটিকে নিয়ে হসপিটালের খোঁজে যাচ্ছে। মেয়েটি ওদের পরিচিত। কোনো খোঁজ না দিলে রেসর্ট কর্তৃপক্ষ সকালে স্থানীয় থানায় রিপোর্ট করবে। অপ্রতিমরা যে গ্রুপের বেশ কিছু সদস্যকে রেসর্টে রেখে যাচ্ছে আবার ফিরে আসবে বলেই– এই মুখের কথায় কোনো কাজ হল না। টায়রা আর অনশু গাড়িতে বসল রাগিনীকে নিয়ে। কৃষাণু বা অপ্রতিম কেউই ড্রাইভ করতে ভরসা পেল না… সারা সন্ধ্যে ড্রিংক করার পর আর নিজের হাতে স্টিয়ারিং নিয়ে নতুন করে বিপদ বাড়ানোর মানে হয় না। কৃষাণুকেও সঙ্গে নিয়ে যাওয়ার ইচ্ছে ছিল না অপ্রতিমের, এমনিতেই রাতে খাওয়ার আগে অসুস্থ হয়ে পড়েছিল ছেলেটা। ওকে বারণ করার সুরেই বলল, ‘তুই গিয়ে কী করবি? নিজেরই তো শরীর ঠিক নেই... এখানে অন্যদের দেখ, আমি অভীক কিংবা নাদিমকে নিয়ে যাচ্ছি।’ কৃষাণু একেবারেই কানে তুলল না কথাটা, বলল 'ডিরেক্ট ম্যানেজার তো, একটা রেসপনসিবিলিটি থাকে... থাকা উচিৎ। আর এখানে থাকলে অনেকের কথার উত্তর দিতে হবে... কথায় কথা বাড়বে। টেনশনও হবে... তার চেয়ে... '  
হোটেলের একজন কর্মীকে গাড়িটা চালানোর জন্যে সঙ্গে পাঠানোর অনুরোধটা রাখল সেই অসন্তুষ্ট ম্যানেজার, তাতে রেসর্টের নিজেদের লোক কাউকে সাক্ষী থাকতেও পাঠানো হল সঙ্গে। ভালোমন্দ যা-ই হোক সময়ে সময়ে ফোনে খবর চলে আসবে।
(চলবে) 

© জয়দীপ চট্টোপাধ্যায়

অঙ্কন:  শাশ্বত বন্দ্যোপাধ্যায়





Comments

Popular posts from this blog

অনিন্দ্য সরকারের গুচ্ছ কবিতা : গান ছুঁয়ে ছুঁয়ে

অয়ন হালদারের পাঁচটি কবিতা

মুন্নী সেনের গুচ্ছ কবিতা : সম্বোধন