ভালো থেকো নিশীথ অবশেষ — পর্ব ৩ : জয়দীপ চট্টোপাধ্যায়
ভালো থেকো নিশীথ অবশেষ -- ৩য় পর্ব
এখানে আলাদা করে আমন্ত্রণ জানিয়ে কেউ কাউকে ডাকার নেই। ডিনারের টেবিল নেই আলাদা করে, বুফে সাজানোর ব্যবস্থা হচ্ছে মানেই ডিনারের সময় আসন্ন। দু একজন সচেতন মানুষ নিজেরাই প্লেট নিয়ে দুটো স্টার্টার তুলতে এগিয়ে গেছে। কেউ একহাতে বিয়ারের বোতল নিয়েই স্টার্টার তুলে নিয়ে খাওয়া শুরু করে দিয়েছে। দুটো মেয়ে সালাড নিয়ে বসে আছে, ভেজ স্টার্টারের অপেক্ষায়। ওরা ননভেজ খাবে না। টায়রাকে এগিয়ে আসতে দেখে ইচ্ছে করেই প্রাজক্তা গলার স্বর এক ধাপ তুলে বলল ‘ডিনার নেই করনি? কাঁহা গুম হো যাতে হো তুমলোগ!!’ ‘তুমলোগ’-এর মধ্যে টায়রার বন্ধুরা নয়, অপ্রতিম পড়ে– এটা বুঝেই অপ্রতিম তৎক্ষণাৎ উত্তর দিল, ‘আরে প্রাজক্তা… সারা সন্ধে পুল টেবিলে কাটিয়ে দিলে… আমাকে তো দেখতেই পেলে না!’ প্রাজক্তা মারাঠি… বাংলাটা টেনেই বলে। অপ্রতিমকে দেখে এতটুকু অপ্রস্তুত না হয়ে নিজের সপ্রতিভতা বজার রেখেই বলল, ‘আর কী দাদা! আপকে সারি লাইনে টায়রাকে সাথ ভেয়াস্ত থে… আমি বেচারী আর কী করতাম!’ ‘তাহলে এখন চলো… একসাথে কাবাবগুলোর অ্যাকসেপ্টেন্স টেস্ট করি… ডেজার্ট পে চর্চে করি!’, বলে প্রাজক্তাকে একরকম কনুইয়ের মাঝে হাত গলিয়েই বুফে টেবিলের দিকে নিয়ে চলে গেল অপ্রতিম। অদ্ভুত একটা হাসি নিয়ে তাকিয়ে রইল টায়রা সেদিকে। অপ্রতিমকে দেখলে কেমন মনে হয়– ভীষণ চেষ্টা করছে এত প্রাণোচ্ছল থাকার। নিজের সব সঞ্চিত শক্তি খরচ করে নিজেকে এমন রঙিন রাখছে... বিষণ্ণ একাকী অন্তরটা প্রকাশ করছে না কারোর সামনে। কেন মনে হয় এমন? শুধু টায়রারই কি মনে হয়?
অন্যমনস্ক হয়ে গেছিল, কেউ একজন প্রায় কাঁধে ধাক্কা দিয়ে চলে গেল রিসর্টের দিকে, বলতে শোনা গেল– ‘এই প্রত্যুষ আর রাগিনীর কী কেস রে? কোত্থাও নেই! কলও রিসিভ করছে না…’
মনে হল দোতলায় ওঠার সিঁড়ির দিকে গেল ওরা।
‘ওহ শিট! ইলেভেন মিসড কলস!’
প্রত্যুষের হাতটা নিজের পিঠের ওপর থেকে এক ঝটকায় সরিয়ে উঠে বসল রাগিনী। হালকা নেশা লাগা চোখে এদিক-ওদিক হাতড়ে খয়েরী ক্যামিজোলটা টেনে নিল। ক্যামিজোলটা পরে নিয়ে তারপরেও কাজ– প্যান্টিটা কোথায় আছে দেখা, ওপরের ফুল হাতা টপটা খোঁজা। জিনস্টা খোঁজা। এত সব কিছু খুঁজতে হবে ভেবেই মাথার ভেতরটা চক্কর দিয়ে উঠল। প্রত্যুষের আনা জিনিসটায় দারুণ নেশা হয়েছে। কোথা থেকে জুটিয়েছে খোঁজ নিতে হবে। এমন কিক আছে জানলে এখন খেত না রাগিনী। নীচে গেলে ঠিক লোকজন বুঝে যাবে। সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতেই পোশাক পরে নিল রাগিনী। দেখে নিল ঘরে কিছু ফেলে রেখেছে কি না, চোখে পড়ল না তেমন কিছু। প্রত্যুষ তখনো উলঙ্গ হয়ে উপুর হয়ে শুয়ে আছে খাটে। চোখ দুটো আধ বোঁজা। ক্লান্তি না আচ্ছন্ন বোঝা যাচ্ছে না। ওর পাছায় একটা লাথি মেরে রাগিনী বলল ‘কুত্তে… খুদকি ভি মারোয়ায় গা, অওর মেরা ভি! চল উঠ যা… কট লে জলদি সে!’ লাথি খেয়ে প্রত্যুষও আসতে আসতে উঠে বসল। তবে রাগিনীর মত অত বিচলিত হল না। এক চোখ বন্ধ করে আড়মোড়া ভাঙতে ভাঙতে হাতের ইশারায় ওকে আগে চলে যেতে বলল। রাগিনী এক ছুটে ঘরের দরজা খুলে বেরোল, তারপর চারপাশে তাকিয়ে দ্রুত সেদিক থেকে অন্যদিকে চলে গেল। সিঁড়ি দিয়ে লোকজন ওঠানামা করছে। ওদের চোখ বাঁচিয়ে বাইরে বেরিয়ে যেতে হবে একটা সুযোগ পেলেই!
রাগিনী চলে যাওয়ার পর প্রত্যুষ কয়েক মিনিট অপেক্ষা করে ধীরে সুস্থে পোশাক পরে ফেলল। তারপর বিছানাও টানটান করে দিল। ব্যবহৃত কনডমটা বাঁ হাতের বুড়ো আঙুল আর মধ্যমা দিয়ে তুলে নিয়ে টান মেরে ছুঁড়ে ফেলে দিল জানলার বাইরে। কোথায় পড়ল কে জানে… কারো মাথায় না পড়লেই হল! তারপর ঠোঁটের ফাঁকে একটা সিগারেট নিয়ে জ্বালাতে জ্বালাতে রাগিনীর মতই দেখল– কিছু ফেলে যাচ্ছে কি না। চোখে পড়ল না কিছু। ওয়ালেট আর মোবাইল ফোনও পকেটেই আছে। জ্যাকেটের হুডিটা মাথায় তুলে ঘর থেকে বেরিয়ে চাবি দিয়ে আবার লক করে দিল। তারপর চাবির রিং-টায় বাঁ হাতের তর্জনি গলিয়ে ঘোরাতে ঘোরাতে চলে গেল টেরাসে ওঠার সিঁড়ির দিকে। রাগিনী আগে মিশে যাক কলিগদের মস্তির মাঝে, কিছুক্ষণ পর প্রত্যুষও নেমে আসবে ওর নিজের গ্রুপের কাছে বিয়ারের বোতল হাতে। খোঁজ তো পড়েই গেছে এতক্ষণে ,পড়ুক গে!
রাগিনী ফিরে গেছে, কিন্তু যতটা সন্তর্পণে ভিড়ে মিশে যাবে ভেবেছিল, তা হয়ে ওঠেনি। দুজন নেই, তা লক্ষ করেছিল অনেকেই। তারা অপেক্ষা করছিল কখন রাগিনী ফেরে। অফিস কলীগদের মধ্যে ঠিক কলেজ-ছাত্রসুলভ ইয়ার্কি চলে না, তবে চোখের ইশারা, হাসিতে অনেক কিছু বুঝিয়ে দেওয়া যায়। সবাই প্রাপ্তবয়স্ক, স্বনির্ভর… সচেতনও ধরে নেওয়া যায়। কৃষাণুকে ঘর থেকে ডেকে নিয়ে এলো অভীক। ও নাকি ঘুমিয়ে পড়েছিল। ‘ঘুমিয়ে পড়েছিল’ শুনে অনেকেই একটু অবাক হয়ে তাকাচ্ছিল ওর দিকে। জিজ্ঞেস করছিল শরীর ঠিক আছে কি না। অপ্রতিম কিছু জিজ্ঞেস করল না, ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে দেখল ওকে কিচ্ছুক্ষণ। তারপর অভীককে একটু টেনে আলাদা করে নিয়ে গেল। দুজনেরই হাতে প্লেট। দুজনেই চামচ দিয়ে বিরিয়ানি-র রাইস খেতে খেতে কিছু কথা বলল... ঠোঁটের কোণে সৌজন্যের হাসি। কথার মাঝে মাঝে কৃষাণুকে দেখছিল দুজনেই। কৃষাণু ওদের দেখছিল না। চোখ লাল, বুকের বোতাম খোলা। মুখ দেখে বোঝা যাচ্ছে চোখে-মুখে জল দিয়েছে কিছুক্ষণ আগেই। জামাতেও জলের ছিটে, মাথার চুলও সামনের দিক আর কানের পাশে ভিজে। খাবারের প্লেটটা হাতে না ধরে, সামনের একটা মোড়ার ওপর রেখে খাচ্ছে আসতে আসতে। খাবারের দিকেই দৃষ্টি। আর কাউকে দেখছে না। অভীক শার্প ছেলে, কোম্পানীতে নতুন জয়েন করা কৃষাণুর মধ্যে যে স্পার্ক ছিল, তা অভীকের মধ্যেও দেখতে পায় অপ্রতিম। তবে অভীকদের সঙ্গে সরাসরি কাজ করার মত পদে আর নেই অপ্রতিম, ওপরে উঠে গেছে দু ধাপ। তবু, রেকমেন্ড করতে পারে, বিদেশের প্রোজেক্টে নামটা ঢুকিয়ে দেওয়ার মত প্রভাব ওর আছে। অভীকের মত অনেকের কাছেই অপ্রতিমদা ‘কিছু একটা’তো বটেই। কখন কীসে মানুষের ওপর খুশি হয়ে যায়, আর তথাস্তু করে দেয়। কূটীলতা নেই, অফিস পলিটিক্স নেই, ফেভার বা তোষামোদের প্রত্যাশাও নেই… তাও, কেমন দুটো-চারটে ভালো কথা বলেই কাজ বার করে নেয় লোকটা। লোকটাকে ‘না’ বলাও যায় না, বলতে ইচ্ছেও করে না। ‘না’ শুনলে ম্যানেজার স্থানীয় অনেকেরই চোয়াল চোয়াল শক্ত, অপ্রতিম শুধু বলে– ‘কোনো ব্যাপার না, বাদ দে’। হেসে চলে যায়। তবে অপ্রতিম একবার চলে গেলে, আর ফিরে আসে না। অভীক চায় না, অপ্রতিম এভাবে কোনো কারণে ওকে ‘বাদ দে’ বলে দিক ।
- কী হয়েছিল রে?
- ওই তো…
- না, ও ঘুমোয়নি। বমি করছিল? সেন্সলেস হয়ে গেছিল?
-
- কী রে?
- বমি না… বাট, ওই আর কি…
-
- সেন্সলেস মত হয়ে গেছিল।
- তুই ঘরে গিয়ে কী দেখলি?
- ওই… কেমন একটা হয়ে শুয়ে আছে… আলো নিভিয়ে। হাতটা ঝুলছে খাট থেকে। উপুড় হয়ে। আমি একটু ঘাবড়ে গেছিলাম দেখে।
- কিছু বলল?
-
- বলছিল কিছু?
- নেশার ঘোরে কি না জানি না… কাঁদছিল।
- এই তো বললি সেন্সলেস মত ছিল।
- না… মানে, ওইরকমই। কেমন ভাবে শুয়ে কাঁদছিল, অস্পষ্ট ভাবে কীসব বলছিল...
- কী বলছিল?
- আমি ঠিকঠাক বুঝতে পারিনি গো অপ্রতিমদা বিশ্বাস করো। এমনিতেই ভয়ে পেয়ে গেছিলাম অমন দেখে। উঠে বসিয়ে চোখে মুখে জল দিলাম। প্রত্যুষকে কল করে পেলাম না, ভিভানকে কল করে ডাকলাম।
অপ্রতিম কিছুক্ষণ একটা ঠোঁট টেপা কৌতুকের হাসি নিয়ে তাকিয়ে রইল অভীকের দিকে। তারপর বাঁ হাত দিয়ে পিঠে হালকা চাপড় মেরে বলল, ‘কোই নেই… বাদ দে।’
অপ্রতিম এমন ভাবেই হাসতে হাসতে কথাগুলো জিজ্ঞেস করছিল, কাছাকাছি কেউই বুঝতে পারবে না আলোচনার বিষয়… যতক্ষণ না কথাগুলো কানে যাচ্ছে, বা মনোযোগ দিয়ে লিপ-রিড করছে। অভীকের বুকের ভেতরটা কেঁপে উঠল এমন অপ্রত্যাশিত ভাবে ‘বাদ দে’ শুনে। কী করবে বুঝতে পারছিল না। তার ওপর যা শুনেছে, যতটুকু কথা কানে এসেছে… সে সব মনে পড়তেই কানটা কেমন লাল হয়ে উঠল টেনশনে। ওর অস্বস্তিটা আন্দাজ করেই একেবারে প্রসঙ্গ ঘুরিয়ে অপ্রতিম বলল, ‘ভিশাল সাখারে খুব ভালো অনসাইট লীড… যত পারিস ওর থেকে শেখ। বুঝলি?’ আউটিং-এ এসে টুকটাক কাজের প্রসঙ্গ বা অফিসের বিষয়ে কিছু কথা চলে আসে… কিন্তু অপ্রতিম ইচ্ছে করেই চেষ্টা করে অল্পবয়সীদের মাঝে সেসব না আনতে। নিজের বিরক্ত লাগত কম বয়সে খেতে খেতে এসব শুনতে। কথাগুলো শুনে অভীক বিশেষ অভয় পেল বলে মনে হল না। ওর চোখে এখনও বলছে ‘বিশ্বাস করো?’ অপ্রতিম কাঁটা চামচটা তুলে কেমন ‘চিয়ার্স’-এর মত একটা ভঙ্গি করে ওর পাশ দিয়ে দুলতে দুলতে একটা নির্দিষ্ট তালে পা ফেলতে ফেলতে এগিয়ে গেল ডেজার্টস-এর দিকে। টায়রা নিজের গ্রুপের মধ্যে থেকে পাখির মত একট্য সালাড, একটু বিরিয়ানি রাইস, একটু ডেজার্টে থাকা পুডিং ঠুকরে ঠুকরে খাচ্ছিল; আর খাওয়ার মাঝে মাঝে কৃষাণু, অপ্রতিম আর রাগিনীকে দেখছিল। কৃষাণুকে দেখেই বোঝা যায়– সামথিং ইজ রঙ উইথ হিম। কিন্তু কী হয়ে গেল হঠাৎ বুঝতে পারল না। কৃষাণুদা কখনোই পিকনিক বা আউটিং-এ এসে বেলাগাম মদ খায় না। আজও খায়নি। কী হয়েছে বুঝতে পারছিল না বলেই একটা অস্বস্তি হচ্ছিল ওকে দেখে টায়রার। জিজ্ঞেসও করল না গিয়ে। এতজনকে যা বলেছে, টায়রাকে তার থেকে আলাদা কিছু নিশ্চয়ই বলবে না। শুধু শুধু বিব্রত করা।
এতক্ষণে প্রত্যুষকে দেখা গেল। ভিভানের হেডফোন কানে নিয়ে কাউচে শুয়ে শুয়ে হাত তুলে নেচে যাচ্ছে ডিজে-দের মত ভঙ্গি করে। ঠোঁটে সিগারেট চেপে রাখা। ওকে ধরে কিছু না গেলালে খাবার খাবে না। আর খাবার খাওয়ার পর যে বমি করে সব বার করে দেবে না– তারও কোনো গ্যারান্টি নেই।
— — — —
- আরে!
- হাসছেন কেন?
- আমি সত্যিই বিশ্বাস করিনি যে তুমি আসবে
- কেন?
- জানি না… ভেবেছিলাম কাটিয়ে দেবে। আর কারণটা আন্ডারস্টুড।
- কেন কাটাব? কাটানোর হলে তখনই ‘না’ বলে দিতাম। আপনি কথা রেখেছেন, আমিও রেখেছি।
- তুমি নিশ্চিত?
- কেন? রাখেননি কথা? চাননি কথা রাখতে?
-
- মাঝে মাঝে ইচ্ছে হয়… কথা রাখতে। কেউ বুঝুক, জানুক– কথা রেখেছি… না?
-
- যাক গে...
- চলো।
- কোথায়?
- ওইদিকে একটা সুন্দর বড়ো দীঘি আছে, কালো টলটলে জল, চাঁদ ভাসছে কী সুন্দর!
- চাঁদ ধরতে গিয়ে কুকুর-তাড়া খাব না তো?
খুক করে একটা শব্দ করে চুপ করে গেল অপ্রতিম। জোরে হাসলে নিস্তব্ধতা খানখান হয়ে যাবে। সবাই যে যার রুমে ফিরে গেছে। টায়রা অপেক্ষা করছিল আউটহাউজের পাশে, যেমন কথা দিয়েছিল– একসাথে হাঁটতে যাবে ডিনারের পর। সিকিওরিটিকে একটু ম্যানেজ করে বেরোতে হবে গেট দিয়ে। অপ্রতিম আত্মবিশ্বাসী, ওটুকু ঠিক পেরে যাবে। কত কিছু ম্যানেজ করতে হয়েছে… এর থেকেও প্রতিকূল কত পরিস্থিতি!
- সত্যি অপ্রতিমদা, সাধারণ একটা গ্রামের পুকুর… অথচ কী সেরিন লাগছে!
- নৈসর্গিক মায়া!
- নৈসর্গিক মানে কী? স্বর্গীয়?
- না। প্রাকৃতিক বললেই হয়… অথচ নৈসর্গিক বললে মাঝে মাঝে শুনতে বেশি সুন্দর লাগে। হয়ত অজ্ঞাতে ‘স্বর্গ’-র কাছাকাছি একটা উচ্চারণ করে ফেলা হয় বলেই।
- স্বর্গীয়ই বলা যায় গো!
-
- কী হল?
- আখড়ায় দেখেছি… ওরা কত সহজে ‘তুমি’ ডাকতে পারে। কত আন্তরিক ভাবে।
- আপনি আখড়ায় থেকেছেন? মানে… বাউলদের আখড়ায়?
- হুম…
- বাহ্!
-
- আর?
- আর?... আর কোথায় কোথায় থেকেছি?
- হা হা হা… না, জানতে চাইলাম আর কী কী দেখেছেন আখড়ায়? অবশ্য দ্বিতীয় প্রশ্নটাও সঙ্গে থাক!
- অবসাদ, একাকীত্ব, ব্যর্থতা… প্রোলংড ফ্রাস্ট্রেশন… এইসব কিছুর এক দাগ করে হোমিওপ্যাথিক ওষুধের মত নিরাময় থাকে। অথচ, প্রতিকার জানা থাকলেও হাত-বাড়িয়ে সেই ওষুদের এক দাগ খেতে পারি না আমরা। এই দেখা, থাকা… যা-ই বলো… এগুলো আমার কাছে ওই এক দাগ হোমিওপ্যাথিক ওষুধের ডোজের মত। যখন প্রয়োজনেও পাই না… তখন কী যে কষ্ট হয়!...
- মানুষ বদলে যায়। মানুষকে বদলে দেয়।
- হুম।
- কিন্তু শুনেছি আঘাত না পেলে, কষ্ট না পেলে… মহৎ কিছুর জন্ম দেওয়া সম্ভব না। যেমন লেবার পেইন ছাড়া ডেলিভারি সম্ভব নয়।
- প্রসব বেদনা…
- হুম।
- আর আমাদের ক্ষেত্রে? আমরা তো পুরুষ। প্রসব বেদনার অনুভব সম্ভব নয়। তাহলে?
- ইকুইভ্যালেন্ট পেইন। কে বলতে পারে, কাকে কী ভাবে ভেতরে দুমড়ে-মুচড়ে দিচ্ছে একটা পিরিয়ডিক ক্রনিক পেইন?
- নাইস!
- মানে?
- আমার বেদনা, আমি নিয়ে এসেছি… মূল্য নাহি চাই, যে ভালোবেসেছি।
-
- কী?
- উঁহু… নাথিং।
- রাত এক অদ্ভুত আশ্রয় জানো? গভীর নিশীথে সব কিছু অন্যভাবে ধরা দেয়। খুব চেনা মানুষকেও অন্যভাবে চেনা যায়।
- আর অচেনা মানুষকে?
- ওই পুকুরটাকে দেখো… সকালেও দেখেছি, দুপুরেও, সন্ধ্যেবেলাতেও… সাধারণ গ্রাম্য পুকুর। কেউ স্নান করে, কেউ বাসন ধুতে আসে, কেউ ছিপ ফেলে বসে থাকে। সবুজ পানা ঢাকা জল সরিয়ে সরিয়ে পান্নাসবুজ টলটলে প্রশান্তি মুখ তুলে চায়। আর এখন দেখো… দেখছো?
- হুম! একটু সময় দিলে, আর অন্য রকম পরিবেশে খুব সাধারণ কিছুও কী অসাধারণ লাগে। কী সুন্দর মনে হয়!
- একটু সময় দিলে…
টুপ করে একটা শব্দ হল কিছু জলে পড়ার, হয়ত কোনো গাছের ফল, বা পাড়ে থাকা গাছের পাতায় ভারী হয়ে ওঠা শিশির-বিন্দু, অথবা কোনো ছোটো মাছ, ঘুম থেকে উঠে উঁকি দিয়ে গেল।
টলটল করে উঠল রুপোলী জ্যোৎস্না, ফটফটে পরিষ্কার দূষণমুক্ত আকাশ, আর নীলচে ধোঁয়ার মত মেঘের প্রতিবিম্ব। পানাগুলো কেমন সরে সরে গেছে মাঝে মাঝে খোপ খোপ ফাঁক রেখে। সেই ফাঁকগুলো ক্যানভাসের সেই অংশ, যেখানে ধরা দিয়েছে মহাকাশের ছায়া।
- এবার একটু শীত-শীত লাগছে… না?
- ফিরে আসতে চাইছ?
- মানে?
- শীত করছে? ভেতরে যাবে এবার? সত্যিই… রাতও হয়ে গেছে অনেক। তোমার কলীগ-বন্ধুরা অপেক্ষা করছে। এখনই ফোন করবে... দেখো।
কথাগুলো বলতেই একবার হাত-ঘড়িতে সময়টা দেখে নিল অপ্রতিম। এটা একটা নম্রভাবে সময় মনে করিয়ে দেওয়ার রীতি, যা অনেকক্ষেত্রেই সহজে অন্যজনকে বুঝিয়ে দেয়– আমাদের এই সাক্ষাৎকারের পর্যাপ্ত সময় ফুরিয়ে এসেছে। তবে টায়রা বিশেষ গুরুত্ব দিল না। কলীগদের উদ্বেগকে পরোয়া না করার মত একটা মুখভঙ্গি করে বলল– ‘করুক গে। ওরা কার সঙ্গে কী করছে আমি দেখতে যাচ্ছি? জিজ্ঞেস করছি?’
অপ্রতিম কিছুক্ষণ ওর দিকে তাকিয়ে রইল, তারপর মাথা নিচু করে পুকুরের জলে জ্যোৎস্নার আলো দেখতে দেখতে বলল– ‘অহেতুক জেদ, না আহত হলে… বুঝতে পারলাম না। যদি জেদ হয়, ভেবে দেখো’।
- আর আহত হলে? মানে… অফেন্ডেড হলে?
- অফেন্ডেড?
- হ্যাঁ?... অফেন্ডেড! আপনার কথায় এলাম, আর কথা ফুরিয়ে গেল বলে ঘড়ি দেখে ভাগিয়ে দিচ্ছেন… লেডিদের এভাবে ট্রিট করতে হয়?
- আচ্ছা, অফেন্ডেড… সেদিক থেকে ঠিকই। আর একটু সৌজন্যবোধ থাকা দরকার, আর একটু নম্রতা। কিন্তু একে রাত, তার ওপর বেজায়গা তো? মাঝে মাঝে ভেতরের সংস্কারও নড়েচড়ে বসে। সংস্কারবদ্ধ জীব আমরা টায়রা। মহাপুরুষও এর থেকে মুক্তি পায় না!
- চিন্তা করবেন না… ওরা কেউ কিছু বলবে না। আমার পার্সোনাল ব্যাপারে আনওয়ান্টেড খবরদারী আমি একেবারেই বর্দাস্ত করি না। পরিবারের লোক হলেও ঝাড় খায়! আর এরা তো!...
- এখানে কোনো বসার মত, বা ধাপেধাপে নেমে যাওয়া পুকুর-ঘাট নেই… থাকলে বেশ হত।
- স্মার্ট! কী সাটল্ ভাবে বেরিয়ে এলেন টপিকটা থেকে।
- হা হা… ওটাও অভিজ্ঞতা, অর্জন করতে হয়েছে। বাট আই মীন ইট… এটা তো পার্ক না, গ্রামের রাস্তা। হিমও পড়ছে… বুঝতে পারছি। পুকুরটা পুরো একটা পাক খেয়ে ফিরে আসি। না হয় একটু আসতে আসতেই হাঁটব… সময়টা একটু লম্বা হবে।
- একসাথে কাটানো সময়। আগে আপনি অ্যাক্সেপ্ট করুন, যে এটাও একরকম ডেট।
- তোমার কি ডেট-এর ব্যাপারে আলাদা রকম রোম্যান্টিসিজম বা ফ্যান্টাসি আছে? মানে স্পেশ্যাল কিছু মনে হয়?
- অফকোর্স? ডেট আর এমনি দেখা করা এক নাকি! ডেট ইজ অলওয়েজ স্পেশ্যাল।
- অভিসার… কত কিছু পালটে যায় সময়ের সঙ্গে।
- তা-ই নিয়ম। সেটাই এক্সপেক্টেড। তাই বলছি… এই যে পুকুর-পাড়ে দাঁড়িয়ে কথা বলছি। আসতে আসতে পথ চলে, মাঝে মাঝে থেমে… আবার চলতে শুরু করে… একটা ফুল সার্কল করে ফিরে আসা– এও এক ডেট। ডেটই বলব, ওটা নয়।
- ওটা মানে… অভিসার?
- হুম… ডেট শব্দটা অনেক হালকা। অভিসারের মধ্যে কেমন একটা…
- গোলাপী রঙের লজ্জা লেগে থাকে… না?
টায়রা কোনো উত্তর দিল না, মাথা নিচু করে দু-পা এগিয়ে গেল শিশিরভেজা পথ ধরে। পর্যাপ্ত আলো মুখে না পড়লে, হাসিটা আড়ালেই থাকবে। চোখের ভাষাও। কয়েক-পা চুপচাপই কেটে গেল দুজনের, কথা হল না। মাঝে মনে হল, এভাবে চুপচাপই হয়ত অনেকটা পথ চলা হয়ে যাবে, নীরবেই ফুরিয়ে যাবে ওদের এই একান্ত নিজস্ব সময়ের অধ্যায়। টায়রার প্রত্যাশা ছিল, অপেক্ষা করছিল এর পরে কী বলে অপ্রতিম … তা শোনার। কিন্তু নিজে থেকে কিছুই বলল না। মনে হল, অপ্রতিম যেন প্রসঙ্গ খুঁজে পাচ্ছে না। এতক্ষণ ধরে যে কথার-পিঠে-কথা চলছিল, সেই তালটাই কেটে গেল অন্য প্রসঙ্গ এসে। অপ্রতিম সরাসরি টায়রার দিকে তাকাচ্ছেও না আর, কখনো পথ, কখনো আকাশ, কখনো অন্ধকারে ঝুপসি হয়ে থাকা গাছপালার দিকে। এ যেন এক আশ্চর্য রকম অসহ্য নৈঃশব্দ্য! ঝিঁঝিঁর ডাক আর ওদের পদক্ষেপের চাপা শব্দ। ক্ষণিকের হলেও এই শব্দহীন পরিবেশ হঠাৎই যেন বাতাসকেও ভারী করে তুলেছে বলে মনে হল টায়রার। মনে হল, অপ্রতিমদার আসলে মন থেকে সেই ইচ্ছেটাই চলে গেছে একসঙ্গে কিছুক্ষণ সময় কাটানোর। যখন প্রস্তুতি নিল নিজেই সিরিয়াস ভাবে বলবে– ‘এবারে ফেরা যাক’, ঠিক তখনই কাছাকাছি কোনো পাখি ডেকে উঠল হঠাৎ… শিশুর কান্নার মত ককিয়ে ওঠা ডাক। দুজনেই চমকে উঠল সেই আকস্মিক শব্দে। কোনো পক্ষী শাবকের ডাক নয়, এক প্রজাতির পেঁচা– ডাকলে মনে হয় শিশু কাঁদছে। টায়রা চমকে গেছে দেখে অপ্রতিম বলল, ‘ও কিছু না… রাতজাগা কোনো পাখি। ভয় পেও না।’ টায়রা মনে মনে পাখিটাকে ধন্যবাদ দিয়ে একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল, তারপর বলল, ‘এতে ভয় পাওয়ার কী আছে? স্ট্রেঞ্জ!’
- না পেলে তো খুবই ভালো… পেঁচার ডাক। গাঁ-গঞ্জে খুবই কমন।
- পেঁচা? সে তো হুত-হুতুম করে ডাকে!
- হা হা হা… পেঁচার ডাক শুনেছ?
- না… মানে, ওই আর কি। টিভিতে, ওয়াইল্ড লাইফ ভিডিওতে…
- আমরা ছোটোবেলায় অনেকরকম পাখির ডাক শুনেছি। পেঁচা, তক্ষক, নানা রকম ব্যাঙ… এদের ডাকও। পেঁচা অনেক রকম হয়, আলাদা আলাদা ডাক।
- এমন ভাবে বলছেন ‘আমাদের ছোটোবেলায়’... যেন কত বছর আগের মানুষ! আপনি তো শহরেই বড়ো হয়েছেন আমাদের মত!
- ঠিক শহর না, শহরতলি… সেই সময়ের শহরতলি মানে মফস্বল। এখন আবার মফস্বল বললে শুনতে খারাপ লাগে লোকজনের!
- এবারে বেশি বেশি হয়ে যাচ্ছে অপ্রতিমদা… শহরতলি মোটেই মফস্বল না। ওকে?
- কেন… তুমিও কি মফস্বল… মানে শহরতলি নাকি?
- গ্রামে থাকি… গ্রামেই থাকি। আর তাতে আমার কোনো সমস্যা নেই। ঠিক আছে?
- তাও পেঁচার ডাক শুনতে হয় টিভি আর ওয়াইলড লাইফ ভিডিও দেখে… তাহলেই বোঝো, কেন বললাম ‘আমাদের সময়ে’।
- বেশি!
- না গো… সত্যিই ছোটোবেলাটা ভালো ছিল। যা কিছু নতুন দেখেছি, জেনেছি… বেশির ভাগ রঙিন স্মৃতি আর ভালো লাগা… সব ওই সময়টাতেই। কত দ্রুত পালটে গেল, পালটে যাচ্ছে সবকিছু। আমাদের ইচ্ছে বা পছন্দের ব্যাপার নেই… পালটে যাচ্ছে বলেই আমাদেরও…
- আপনার ভালো লাগে না?
- অ্যাঁ?
- আপনার এইসব কিছু… মানে এই মডার্ন সিটি লাইফ, তার ডিম্যান্ড, টিকে থাকার র্যাট রেস… ভালো লাগে না… না?
- কারোর কি লাগে?
- লাগে… অনেক অ্যাম্বিশ্যাস লোককে দেখেছি, রীতিমত ক্রিটিসাইজ করবে অন্যদের– যারা বেয়ার মিনিমাম নিয়ে স্যাটিসফায়েড আছে; কমফোর্ট জোন থেকে বেরোচ্ছে না। বাট, আপনাকে দেখে আগে এই ব্যাপারটা বুঝতে পারিনি।
- কখন বুঝলে?
- আজ… এখন… এখানে।
- দেখলে… বললাম না, নিশীথে সব কিছু অন্যভাবে ধরা দেয়?
- হুম… একটু সময় দিলে।
- তোমার তো বয়স কম… সবে এসেছ। তোমার অ্যাম্বিশন থাকা উচিৎ। আমাকে দেখে শিখো না। ভুগবে।
- প্লিজ অপ্রতিমদা… কেরিয়ার আর অফিসের কথা টেনে আনবেন না! তার চেয়ে সত্যিই ফিরে যাওয়া ভালো।
- তাহলে কীসের কথা বলব? পেঁচার কথা… রাতজাগা পাখির কথা?... না মফস্বলের কথা?
- আচ্ছা... আপনার নকটার্নাল অ্যানিমাল বললে প্রথম কীসের কথা মনে পড়ে?
( চলবে)
© জয়দীপ চট্টোপাধ্যায়
অঙ্কন: শাশ্বত বন্দ্যোপাধ্যায়
Comments
Post a Comment