চারটি কবিতা : তমোঘ্ন মুখোপাধ্যায়
উতঙ্কের চোখ
তারপর সমস্ত ভার নামানোর দিন ঘনিয়ে এল,
ঘনিয়ে এল যতি। মুহূর্ত বিস্তারকামী স্বৈরিণী হয়ে
ছাতি লেহন করছে, জিভের ধাতব শরণে বুক কাঠ...
এই আশ্রমিক বালখিল্য সংযমের মেদ একগাছা চুলের
প্রকল্প হয়ে খসে গেল কাঠসংসারের সাথে।
আয়ু কাঁপছে। স্বতঃপ্রণোদিত।
কান্না উত্থানের অভিমুখে হাত বিছিয়ে ধ্বংস ঘিরতে এল
যে মেয়ে, তাকে বধমন্ত্র শেখাতে লোভ হয়। মারো এই
অপরিণামদর্শী অশ্রধারণের তাপ, মাংসগলনের প্রকোপ,
মারো সাহচর্যে, গার্হস্থে; হাত ফুটো করে জল মাটি স্পর্শের পর
হত্যা অসূয়ার ঘোড়া, তার গমনের আগে মারো। পদ্ধতি গান।
এবারে যৌবন ঘোষণা করে গুরুমুখ বায়ু হয়ে যাবে। উপলক্ষ্য স্মৃতি।
ছিল নিষ্ঠার পথ। তাকে কেটে, কায়া দিয়ে খসে যাচ্ছে গৌতমের হাড়।
দৃশ্যের বার্ধক্য ক্লীব। মন তাকে পেরোতে পারেনি।
আহুতি
ছিল জরাবাহক হাওয়া। পদার্থের ভিতর পদার্থ হয়ে আছে যে বিবাহ, তাকে সম্বল করে আমরা আনন্দ করছিলাম। এই দিনাতিপাত পূর্বসূরিদের সিদ্ধি স্মরণে রেখেছে, এই উল্লাস বলয়ের ভিতর আমাদের এমন ভেলকি দেখাতে থাকে মুহুর্মুহু, আলোর গমন নিয়ে সন্দেহের অবসর জোটে না। ছিল জরাবাহক হাওয়া। জনপদ থেকে সামান্য দূরে মন্দিরের ভিতর আত্মঘাতী হয়েছিল যে গর্ভবতী অনূঢ়া, তাকে ভুলিয়ে দেওয়ার জন্য কত কাঠখড় পোড়াতে হবে প্রজন্মের পর প্রজন্ম...! চিন্তা টের পাওয়ার আগেই অসুস্থতা ঘিরে ফেলছে মুখ। সুদের কারবার ছেড়ে বাঁশি ধরতে বলেছিল কেউ। উল্লাসের বলয়ে তাকে খুঁজে পাওয়া যায় না। সে-ই কি শুশ্রূষা জানত? তাকে বহুবার হত্যার পর সরলমতি জনস্রোত ঘরে ফিরে গেলে নাচমহল মুগ্ধ করে কম ব্যাভিচার তো হয়নি! অথচ সে প্রতি উৎসবে ফিরে আসে; জরাবাহক বায়ুর গন্ধের সাথে তার আলগোছ হাসি মিশে যায় ধীরে; ফিসফিস জাগে— “রাখালযুগ শুরু করুন কর্তা। বিলম্বে অনর্থ— সত্য এই!”
অথচ যে উৎসব ঘন হয়ে আছে চারপাশে, তার মধ্যে সুরা ও বেশ্যা, পায়রা ও তাস, নায়েব ও গোমস্তার কুশপুতুল, ফিটন গাড়ির আশনাই এমন কুম্ভীপাক, বাঁশি অব্দি নখরই গেল না। নহবতের লীলা বাজছে। শরীর লঘু হয়ে আসছে মৌতাতে। বিশাল চন্দ্রবলয়ের নীচে প্রস্তরসিংহের আড়ালে জরাবাহক হাওয়া, সেই আলুথালু পুরুষ আর সহজ দুহিতা মথিত হল সারারাত। এবারেও মন্দিরের হাতছানি এড়ানো যাবে না।
হিরণ্য কালিকামূর্তি। সামনে ফের আত্মঘাত; গর্ভিনীর দেহ। জরাবাহী হাওয়া তার বুকের আব্রু খায়, ভাসে...
নাচ
বিরল জন্মের নাচ মাথাগর্তে কৃতজ্ঞতাবশে
নামিয়ে দিয়েছ, আমি সন্ধানীর মুখোশ চাপিয়ে
গিয়েছি নিকটে যাতে মুদ্রানীতি টের পাই আর
তোমার হত্যায় কত স্নেহ থাকবে তাও বুঝে আসি।
মাথা গতি পায়, মাথা কবন্ধ অজাতশত্রু মেনে
পৃথগন্ন হতে থাকে; ভয়ে ও আসঙ্গে এই রূপ
বিরল জন্মের নাচ আয়ত্ত করার চেষ্টা করে।
তাকে খড়্গে ফেলে আজ কী লাভ? কী লাভ খড়্গ মুছে?
আলাদা আলাদা ভাবে প্রকৃতি বোঝার শ্রমে নামো।
বিরল নাচের জন্ম কীভাবে প্রত্যঙ্গ বায়ু ক’রে
অবয়ব বিষয়ক ধারণার পায়ু মেরে দেয়—
বোধে নাও, বোঝো কেউ কৃতজ্ঞ ছিল না কোনওদিন।
বরং অত্যাগক্রিয়া আরও আরও মুখোশ নির্মাণে
সন্ততি জড়াবে— ভাবো, এ-গার্হস্থ ঔপনিবেশিক?
ক্রমশ নাচের মধ্যে খুলে যেতে থাকে হত্যাপথ,
এগোতে গেলেও বৃত্ত, পিছোতে গেলেও বৃত্ত, ক্ষয়।
বিরল জন্মের নাচ মাথা থেকে পরার্থপরতা
ছিঁড়ে নিয়ে চলে যাচ্ছে। এই যাওয়া পূর্বনির্ধারিত...
বিকল্প
দ্যাখো শব্দগুলির চাপ। কে কার পাশে আবিষ্ট বসে আছে,
কে কার গরমে গলে যাওয়ার আগে শেষবারের মতো চিৎকার করে উঠছে—
“তাহলে এই বাদামি রঙের উদ্যানে আমরা পোশাক খুলে কী করছি?”
বুঝে ফেলার আগে, দ্যাখো শব্দগুলির চাপ। যে-কেউ যে-কোনও'র সাথে
সখ্যে নামল, প্রয়োজনীয় খুনের পর না তুমি দায় নেবে, না আমি।
আপাতত ভোজের তলায় মরিচ রঙের কসাইখানা— দেনা নেভানোর ভেড়া—
সামান্য তাকিয়ে দেখার মধ্যেই যেটুকু কোপানো সম্ভব...
বাদামি রঙের উদ্যানে পোশাক খুলে কী করা হয়, উদ্যানই বা বাদামি কেন—
এই সরলতার জন্য সময় বরাদ্দ নেই। বরং দ্যাখো শব্দগুলির ফাঁক।
পোকা চাটা আপেলের মতো সম্ভাবনাময়, যতক্ষণ একা।
শুশ্রূষার জন্য পরজীবী হবে, আর তাহলেই লীলা শেষ।
পোশাক ছিল আদৌ? নাকি চামড়া? নাকি গল্প? নাকি
উদ্যান ছিলই না প্রেক্ষাপটে, কসাইখানা ধোয়ার পর অমন লাগে!
দ্যাখো শব্দগুলির বুক। দাঁত শিরশির করছে। দাঁত। লালা। আস্তে কামড়াও।
পোকা ও আপেল দুই-ই তোমার হাঁ-মুখ ভালবাসে।
© তমোঘ্ন মুখোপাধ্যায়
অঙ্কন: শাশ্বত বন্দ্যোপাধ্যায়
Comments
Post a Comment