আদিদেব মুখোপাধ্যায়ের গুচ্ছ কবিতা
চানঘরে গান রিডাক্স
অসুখী, অন্ধকার আত্মা; চান করার সময় নিজেকে যখন সাবান মাখাস, আবিষ্কার করিস যে কখনোই তুই এগুলো চিনতে পারিস নি! পেট দিয়ে, কোঁকড়ানো চুল দিয়ে চকচকে উরু আর লম্বা চুল দিয়ে ফেনা গড়িয়ে নামে, পায়ের কাছে জমা হয়–অনুগত পোষ্য ওরা, অল্প আঘাতেই সরে যাবে তাই আগে থাকতে কৃপা চাইছে মনিবের কাছে!
দুঃখী, হাড়-জিরজিরে আত্মা নিশ্চিত জানি ভেতরেই তোর বাস ... আঃ! তাও কেন তাকাচ্ছি আয়নার দিকে ? কেন দুজনেই মাথা নাড়ছি, ও আমার দিকে এবং আমি ওর দিকে চেয়ে ভাবছি এমন কোনও ভোর আসেনি বুকের দমবন্ধ পাথর সরিয়ে, কেউ গোর থেকে উঠে এসে বলেনি, "আমি মৃত্যুর পরের খবর জানি ! "
হতভাগা, সাবান মাখানো আত্মা; আমার পেচ্ছাবের জায়গাটা জ্বালা করে উঠছে, আমি ঐ চিড়চিড় ঢেউকে এখনও চিনতে পারি, ছোটো থেকেই ও আমায় ভয় দেখায়, চাপ দিলেই হিরের কুচি এসে পড়বে, ঝকঝক করবে পায়ের কাছে বরাবর জানি ওরা অভিশাপের চিহ্ন।
বিবর্ণ, ছালছাড়ানো আত্মা; রক্ত মুছে মুছে যাবি, নিজের রক্ত বারবার নিজেকেই মুছতে হবে, লোপাট করতে হবে। কুঁকড়ানো, হিংসুটে আত্মা; বাথরুমে মরে পড়ে থাকলে, রক্ত গড়াতে থাকলে, সাবানে রক্ত বিজবিজ করতে থাকলে শুধু চেয়ে থাকবি, শুধুই অলস চোখদুটো দিয়ে আর ডুবে যাবি অল্প অল্প পাপে শীতকাতর, ভিতুর ডিম আত্মা; বুড়বুড়ির মতো ভেসে থাকবি কিছুক্ষণ আর আস্তে আস্তে গলে যাবি নালা দিয়ে, ঝাঁঝরির ফুটো দিয়ে, গাঢ় স্বপ্নের গর্তগুলোর ভিতর
আরকিওলজি
এটা একটা শেষ হয়ে যাওয়া পাড়া, আমি রোজ এখানেই ফিরি, ফিরতে হয়, বেশ জানি থুরথুরে আমগাছটা ( যা আমগাছ না হয়ে জামগাছ হলে ক্ষতি কী ছিল ) আজও ঝুপসি হয়ে আছে আর সামনেই অন্ধকারে চারচৌকো আলো ... ওখানে একটা কলেজপড়ুয়া মেয়ে থাকে, আরো কারা যেন, একটা হাড়পাঁজর বুঝি ওই গ্রিলে টাঙানো রয়েছে, আরে, আমার নিজের ঘরটা কত উঁচু খেয়ালই করিনি, স্বর্গের দোতলা আমায় দয়া করে থাকতে দেয়, এখান থেকে চাঁদটাও খুব উজ্জ্বল .... ( ইডিয়ট ! আজও ! ) ... পুরোনো হরিণগুলোও ছাদের রেলিংয়ে ঘুমিয়ে রয়েছে, আর জাগবে না এই সেই পাড়া যেখানে তোমরা থাকো, গাবু থাকে, তার বউ থাকে, পাহারাদার থাকে, বাচ্চা হয়নি এমন কেউ ( কিংবা এমন কেউ নয়, আমারই ভুল ), আরো থাকে ঐ সবুজ জানলাটার মালিক, বেড়াল, কুকুর আর তাদের নাতিনাতনিরা .... এই গলিটা কীসের জন্য অপেক্ষা করছে ? রোজই আমি কান্নার শব্দ শুনতে পাই, সদ্য হওয়া বাচ্চা কাঁদছে, আর রঙও কারা ছুপিয়ে দেয় সাদা দেওয়ালে, না হলে শব্দ কেন ছুটোছুটির, হাসি আর চিৎকার কেন, তবে আমরাও অনেক দোল খেলতাম ... বছর ঘুরে যেত, পৃথিবী ঘুরে আসত আর নতুন রোদ্দুরে কিশলয় মানে কচি পাতা নড়ে উঠত আর জেগে উঠতাম একেকজন .. কিন্তু এসব না, এখন না, কেননা ... শশশ্ জমাট পাঁচিল, বোবা গেট, ( টেলিভিশনে কিছু চলছে ? ভাঙা হারমোনিয়ামে বেলো টানছে পাহারাদার ? শ্বাস, ফোঁপানি, আরেহ্ কী হল, আলো নিয়ে চলে যেও না, দাঁড়াও ! ... যখন দেওয়ালে এত বড়ো ছায়া আর ছায়ার চেয়েও আরো ব্যাপক এই দেওয়াল ..... যখন ভয় লাগছে , সারাজীবন একা থাকা, লাগা, ভয়, যখন একটা নষ্ট জিনিসও ফুরিয়ে যাচ্ছে, দাদু - ঠাকমারা ভ্যানিশ, মা - বাবারাই রয়েছে কেবল যারা যথাক্রমে হচ্ছে কঙ্কাল আর গম্বুজ . ( আগের মতো সাপখোপও অত আসে না , ছুঁচো না ব্যাঙ না শামুক না ) ঐ পায়ের শব্দ শুরু হল , এবার খসখসানি , ছুটে পালাচ্ছে ... কিন্তু কারা ? আর কেন ? আমগাছটা জামগাছ হলেও ক্ষতি কীই বা কিন্তু সে খুব ঝুপসি , ঘোলাটে আর ওখানেই সব কিছু বলা হয়ে গেছে টের পেলাম চাঁদটাকেও আস্তে আস্তে মেঘেরা খেয়ে নিচ্ছিল , কানা আকাশের তলায় আমি শুনলাম কেউ কাঁদছে , আহহ্ ওই বাচ্চাটা , ভাড়া থাকে ওরা , ওর মা হয়তো আমারই বয়সী , এটা একটা শেষ হয়ে যাওয়া পাড়া , এটা একটা শেষ হয়ে যাওয়া পাড়া , এটা একটা শেষ হয়ে যাওয়া পাড়া , কিন্তু তোমাদের কেন বলছি , তোমরা তো এই পাড়াতেই থাকো ... যেমন গাবু আর তার বউ , যেমন পাহারাদার আর বাচ্চা হয়নি এমন কেউ ( কিংবা এমন কেউ নয় ) , সবুজ জানলার মালিক , থুরথুরে আমগাছ , বোবা গেট , চারচৌকো আলো , টাঙানো হাড়পাঁজর , ঘুমন্ত হরিণগুলো , কুকুর , বেড়াল , তাদের নাতিনাতনিরা
শয়তানের কড়ি শোধ
ক্লান্ত , তিতিবিরক্ত , নির্বান্ধব । অলংকার ছাড়া কিছু লিখবার ক্ষমতা নেই । এখন সন্ধ্যেবেলা আর আমাকে অনেকগুলো ধাপ পেরোতে হবে বিছানা অবধি যেতে গেলে বাস , ট্রেন , টোটো , হাঁটাপথ ( গলি ) , কলিংবেল , দরজা , জুতোর র্যাক , মা বাবা , বাথরুম , সিঁড়ি । ... শেষতক নিজের ঘরে গিয়ে আয়নায় ঘামে ভেজা শীর্ণ আততায়ী . .. তার হাসি দেখে মুখ ফিরিয়ে নেওয়া , গ্লানি , অন্ধকার
বাস্তবে আর থাকতে চাই না । বরং গুহার কথা লিখব । বারবার দাঁত খুলে যায় , মাড়ির সঙ্গে বিপজ্জনক সম্পর্কে সে আছে , ঝুলছে , ঘুরিয়ে ফিরিয়ে ওটাই উপড়ে ফেলব বলে ঠাহর করেছি , সাদা ঘায়ে তন্তুতে ভরা জিভের উলটো দিক আর মুখব্যাদান ছাড়া জগতে কিছু নেই ... এই মাংসল চৌহদ্দিতে আটকে গেছি ... স্বপ্ন সর্বদাই সত্যির খুব কাছে থাকা চতুর মিথ্যুক।
উন্মাদের জগৎ । কী থেকে কী মনে আসবে জানি না । এর পর তুমি কী করবে , কোথায় যাবে ? – পিছুটান , কর্তব্য ন্যায় । মৃত্যুর পরও এমনকি কেউ সুস্থ নয় । যুক্তির পরিধি এখানে আটকে , জমে গেছে।
কষ্ট , রোগীর বিছানা কারো ঠান্ডা হাত । বড় কষ্ট । যা লিখবার নয় আমি খুব কষ্টে আছি । আজ সকাল , না , ভোর .... এখন আলো আসছে- যেন প্যাথোলজির রিপোর্ট !
আমার ভেতরে তোমরা নিশ্চুপে ধারাবাহিক জেগে উঠছিলে !
© আদিদেব মুখোপাধ্যায়
অঙ্কন: আদিদেব
Comments
Post a Comment