ভালো থেকো নিশীথ অবশেষ — পর্ব ৪ : জয়দীপ চট্টোপাধ্যায়


প্রশ্নটা শুনে অপ্রতিম কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। ভাবার চেষ্টা করল। টায়রা কিছুটা কাছে এগিয়ে এসে গলা নামিয়ে বলল, ‘অত ভেবে বলবেন না, ভেবে বললে লোকে বানিয়ে উত্তর দেয়!’ নিশাচর প্রাণী শুনে প্রথমেই অপ্রতিমের চোখের সামনে ভেসে উঠল একটা নেকড়ের মুখ। একলা, রাতের অন্ধকারে বিচরণ করা একটা নেকড়ে। কিন্তু নেকড়ে কি বিশেষ ভাবে নিশাচর?– নিশ্চিত হতে পারল না। তারপরই মনে এলো বাদুর আর পেঁচার কথা। সঙ্গে সঙ্গে সেই পেঁচাটা আবার একবার ডেকে উঠল– শিশুর কান্নার মত ককিয়ে ওঠা শব্দ।
       ওরা এতক্ষণে হাঁটতে হাঁটতে পুকুরের অন্যপ্রান্তে, যেখান থেকে ওদের রিসর্টটা দেখা যায়। এককালের জমিদার-বাড়ি…এখন পুনর্নির্মিত বিলাসমহল। অপ্রতিম কিছুক্ষণ চেয়ে রইল সেইদিকে। জমিদার-বাড়ির কাঠের খরখরি দেওয়া পাল্লাগুলো একই রকম রাখা আছে। শুধু কাচের আর একটা করে পাল্লা করা, ঘরগুলো বাতানুকূল রাখার জন্য। এখনও কয়েকটা জানলা দিয়ে আলো আসছে, কোথাও হলদেটে, কোথাও মাখন-রঙা আলো। জমিদারবাড়ি, তার জানলা, জানলা থেকে বেরিয়ে আসে নরম মাখন-রঙা আলো– এদের প্রতিবিম্ব টলটল করেছে পুকুরের জলে, যেখানে পানা সরে গেছে। ‘কী সুন্দর ফ্রেম… তাই না?’ টায়রার কথায় আবার একটা স্বল্প নীরবতার অবসান ঘটল।
- ছায়া? না কায়া?
- মানে? ওহ আচ্ছা… দুটোই। শুধু রিফ্লেকশনের একটা ভালো ছবি তুলতে পারলেও দারুণ আসবে।
- মানুষের চোখ যা দেখে, ক্যামেরার অ্যাপারচার তা দেখতে পায় না সব সময়ে…
- অত জটিল করে সবসময়ে ভাবতে পারি না… এত কনট্র্যাডিকশন, এত সেকন্ড থট…
- তোলো না, কিছু ছবি তোলো। তোমার তো ভালো মোবাইল ফোন। ক্যামেরাটাও ভালো।
- হুম… কটা তুলি। একটু ওয়েট করুন।
- সরে দাঁড়াব?
- সরেই তো আছেন… আর কত সরবেন!
বলে খিলখিল করে হেসে উঠল টায়রা। অপ্রতিম তাও একটু দূরত্বে চলে গেল। টায়রাকে একটু দূর থেকে দেখার জন্য। জ্যোৎস্না আর রাজবাড়ি থেকে আসা আলোর প্রতিফলন ওর মুখে আর শরীরে জলের আলপনা এঁকে দিচ্ছে। অপ্রতিমের কাছে এমন কোনো ক্যামেরা নেই যা দিয়ে এই মায়াকে বন্দী করা যায়। দীর্ঘ শ্বাস ফেলে অস্ফুটে বলল– মানবে না জানি, কিন্তু মানুষের চোখ যা দেখে, মানুষ আজ অবধি কোনো যন্ত্রই আবিষ্কার করতে পারেনি যা সেই ভাবে ধরে রাখবে মুহূর্তকে।
- কিছু বললেন?
- যে জানলাগুলো খোলা, আলো আসছে… কারা আছে জানো?
- বুঝতে পারছি না… প্রত্যুষ, কৃষদা… ওরা বোধহয় ওইদিকটা পেয়েছিল।
- প্রত্যুষকে রাগিণী ডেট করছে… না?
-
- যাক গে, বাদ দাও। এদের প্রজন্মটা আলাদা, বুঝি না ঠিক।
- ছাড়ুন না। প্রত্যেকে নিজের মত। অন্য কাউকে বিরক্ত তো করছে না!
- সেই… ছবিগুলো কেমন এলো… দেখি?
- ধুস… এই আর কি…
অপ্রতিম একটু কাছে এগিয়ে এসে মোবাইলটা হাত থেকে নিল, ছবিগুলো দেখার আগে টায়রাকে দেখল আর একবার। ছবিগুলো যেমন আসার কথা তেমনই। একটু এডিট করে পোস্ট করলে ভালোই লাগবে। তবে সেগুলো দেখার মাঝেই পর পর কিছু নোটিফিকেশন এলো। কেউ ম্যাসেজ করেছে। কোথায় আছো, মিস করছি, কখন ফোন করবে… পর পর। কোতূহল থাকলেও নামটা দেখতে পেল না অপ্রতিম। ওর চোখের অভিব্যক্তি দেখে টায়রা ফোনটা নিয়ে নিল দ্রুত হাত থেকে।
- বয়ফ্রেন্ড?
- কে?
- যে ম্যাসেজ করছে?
- হা হা হা… ইয়ু আর সাউন্ডিং মোর পজেজিভ দ্যান বিইং কিউরিয়াস, ইয়ু নো দ্যাট?
অপ্রতিম একটু অপ্রস্তুত হয়েই অন্য দিকে তাকিয়ে একটু এগিয়ে গেল। অল্প আলোতেও টায়রা বুঝতে পারল ওই হাসিটা নিজেকে গুটিয়ে নেওয়ার জন্য। সত্যিই তো… সামান্য আলাপ, কিছুক্ষণের কথা, একটি মেয়ে একটু ওপেন হলেই কি অধিকারবোধ জন্মে যায়? উচিৎ? ‘তোমাকে তখন জেদ আর আহত হওয়ার কথা বলেছিলাম… মনে আছে?’ পেছন না ফিরেই জিজ্ঞেস করল অপ্রতিম। টায়রা এক নজরে ইনকামিং ম্যাসেজগুলো দেখতে দেখতে বলল ‘হুম?’
- ওই যে তখন বলেছিলাম… জেদ থেকে বলছ, না আহত হয়ে?
- ও হ্যাঁ… সে কথা এখন আবার মনে পড়ল যে?
- একটা দূরত্ব থাকলে, আহত হওয়ার সম্ভাবনাও কম থাকে। আঘাতটা অত জোরালো হয় না। সব ভালোলাগা সম্পর্কের বেশি কাছে না যাওয়াই ভালো।
- হুম, মোহ কেটে যায়।
- ঠিক বলেছ। একজন ভালোলাগা মানুষকে নিয়ে গড়ে ওঠা যে ধারণা, খুব বেশি কাছে থাকলে তা মেলে না অনেক সময়ে। আমূল বদলেও যায় অনেক সময়ে।
- গ্রাস ইজ নট সো গ্রীন, হয়েন লুকড ফ্রম ক্লোজার ডিস্টান্স। বয়স কম মশাই… তবে একটু একটু আমিও বুঝি!
- হুম।
- আচ্ছা… এটা কি আপনার ক্ষেত্রেও অ্যাপ্লিকেবল?
- মানে?
- মানে… আপনার খুব কাছে আসার আগে স্ট্যাটিউটারি ওয়ার্নিং দিচ্ছেন না তো?
- বরং উলটোটাই। বয়স বেড়ে গেছে তো… ভালোলাগার সম্পর্ক কোনোভাবেই ভুল কারণে বা ভুল বোঝাবুঝির কারণে নষ্ট হতে দিতে ইচ্ছে হয় না। তার থেকে একটা দূরত্ব ভালো। প্রত্যাশা যত কম থাকে, তত ভালো।
- যেমন?
- হারলে কুইনকে চেনো? কিংবা বসন্তসেনা?
- হারলে কুইনকে চিনি… বসন্তসেনা, মনে পড়ছে না।
- হারলে কুইন বা বসন্ত সেনার মত কাউকে দেখে তীব্র ভালোলাগা জন্মাতে পারে। ভালোলাগা কেন? ভালোবাসাই! অসীম ভালোবাসা! প্রাইসলেস অনুভূতি! নির্বিকল্প। কারো সঙ্গে ভাগ করা সম্ভব নয়! কিন্তু একটা দূরত্ব থেকেই তা অনুভব করা ভালো। কাছে গেলে কখন যে ঝলসিয়ে দেবে!
- এরকম অভিজ্ঞা হয়েছে কখনো?
-
- কী হল, হাসলেন যে?
- সে অনেক গল্প, একটা গোটা রাত ফুরিয়ে যাবে… শেষ হবে না।
- আরব্য রজনীর মত গ্রাম্য রজনীর গল্প? রাতের পর রাত?
- আই উইশ… আহ, আই সো ডু উইশ ইট টু বি ট্রু!
- অথচ দেখুন, আর একটু এগোলেই মাটির রাস্তা শেষ, নুড়ি বিছনো রাস্তা… ডানদিকে হেঁটে আর কিছুটা এগোলেই আমাদের যাত্রা শেষ। ডেট উড বি ওভার।
- হুম… মুনলিট নাইট ইজ অলোয়েজ আ কিংডম অফ নেভার এন্ডিং মেলানকলি। গভীর ভালোবাসার মধ্যেও বেদনা পিছু ছাড়ে না।
-
- অথচ তোমার সঙ্গে আর ক’দিনেরই বা আলাপ। কতটুকুই বা চেনো তুমি আমাকে! তুমি তোমার জগতেই ভালো। এই স্বল্পমেয়াদী রঁদেভুর শেষে তুমি ফিরে যাবে তাদের কাছে, যারা তোমার জগৎ। এটাই স্বাভাবিক, এটাই প্রত্যাশিত।
- আপনার খারাপ লাগবে। জানি। অস্বীকার করবেন না।
- করছি না।
- আবার কখনো ইচ্ছে হবে এভাবে কিছু দূর হাঁটতে? ইচ্ছে হলে জানাবেন সাহস করে?
- আসলে কী জানো? যাদের খুব কাছে পেয়ে হারিয়েছি। তাদের কথা মাঝে মাঝে মনে পড়ে। কারো কারো সঙ্গে মিল পাই। পুরনো কথা মনে পড়ে যায়। আমরা যে প্রত্যাখ্যাতদের প্রতিনিধি!
- আপনার একটা ইচ্ছে আছে… তার প্রোজ অ্যান্ড কনস নিয়ে ভাবেন। আর অন্যের ইচ্ছেটা? তাকে জিজ্ঞেস করবেন না? সেটা নিয়ে ভাববেন না?
- যখন সংঘাত হয়, স্ফুলিঙ্গ ছিটকে বেরোয়, অবশেষে দীর্ঘ টানাটানির পর একটা বিচ্ছেদ নেমে আসে… ক্যাজুয়ালটি দুদিকেই সমান। কখনো কখনো অজ্ঞাতে কোল্যাটারাল ড্যামেজও থেকে যায়!
- আপনার আসলে কষ্ট পেতে ভালো লাগে… মনে হয়।
- স্টিল বেটার দ্যান দোজ, যাদের কষ্ট দিতে ভালো লাগে!
- মে বি… মে বি নট!
‘Well I'll be damned
Here comes your ghost again
But that's not unusual
It's just that the moon is full
And you happened to call’
কবিতার মত লাইনগুলো বলে অপ্রতিম থামল। জিজ্ঞেস করল… ‘বুঝলে?’

গুনগুন করে গেয়ে উঠল টায়রা–
‘Now you're telling me
You're not nostalgic
Then give me another word for it
You, who are so good with words
And at keeping things vague’
গাওয়া শেষ হলে বলল--
‘আপনার সঙ্গে সত্যিই আমার পরিচয় খুব সামান্যই। আমরা দুজনেই দুজনের ব্যাপারে কিছুই জানি না, তার ওপর প্রফেশনাল রিলেশনের অবলিগেশনও আছে। জানি, জটিলতা না থাকা দুজনের পক্ষেই ভালো। আপনাকে হেসিটেট করতে হবে না। আমিও খুব স্বাভাবিক আছি, ভাববেন না কোনো ইনফ্যাচুয়েশন টাইপের কিছু। হেলদি ফ্লার্ট সবসময়েই পজিটিভ এনার্জি দেয়। কিন্তু আপনার সঙ্গে কথা বলতে বেশ ভালো লাগে, কোথাও একটা ফ্রিকোয়েন্সি ম্যাচ করে, রিলেট করতে পারি… তাই…’
অপ্রতিম হাসল, শুধু হালকা ঠোঁটের হাসি। তারপর হাতটা টায়রার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল, ‘সো চিয়ার্স টু দ্য মুনলাইট ডেট… এসো মাটি থেকে রাজপথে নিয়ে আসি তোমাকে।’
টায়রাও হাসল, চাঁদের হাসির মত শুভ্র উজ্জ্বল সরল হাসি। তারপর অপ্রতিমের বাড়িয়ে দেওয়া হাত ধরে এগিয়ে এসে বলল ‘এলাম, এবারে নিয়ে চলুন এসকর্ট করে। যেভাবে বিদেশী সিনেমায় জেন্টলম্যানরা লেডিদের ধরে– কনুইয়ের কাছে নিজের কনুই জড়িয়ে।
ওরা দুজনেই সাবধানে হাসল… রিসর্ট আর বেশি দূরে না। এই নিঝুম রাতে কারো হাসি অজান্তেই অন্য কাউকে সতর্ক এবং কৌতূহলী করে তুলতে পারে।  

— — — —

   টায়রার হাতটা নিজের হাতের মুঠোয় নিতে কেমন পালক পালক অনুভূতি হল। বহু বছর পর এমন মুঠোয় পালক ধরার অনুভূতি! মুহূর্তের জন্য একবার অতসীর মুখটা চোখের সামনে এসেই হারিয়ে গেল। এমনই পালক ধরে হাঁটার সেই বিকেলগুলো, সন্ধ্যেগুলো। অতসী কথা কম বলত। টানা টানা চোখ, মোটা করে কাজল পরত। কথা বলার সময়ে এক অদ্ভুত মায়া ভরা দৃষ্টি নিয়ে, শিশুর কৌতূহল নিয়ে তাকিয়ে থাকত চোখের দিকে। কখনো টেবিলে, কখনো ঘাসের ওপর, কখনো কোলে মাথা রেখে। ওর সঙ্গে নিয়মিত দেখা বা কথা হত না। মাঝে মাঝে ও বলত– ‘আজ ভীষণ একা লাগছে, একটু হাঁটতে যাবে?’ কিছুক্ষণ পাশাপাশি হেঁটে, অথবা কোথাও বসে দীর্ঘ ক্লান্তি কেটে যেত। ও কথা বলত কম, হাতটা সব সময়ে ধরে থাকতে চাইত… আঁকড়ে ধরে রাখার একটা প্রবণতা ছিল। ওরা সব সময়ে দেখা করত মুক্ত আকাশের নীচে। সবুজ মাঠে, নদীর পাড়ে। মাঝে মাঝে ট্রেনে করে যেত কিছু দূর। একটা বেলা কাটিয়ে আবার ফিরে আসত। তারপর যে যার নিজস্ব গন্তব্যের দিকে চলে যেত। হাতটা ছাড়ার সময়ে কার বেশি কষ্ট হত, ফেরার সময়ে কার বেশি একা লাগত… বুঝতে পারত না অপ্রতিম। জপ করার মত নিজেকে বার বার বোঝাতো– প্রত্যাশা রাখবে না। প্রত্যাশা রাখবে না। প্রত্যাশা রাখবে না।
কিন্তু একেবারে আলাদা করে নিতে পারল না নিজেকে। খসিয়ে ফেলতে পারল না পিছুটান। গা থেকে আভ্যন্তরীন কিছু উপড়ে আসার মত ব্যথা অনুভব করত। মনে হত অতসীও কিছুটা অনুভব করে এই ব্যথা। তাই সব রকম যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করার কথা মনোস্থির করেও পেরে উঠছে না। মনের জোর অথবা সিদ্ধান্তের ব্যাপার না…
‘এতই আছে বাকি, জমেছে এত ফাঁকি,
কত যে বিফলতা, কত যে ঢাকাঢাকি,
আমার ভালো তাই চাহিতে যবে যাই
ভয় যে আসে মনোমাঝে’

কথার পিঠে কথা বলে নিজেকে জাস্টিফাই করা যায়, নিজেদের আত্মপক্ষেও বলা যায়… কিন্তু ওরা দুজনেই জানত– ওদের এই সমান্তরাল সম্পর্কটা একটা অ্যাবজার্ড জগত, যা বাস্তবে টেনে আনলে শুধু ওরা নয়, আরো অনেকে ধাক্কা খাবে, আহত হবে। কোনো স্পষ্টবাদী রিয়েলিস্ট মুখের ওপরেই বলে দিতে পারে– ‘তোমরা দুজনেই ঠকাচ্ছ অন্য কাউকে। এটা অ্যাক্সেপ্ট করো!’
     অতসীর সঙ্গে প্রথম দেখা হয়েছিল মোহরকুঞ্জে, লোকসঙ্গীতের অনুষ্ঠানের মাঝে। প্রথম দিন বুঝতে পারেনি বিবাহিত। বেশ কয়েকদিন পর জানতে পারল। সেদিন অতসীর খুব জ্বর। জ্বর কমানোর ওষুধ সঙ্গে নিয়ে দেখা করতে এসেছিল– লাল ছলছলে চোখ নিয়ে। একজন বিবাহিত মানুষও পারে স্বামী ছাড়া আর একজনের ওপর ইমোশনালি নির্ভর করতে। অতসীর কথা বোঝা যেত… ওদের অ্যারেঞ্জ ম্যারেজ, পুরনো সম্পর্ককে ভুলতে জোর করেই এমন বিয়ে করেছে… অথচ কদিন পর বুঝেছে, কিভাবে ঠকাচ্ছে অন্য মানুষটাকে, এমন কি নিজেকেও। অপ্রতিম বলেছিল ‘এমন একটা নিষ্প্রাণ সহবাস থেকে বেরিয়ে আসছ না কেন?’ অতসী হেসেছিল, চোখের জল মুছে বলেছিল– ‘অত সহজ হলে কত কিছুই পেরে যেতাম। পারছি কই?’ অতসী কম কথা বলত, ব্যবহারে বোঝানোর চেষ্টা করত… ওর একটা অবলম্বন দরকার। যেমন সব মানুষেরই দরকার হয়, সব প্রাণী… এমনকি উদ্ভিদেরও দরকার হয়। অপ্রতিম যদি ফিরিয়ে দেয়… ও চলে যাবে। কোনো জোর নেই। অপ্রতিমের ওপর কোনো জোর না খাটিয়েও এমন এক অধিকারবোধের জন্ম দিয়ে ফেলেছিল অতসী, যে অপ্রতিম নিজেই আর তার থেকে বেরোতে পারত না। ক্রমে কাঁধে মাথা, একসঙ্গে ভেজা, প্রথম চুমু, প্রথমবার একে অপরের কাছে নিজেদের মেলে ধরা… কোনো আড়াল না রেখে। অপ্রতিম নিজের ফ্ল্যাটেই ডেকেছিল। একবারের জন্যেও মনে হয় না কিছু অস্বাভাবিক, কিছু আরোপিত। যেন অনেক বছর পর রিলিফ পেলো দুটো মানুষ। তোলপাড় করা আদরের পরে, নিজেদের শ্বাস-প্রশ্বাসের ওঠা-নামা মাপল কিছুক্ষণ। তারপর অতসী চা করে আনল দুজনের জন্য। ততক্ষণে দুপুর গড়িয়ে সন্ধ্যে। অতসী ফিরে গেল গাড়ি বুক করে। নিজেকে খুব যত্ন করে ঠিক করে নিল আবার, ঠিক যেভাবে বেরিয়েছিল বাড়ি থেকে।
এরপরেও, শরীর কখনো নেশা হয়নি ওদের কাছে। অন্ততঃ অপ্রতিমের কাছে তো নয়ই। অতসীর জন্য একটা সফট কর্নার ছিল, যা অস্বীকার করতে পারত না। ছ-মাসের সম্পর্কও যে কত নিবিড় হতে পারে অতসী এসে বুঝিয়ে দিত। কম কথা বলত অতসী, কিন্তু ওর মত করে জড়িয়ে রাখতে আর কাউকে দেখেনি অপ্রতিম।
       কৃষাণুর সঙ্গে প্রথম যেদিন অতসীকে দেখল, চমকে গেছিল অপ্রতিম। কৃষাণু ওর বহুদিনের পরিচিত, তার সঙ্গে কী করছে অতসী? কলকাতার নাম করা শপিং মল, এসক্যালেটর দিয়ে উঠে মাল্টিপ্লেক্সের ভেতরে ঢুকে গেল দুজনে। পাশাপাশি দেখলে যে কেউ বুঝতে পারবে– দম্পতি। অফিসের গেট-টুগেদার বা ফ্যামিলি ডের মত কোনো অনুষ্ঠানে অনেকসময়েই সপরিবার কেউ কেউ আসেন। বিশেষ করে যারা একটু ওপরদিকের পদে আছেন। কৃষাণুর বিয়ে হওয়ার খবর পেলেও, কে স্ত্রী তাকে কেমন দেখতে সেসব জানার কৌতূহল দেখেয়নি। তারপর ক বছর জন্য অনসাইট চলে গেছিল অপ্রতিম। কৃষাণুও অন্য টীমে চলে যায়। সরাসরি অতসীকেই জিজ্ঞেস করেছিল অপ্রতিম, কৃষাণুকে কীভাবে চেনে। অতসীর মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে গেল, সেই প্রথম ওকে এমন বিস্ময়ে তাকাতে দেখল অপ্রতিম। বুঝতে পারল অতসী ধরা পড়ে গেছে। ‘এতদিন নিজের স্বামীর মিথ্যে পরিচয় দিয়েছিলে?’ কথাগুলো বলে ক্যাফের টেবিলে হেরে যাওয়া সেনাপতির মত মাথা নীচু করে বসে রইল অপ্রতিম। হাতদুটোও আত্মসমর্পণের ভঙ্গিতে সামনে প্রসারিত। অতসী এমনিতেই খুব কম কথা বলত, নিজেকে জাস্টিফাই করার চেষ্টা করল না। শুধু বলল, ‘কী হত আসল পরিচয় জেনে? সেই তো অবিশ্বাসই করতে একদিন।’ এইটুকু বলেই উঠে চলে গেল অতসী। সেই শেষ মুখোমুখি দেখা দুজনের। তারপর আর সেই অনিয়মিত দেখার দিনগুলো ফিরে আসেনি। হাতের মুঠোয় পালক নিয়ে থাকার অনুভূতিও আর আসেনি। ফিরে আসেনি হঠাৎ আদরের দুপুর-বিকেল-সন্ধ্যে।
অপ্রতিমকে সব দিক থেকে একা ফেলে চলে গেল অতসী। চলে যাওয়ার পর আরো বেশি করে বুঝিয়ে দিল, কীভাবে বেঁধে রেখেছিল ও অপ্রতিমকে। অতসী ধরা পড়ে গেছে, সেই অনুশোচনা ছিল না ওর। উলটে অপরাধবোধটা বাড়িয়ে দিয়ে গেল অপ্রতিমের মধ্যে। এমন একটা নিবিড় সম্পর্ক ছিন্ন করে দেওয়ার দায় যেন একা অপ্রতিমের। অতসীর স্বামির পরিচয় কী, তা এখানে অর্থহীন ছিল। জোর করে তাকে গুরুত্বপূর্ণ করে তুলল অপ্রতিম, নিজের নিরাপত্তাহীনতা অথবা মেল-ইগো থেকে। মনে হল– অপ্রতিম এতটাই পজেজিভ, যে অতসী যে ওর স্বামীর সঙ্গে কোথাও যাচ্ছে, এটাই সহ্য করতে পারল না। কী যায় আসে তার স্বামী কৃষাণু না অমৃতেন্দু না বিভাস না সব্যসাচী? একজন স্বামী আছে জেনেই তো হাত ধরেছিল অতসীর। তাহলে? অপ্রতিম বুঝতে পারছিল না ঠিক কী করবে, বা কী করা উচিৎ। কৃষাণুকে নিজে থেকে কিছু জিজ্ঞেস করার সাহস পেত না। মনে হত নিজেই অপরাধী। হয়ত প্রসঙ্গ এলে আরো অনেক মিথ্যে বেরিয়ে আসবে। কৃষাণু যদি ব্যাপারটা নিয়ে সিন ক্রিয়েট করে, অফিসে একটা বিচ্ছিরি ব্যাপার হবে। সবাই জানবে! নিতান্ত ভীরু কাপুরুষের মতই অপেক্ষা করত, যদি অতসী আবার যোগাযোগ করে। ক্ষমা চাইবে? না শেষবারের মত একবার দেখা করে নিজেদের মত করে পাড়ি দেবে নিজেদের পথে? কেনই বা অতসী কৃষাণুর নাম বলল না? ও কি তবে জানত যে অপ্রতিম কৃষাণুর পরিচিত, সিনিয়র কলীগ?
    অতসী নিজেই সব কিছু ছেড়ে বেরিয়ে গেল কৃষাণুর সংসার ছেড়ে। বাবা-মায়ের কাছেও গেল না, একা থাকল… সিংগল মাদার হওয়ার সিদ্ধান্ত নিল। ‘সিংগল মাদার’ প্রসঙ্গে যখন কৃষাণু নতুন করে কিছু বোঝানোর কথা ভাবল, তখনই অতসী প্রকাশ করল– সেই সন্তানের বাবা কৃষাণু নয়… অন্য কেউ। ঠিক সেই সময়ে কৃষাণু জানতে পারল অপ্রতিমের কথা। কেবলমাত্র অফিসে দুজনেরই নামে বাজের রকম স্ক্যান্ডেল হবে বলে দুজনকেই সংযত থাকতে হল, ঠান্ডা মাথায় এগোতে হল। অতসী তখন আর কারো নয়। সে কৃষাণুর সঙ্গে থাকতে পারবে না আর, আর অপ্রতিমের কাছেও যাবে না। দুজনের জীবন থেকেই সরে গেল অতসী। আর অপ্রতিম চিরকালের মত অপরাধী হয়ে থেকে গেল কৃষাণুর কাছে। অপ্রতিমদার মত মানুষ একজন অন্যের স্ত্রীয়ের সঙ্গে এত দিন গোপনে সম্পর্ক রেখেছে; আর কৃষাণুর স্ত্রী অতসী তার অজ্ঞাতেই যে পুরুষের কাছে আশ্রয় খুঁজেছে, সে আর কেউ নয়, অপ্রতিমদা!– এই দুটো সত্যই কৃষাণুর কাছে দুঃসহ হয়ে উঠেছিল। অতসী এমনিতেই কম কথা বলত, কোনো ঝগড়া বা কেচ্ছাকে প্রশ্রয় না দিয়ে চুপচাপ দূরে কোথাও চলে গেল একটুকরো অপ্রতিমকে নিজের সঙ্গে নিয়ে। অপ্রতিমের একটা অংশ চুরি করে নিয়ে চলে গেল চিরকালের মত অজ্ঞাতবাসে। একদিন হঠাৎ করেই মিলিয়ে গেল অপ্রতিমের জীবনের সিলোয়েট থেকে। অপ্রতিম যন্ত্রণা অনুভব করল, কিন্তু মরিয়া হয়ে তাকে খোঁজার তাগিদ অথবা পুরুষ কিংবা প্রেমিকের অধিকারবোধ অনুভব করল না। এমন অতসী যে আসন্ন সন্তানের উপস্থিতিকে পুঁজি করে স্বাধীনতা দাবী করেছিল, তার পিতৃত্ব প্রসঙ্গেও নিজেকে বিচলিত হতে দিল না অপ্রতিম। মনে হল, সেই অধিকার সে নিজেই হারিয়েছে এক বিকেলের শেষে। মনে হল, সেই স্বাধীনতাই অতসীর প্রাপ্য অধিকার। কোথাও একটা বদ্ধ ছিল ও, অপ্রতিমকে নির্ভর করে নিজের সেই মুক্তির পথ খুঁজে নিয়ে বেরিয়ে গেল। কৃষাণুর সঙ্গে অন্যায় করার অপরাধবোধ চাপা পড়ে যায়, সেই মুক্তির কথা চিন্তা করলে।
 অপ্রতিম আর কৃষাণু… দুজনেই পরে রইল নিজের শূন্য কুটীরে… পরাজিত সেনাপতির মত। তখন আর নিজেদের মধ্যে এই নিয়ে কথা কাটাকাটির করার মত বোকামি আর কিছু হতে পারে?
এতদিন পর হঠাৎই অতসীর মুখটা ভেসে উঠল চোখের সামনে, হাতের মুঠোয় মনে হল অতসীর হাত। টায়রা নয়, অতসী এসে হাঁটছে অপ্রতিমের সঙ্গে। চমকে উঠে টায়রার হাতটা ছেড়ে দিল অপ্রতিম।
(চলবে) 
© জয়দীপ চট্টোপাধ্যায়

অঙ্কন:  শাশ্বত বন্দ্যোপাধ্যায়


Comments

Popular posts from this blog

অনিন্দ্য সরকারের গুচ্ছ কবিতা : গান ছুঁয়ে ছুঁয়ে

অয়ন হালদারের পাঁচটি কবিতা

মুন্নী সেনের গুচ্ছ কবিতা : সম্বোধন