কবিতা-বিরোধী ফতোয়া ও বিরুদ্ধ-ফতোয়া : তন্ময় ভট্টাচার্য
কবিতা-বিরোধী ফতোয়া ও বিরুদ্ধ-ফতোয়া
সংবাদমাধ্যমে বা অন্যত্র মাঝেমধ্যেই চোখে পড়ে— ‘অনুভূতিতে আঘাত লাগায় অমুকের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের।’ বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তা ব্যক্তিগত নয়; সর্বজনীন কোনো-কিছু নিয়ে উষ্মাপ্রকাশ। মনে পড়ে ‘অনুভূতি’ শব্দটার বিকৃত রূপ ও বন্ধুদের হাসিঠাট্টাগুলো। আর এই আঘাত— কীভাবে এসে লাগে? কথায়-কথায় এত আহত হন কেন সকলে?
ইয়ার্কি ছেড়ে কাজের কথায় ফিরি। ধর্ম বা যৌনতা নিয়ে অনুভূতিতে আঘাত ও তা নিয়ে মামলা দায়ের এখন এ-দেশে জলভাত। রোজই কোনো-না-কোনো বিষয় নিয়ে এসব ঘটেই চলেছে। ভাগ্যের বিষয়, বাংলা কবিতার দিকে তেমন অভিযোগ খুব একটা ধেয়ে আসেনি। আসেনি কি? সাম্প্রতিক অতীতে শ্রীজাত-র একটি কবিতা নিয়ে আক্রোশ-আক্রমণ দেখেছি আমরা অনেকেই। মাসকয়েক আগে বাংলাদেশে সরকারি কর্মী হয়ে সরকারের বিরুদ্ধে কবিতা লেখায় চাকরি খোয়াতে হয়েছে রহমান হেনরীকে। গত অর্ধশতাব্দীতে বাংলাদেশে উদাহরণ হিসেবে পাব দাউদ হায়দারকে, কবিতায় ‘ধর্মীয় অনুভূতি’কে আঘাত দেওয়ার অপরাধে যিনি দেশছাড়া। আরেকটু পিছিয়ে গেলে হাংরি জেনারেশন— বিশেষত মলয় রায়চৌধুরী। এগুলো তাও বৃহৎ-আলোচিত বিষয়, যা প্রশাসন অবধি গড়িয়েছে। এর বাইরেও কত কবিতার উদাহরণ অতীতে-বর্তমানে রয়েছে, যা কাউকে-না-কাউকে আঘাত করেই চলেছে। আর-কিছুতে খাপ না খেলে, পাঠরুচি তথা মেধায় আঘাত। ফলাফল হিসেবে ট্রোলিং।
নির্দিষ্ট কয়েকজন কবির কবিতা বাদ দিলে, বাংলা কবিতার পাঠকসংখ্যা সীমিত। ফলে, বৃহত্তর সামাজিক প্রেক্ষিতে তা চট করে কারোর অনুভূতিতে ‘আঘাত’ দিয়ে বসে না। নয়তো, পড়তে-পড়তে এমন কত কবিতারই মুখোমুখি হয়েছি, যা নিয়ে বিভিন্ন বিভাগের ‘বাদী’রা তাঁদের মনমতো তর্ক জুড়ে বসতেই পারেন। বাংলার অনেক বিখ্যাত কবির তেমন কবিতা-পঙক্তি চাইলে তুলে আনতে পারি এই মুহূর্তেই। কিন্তু তা আমার উদ্দেশ্য নয়। বক্তব্য হল, কবিতাকে এমন কাঠগড়ায় গিয়ে দাঁড়াতে হবেই-বা কেন! কোনো শিল্পই পলিটিকাল কারেক্টনেসের দলিল নয়, হতে পারে না। সবদিক বাঁচিয়ে শিল্পচর্চা করতে গেলে, তা আপোস হয়। সিনেমা, ফটোগ্রাফি, গল্প-উপন্যাস, ছবি, গান, নাটক— ইত্যাদি শিল্পমাধ্যমের দর্শক/গুণগ্রাহী কবিতার তুলনায় বেশি হওয়ায়, ‘আহত’দের আক্রমণও এই-এই শিল্পগুলোর ওপরই নেমে আসে বেশি। কবিতা ‘অবহেলিত’ হয়ে এদিক থেকে খানিক নিশ্চিন্ত। কিন্তু পুরোপুরি স্বস্তি আছে কি? আইন-আদালত পর্যন্ত জল না-গড়াক, সামাজিক মাধ্যমে আক্রমণ কি সইতে হয় না কবিতাকেও? বছরকয়েক আগে, শঙ্খ ঘোষের ‘রাস্তা জুড়ে খড়্গ হাতে দাঁড়িয়ে আছে উন্নয়ন’ কবিতা-পঙক্তির বিপরীতে জনৈক রাজনৈতিক নেতার মূর্খ আস্ফালন ভুলিনি কেউই। তারপরও এসব ব্যতিক্রম, কেন-না বাংলা কবিতার পাঠক সীমিত। ফলে, ‘অনুভূতিতে আঘাত’ ও ধেয়ে-আসা আক্রমণের পরিমাণও তুলনায় অনেকটাই কম।
একটা কথা স্পষ্ট বোঝা দরকার, রাষ্ট্র সমাজ পরিবার ধর্ম সংবিধান আইন সভ্যতা ইত্যাদি কোনো-কিছুর মাপকাঠিতেই কবিতাকে বাঁধা যায় না। যাবতীয় গণ্ডি ও বেড়াজাল থেকে কবিতা মুক্ত। যা-খুশি লেখার স্বাধীনতা আছে একজন কবির; শিল্পের দেবতা তাঁকে সেই স্বাধীনতা দিয়েছেন। দিনশেষে বিবেচ্য শুধু এটাই— কবির সেই লেখা কবিতা হয়ে উঠল কিনা। যদি কবিতা না-হয়ে নিছক আক্রমণ বা বক্তব্যের গণ্ডিতে আটকে থাকে, মূল উচ্চারণের বাইরে ভিন্ন কোনো ব্যঞ্জনা না আনে যদি, তবে তা কবিতা হিসেবে ব্যর্থ। সেই লেখার সমালোচনা চলতে পারে, আক্রমণ নৈব নৈব চ। কোনো ভিক্টোরিয়ান মরালিটি বা সামাজিক মূল্যবোধের চশমা দিয়ে কবিতাকে দেখার ‘অভিভাবক’দের উপেক্ষা করার সময় এসেছে আমাদের।
এ-আর নতুন কথা কী! আমাদের এই বাংলা কবিতা তথা সাহিত্য বহু দশক আগেই প্রচলিত গণ্ডি ভেঙে বেরনোর নিদান দিয়েছে, আন্দোলন করেছে, সফলও হয়েছে। এ-লেখার উদ্দেশ্য সেসব চর্বিতচর্বণ নয়। সাম্প্রতিককালে আরেকটি ভয়ংকর ‘হুইপ’ দেখা দিচ্ছে(মূলত সামাজিক মাধ্যমকে কেন্দ্র করে), তা হল, কবিকে ‘আদর্শ মানব’ হতে হবে। কবি তাঁর কবিতায় একমাত্র তা-ই বলবেন, যা সমস্ত মূল্যবোধ বাঁচিয়ে চলে। কবিতা রচনাকালীন সময়ে কবির মনোজগতে পশ্বাচারের হাওয়া ঘোরাফেরা করলেও, কবিতায় বহিঃপ্রকাশ ঘটতে হবে সদাচারের। নইলেই তা সামাজিক অধিকার-স্বীকৃতি-সাম্যের মানদণ্ডে ফেলা হবে এবং আলোচনা-তর্কে দলবদ্ধভাবে এটাই প্রতিপন্ন করা হবে, মানুষ হিসেবে সেই কবি কত হীন। মোদ্দা কথা, বাংলা কবিতার কাকা-জ্যাঠাদের(লিঙ্গনিরপেক্ষ; কাকি-জ্যেঠি হলেই-বা ঠেকাচ্ছে কে) নির্দেশিত সবদিক বাঁচিয়ে-চলার পথই যেন একমাত্র গন্তব্য।
বলতে দ্বিধা নেই, কবিতার বহুমুখিতা ও সূক্ষ্মতাকে বিশ্লেষণ করতে বেশিরভাগ সময়েই ব্যর্থ হন তাঁরা। একরৈখিক চিন্তার দ্বারা চালিত হয়ে নীতিবোধের হাঁক পাড়েন। যে-বিচারে একজন ‘পুরুষ’ কবির তীব্র আশ্লেষধর্মী প্রেমের কবিতা হয়ে দাঁড়ায় নারী-স্বাধীনতার পরিপন্থী (বিপরীত লিঙ্গের কবিতার ক্ষেত্রে তত সোচ্চার কণ্ঠ চোখে পড়ে না; সোচ্চার হওয়ার যৌক্তিকতাও নেই)। সেইসব লাশকাটা ঘরের মালিকরা কবিতা নয়, তার মৃতদেহ নিয়ে বিশ্লেষণ করতে বসেন। নারী-স্বাধীনতা, কনসেন্ট, অধিকার খর্ব করা— ইত্যাদি বিচার যখন কবিতাপাঠের ভেতরে ঢুকে পড়ে, পাঠক সেই আবর্তেই আটকে যান। কবিতার মন অবধি পৌঁছতে পারেন না আর।
প্রশ্ন উঠতে পারে, যে কবিতার মনে ওই-ওই ‘পুরুষতান্ত্রিক’ বিষয়গুলি লুকিয়ে, তার মধ্যে প্রবেশের দরকারই-বা কী! বেশ তো, পাঠকের মননের সঙ্গে খাপ না-খেলে, স্বচ্ছন্দে এড়িয়ে যাওয়া যায়। দ্বিতীয়বার ফিরে না-পড়লেই হল। কিন্তু সেই কবিতার সূত্রে সমাজ তথা জাতির ক্ষতি সাধিত হতে পারে, অতএব আক্রমণ— এই প্রবণতা বালখিল্য মানসিকতারই উদাহরণ। পাশাপাশি, ‘অভিভাবক’ হয়ে কবিকে শোধনের চেষ্টাও ‘আপনি মোড়ল’গিরি বই কিছু নয়। এ-কথা কখনোই ভুললে চলবে না, কবিতা এই সমাজেরই প্রতিফলন। ব্যক্তিমানুষেরও। ফলে, ব্যক্তি তথা সমাজের দোষ-গুণ-ভালো-মন্দ সবকিছুই উপস্থিত থাকতে পারে কবিতায়। এবং সে-মাত্রার কোনো উচ্চসীমাও নেই। শুধু কবিতার ছদ্মবেশে নিছক অ্যাজেন্ডা-প্রকাশ হল কিনা, তা-ই একমাত্র বিবেচ্য।
সে-বিচার করবেন কে? সেইসব দীক্ষিত ও মুক্তমনা আধুনিক পাঠক, যাঁদের চোখে হাজার-একটা মানবাধিকারের ঠুলি পরানো নেই। নেই পূর্বনির্ধারিত গোঁড়ামি ও ধ্যানধারণার মাইক্রোস্কোপ। মনে পড়ছে, কলকাতার এক বিখ্যাত সমাজকর্মীর সঙ্গে এক আড্ডায় এ-নিয়ে তর্ক হয়েছিল আমার। তিনি বাংলা কবিতার পাঠক নন। দু-একজন সেলিব্রিটি-কবির কিছু কবিতা পড়েছেন মাত্র। কোন-এক কবিতার প্রসঙ্গে ব্যক্তি-অধিকার নারীসাম্য পুরুষতান্ত্রিকতা ইত্যাদি কথা তুলেছিলেন। তাঁর প্রতি আমার বক্তব্য ছিল স্পষ্ট— ‘আপনার পছন্দ না-হলে পড়বেন না দ্বিতীয়বার, এড়িয়ে যাবেন। কিন্তু এমন কবিতা লেখা হচ্ছে কেন, এমন কবিতার বিরুদ্ধে কথা বলা উচিত— এইসব বলে কবিতার কণ্ঠরোধের কোনো যুক্তিই নেই।’
এ-কথা সত্যি, কবির সামাজিক কর্তব্য আছে কিছু-কিছু। আবার নেইও। সমাজ যখন জগদ্দল-পুরুষতান্ত্রিকতা থেকে ধীর পায়ে সরার চেষ্টা করছে, একজন অনুভূতিপ্রবণ মানুষ হিসেবে কবির কর্তব্য তাঁর কবিতার মাধ্যমে সেই অগ্রগতিতে সহযোগিতা করা। কর্তব্য আর দায় এক জিনিস নয়। কবিতার বহিঃপ্রকাশ যদি ভিন্ন পথে ধাবিত হয়, তাহলে জোর করে ‘প্রগতিশীলতা’র ভড়ং করা আসলে শিল্পকেই ঠকানো।
তাহলে কি কবি ‘কবিতা’র অজুহাতে যা-খুশি লেখার লাইসেন্স পেয়ে যাচ্ছেন? তিনি কি ধর্ষণ, শ্লীলতাহানি, খুন, গার্হস্থ্য হিংসা কিংবা পুরুষতান্ত্রিকতাকে কবিতার বর্মে সমর্থন করতে পারেন? এই ভাবনার কাছে এসে ঠেক খাচ্ছি আমিও। কবিতায় কি এইসব বিষয় উঠে আসা অনুচিত? নাকি, উঠে এলেও, অপরাধী হিসেবে কবি নিজেকে উপস্থাপিত করছেন কিনা, তা-ই বিচার্য?
এর উত্তর খোঁজার আগে আরেক দিকে উঁকি দিতে হবে আমাদের। কবি কি কবিতায় সবসময় নিজেকেই লিখবেন? তেমনটাই সচরাচর ধরে নিই আমরা। পাঠকের কাছে এ-ও স্পষ্ট হয়ে যাওয়া দরকার যে, কবিতায় লিখিত ‘আমি’ সবসময় স্বয়ং কবিই নন। সেই ‘আমি’ হতে পারে রাম-শ্যাম-রহিম-করিম যে-কেউ। সেই চরিত্রের মধ্যে প্রবেশ করে, সেই চরিত্রকে অনুভব করে উত্তমপুরুষে কবিতা লিখলেই যে সেই চরিত্রের দোষ-গুণ ব্যক্তি-কবির মনোজগতেও উপস্থিত থাকবে, সে-ধারণা অতিসরলীকরণ। কবিও কখনও-কখনও অভিনেতা বইকি! একজন অভিনেতা যেমন বিভিন্ন চরিত্রে খুন ধর্ষণ রাহাজানি ইত্যাদির অভিনয় করেন, অথচ সেই অভিনেতা নিজেও খুনি বা ধর্ষক নন, চরিত্রটিকে বিশ্বাসযোগ্য করে তুলতেই অভিনেতার চেষ্টা থাকে আপ্রাণ— কবিও অনেকক্ষেত্রে ঠিক তেমনই। কোনো-একটি সিনেমার ‘টক্সিসিটি’ নিয়ে অভিযোগ হতে পারে(সাম্প্রতিক অতীতে উদাহরণ ‘কবীর সিং’), কিন্তু তা থেকে এমন দাবি কখনোই করা যায় না যে, তা সম্পূর্ণ কল্পিত, বাস্তবে তেমন কোনো উদাহরণই নেই। অভিনেতাটি, ব্যক্তি হিসেবে সেই ‘টক্সিসিটি’র ঘোর বিরোধী হয়েও চরিত্রের খাতিরে, নিজের শিল্পের খাতিরে(শিল্প কখনোই একতরফা বা ফুলেল নয়, অজস্র কাঁটাও থাকে বিপরীতে) তাতে ডুব দিতে পারেন। কবির কোনো কবিতাও হতে পারে তেমনই। এদিকে, সিনেমার ক্ষেত্রে প্রায়ই শোনা যায়, অমুক সিনেমা যদি বাস্তবের প্রতিফলনও হয়, প্রচার ও উদযাপনের ফলে সমাজের মনে কুপ্রভাব পড়বে। সেই সিনেমা দেখে কেউ নেতিবাচক পথে এগোতেও পারে। অতএব, সেই সিনেমাকে সমাজ থেকে দূরে রাখা হোক। —সিনেমার মতো কবিতার বিস্তৃত জনসংযোগী-ক্ষমতা নেই। তারপরেও, যদি কেউ অভিযোগ তোলেন, কবিতাও তো সমান টক্সিসিটির ছাপ ফেলতে পারে কারোর মনে, অতএব বয়কট— কী উত্তর দেবেন, পাঠক?
উত্তর হতে পারে এটাই যে, সিনেমা হোক বা কবিতা— তার অন্যান্য যাবতীয় ঝুঁকি মাথায় রেখেও বলা যেতে পারে, তা আপনাকে আত্মদর্শন করাবে। নিজের মধ্যে যদি সেই-সেই বদগুণের কণামাত্র খুঁজে পান, যা সিনেমা বা কবিতার সূত্রে চেনা গেল এবং ঘৃণা জন্মাল নিজের প্রতি, তা শোধরানোর সুযোগ গ্রহণ করা। যে-কোনো সার্থক কবিতাই, সমাজদর্শনের পাশাপাশি যে আত্মদর্শনও ঘটায়, তা কে না জানে!
যে কথা বলছিলাম। কবিতার ‘আমি’ যে সবসময় কবি স্বয়ং হবেন, তার কোনো মানে নেই। আবার, কবিতার ‘তুমি’ বা ‘সে’-ও হতে পারেন কবি নিজেই। এইসব খেলা ও খেলা ভাঙার খেলাই প্রাণবন্ত করে তোলে কবিতাকে। অনেকক্ষেত্রে দেখি, কবিতা পড়ে, কবিতা দিয়ে ব্যক্তি-কবিকে বিচারের চেষ্টা করা হয়। এই প্রবণতা যে কতখানি বিপজ্জনক, বলাই বাহুল্য। কবিতা-রচনাকালীন সময়ে কবির মনোজগতে কোন আলোছায়া খেলা করছিল, তা দিয়ে সার্বিকভাবে মানুষটিকে চটজলদি বিচার করা মূর্খতারই পরিচয়। উভয়ে এক হতেও পারেন, না-ও হতে পারেন। অবশ্য মব লিঞ্চিং-এর রস নিতে চাওয়া জনগণ কবেই-বা এতসব ভাবনাচিন্তার ধার ধেরেছে!
খানিক অন্য প্রসঙ্গে আসি। কবিতায় যৌনতার উপস্থিতিকে আজকের পাঠক কীভাবে দেখেন? পাঠক সেইসব ছুঁতমার্গ থেকে মুক্ত হতে পেরেছেন কি? মনে পড়ছে ১৯৬৫ সালে হাংরি জেনারেশনকে কেন্দ্র করে আদালতে সওয়াল-জবাবের কথা। মলয় রায়চৌধুরীর ‘প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার’ কবিতাটি নিয়ে, সরকারপক্ষের উকিল বিভিন্ন সাক্ষীকে(সাহিত্যিকই বেশি) জিজ্ঞেস করেছিলেন, কবিতাটি পড়ে তাঁদের যৌন অনুভূতি জেগেছে কিনা। প্রায় সব সাক্ষীরই উত্তর ছিল— ‘না।’ ওই প্রশ্নটির প্রতিই আমার আপত্তি। যদি কোনো কবিতা পড়ে কারোর যৌন-অনুভূতি জেগেই থাকে, তাতে অসুবিধা কোথায়! যদি প্রেম জাগতে পারে, ভালোবাসা, বিদ্রোহ, স্বদেশচিন্তা ইত্যাদি; যৌন-অনুভূতি জাগলেই মহাভারত অশুদ্ধ? কবিতা কি তাহলে নপুংসক— অন্যের ভেতরে যৌন অনুভূতিও জাগাতে পারে না? বাকিদের কথা জানি না, নিজের ক্ষেত্রে বলতে পারি— কোনো-কোনো কবিতা পড়ে আমার যৌন অনুভূতি জেগেছে বইকি! নিছক উত্তেজক শব্দব্যবহারের জন্য নয়; সামগ্রিক কবিতার আবেশই জাগিয়েছে সেই অনুভূতি। কখনও আবার কোনো কবিতা লিখতে-লিখতেও উঁকি দিয়ে গেছে আশ্চর্য যৌন শিহরন। কবিতার সঙ্গে শরীরের এই অপূর্ব সম্পর্কে ভালোলাগায় ভরে গেছি আমি। কবিতা যদি কাউকে রাগাতে পারে, কাঁদাতে পারে, তাহলে যৌন উদ্দীপনাও জাগাতে পারে— এ-বিষয়ে আমার মধ্যে সংশয় নেই কোনো।
তবে, ষাটের দশকের পাঠকের গড় মানসিকতা এখন অনেকটাই বদলেছে। কবিতায় যৌনতার উপস্থিতি কেন— ইত্যাদি নিয়ে কেউ শোরগোল তোলে না সচরাচর। তার অবশ্য কারণও আছে। এক, বাংলা কবিতার পাঠকসংখ্যা খুবই কম, আর যাঁরা পড়েন, তাঁদের বেশিরভাগই এ-জাতীয় ছুঁৎমার্গ থেকে মুক্ত। দ্বিতীয়ত, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে, বহু বিকল্প ও ভিস্যুয়াল ইন্টারপ্রিটেশনে অভ্যস্ত হয়ে, বাংলা কবিতায় যৌনতার উপস্থিতি এখন শিশুতোষ লাগে। তারপরেও, কোনো-কোনো কবিতায় শব্দের অনুপযুক্ত ও কাঁচা ব্যবহারে যৌনতার আবহ আনার চেষ্টা বিরক্তি জাগায়; অবশ্য তার পিছনে ছুঁৎমার্গের ভূমিকা নেই, রয়েছে কবির ‘সেনসেশনাল’ কবিতা লেখার হাস্যকর চেষ্টার প্রতি সমালোচনা।
একেবারে শেষে, ধর্ম-সংক্রান্ত দু-চারটে কথা বলে এই গদ্যের ইতি টানা যাক। আমাদের বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে চোখ রাখলে দেখতে পাব, আধুনিক যুগের সূচনা যে-কালপর্বকে ধরা হয়, অর্থাৎ ভারতচন্দ্রের ‘অন্নদামঙ্গল’, ততদূর পর্যন্ত স্পষ্টভাবে এই চিহ্নই উঠে আসে যে— বাংলার কাব্যচর্চা মূলত বেড়ে উঠেছে ধর্মীয় প্রেক্ষাপট ও অনুষঙ্গ নিয়েই। সে চর্যাপদ হোক, বৈষ্ণব সাহিত্য, পদাবলি-সাহিত্য কিংবা শাক্তসাহিত্য, মঙ্গলকাব্য— ধর্মীয় আবহ ও ধর্মপ্রচারই সেখানে মুখ্য। উনিশ শতকের মাঝামাঝি থেকে, বাংলা কাব্যচর্চার সে-রূপ বদলাতে শুরু করে। কবিতা বেরিয়ে আসে ধর্মপ্রচারের দায় থেকে। দায়মুক্ত হলেও, আবহমানতার উত্তরাধিকার হিসেবে, ধর্মীয় প্রসঙ্গ, অনুষঙ্গ বা রূপক কবিতার হাত ছাড়েনি কখনোই।
ছাড়বেই-বা কেন! ধর্মকে বর্তমানের উগ্র আতশকাচ থেকে সরিয়ে দেখলে চিরন্তন হিসেবে যা পড়ে থাকে, তা হল সংস্কৃতি। আধুনিক বাংলা কবিতা সেই সংস্কৃতিকেই ধারণ করে এগিয়ে চলেছে। ধর্মপ্রচার তার উদ্দেশ্য নয় আর, উদ্দেশ্য হল সেই সংস্কৃতির আবহে কবিতার ও আত্মার পুনরাবিষ্কার, পুনর্নির্মাণ। তার জন্য কবিকে ধার্মিক হতে হবে, তেমন কোনো কথা নেই। একজন নাস্তিকও সেই সংস্কৃতির উত্তরাধিকারী। তিনি ঈশ্বরে বিশ্বাস না-ই রাখতে পারেন, ফুৎকারে উড়িয়ে দিতে পারেন পৌত্তলিকতা ও যাবতীয় গোঁড়ামি, কিন্তু ধর্মকে কেন্দ্র করে বেড়ে-ওঠা আচার ও সংস্কৃতি, যা বাঙালির সমাজজীবনের অঙ্গ(হিন্দু-মুসলমান উভয়ের ক্ষেত্রেই), তাকে অস্বীকার করা মানে সমাজবিচ্ছিন্ন হওয়া। আবার, ধর্মের সূত্র ধরে দর্শনচর্চার প্রেক্ষিতও অস্বীকার করতে পারবেন না কেউই। সব মিলিয়ে, ধর্মপ্রচার নয়, আধুনিক বাংলা কবিতার একটি ধারা ধর্মীয় সংস্কৃতি ও অনুষঙ্গকে ‘বন্ধু’ করে এগিয়ে চলেছে। এবং তা উদ্দেশ্যপ্রণোদিতও নয়, সেই বীজ তার আত্মার ভেতরেই লুকিয়ে।
তারপরেও, কোনো-কোনো কবি চিহ্নিত হয়ে যান ‘মৌলবাদী’ হিসেবে। বলা হয়, ধর্মপ্রচারই তাঁর কবিতার মূল উদ্দেশ্য। এ-কথা খেয়াল থাকে না যে, কবি হয়তো তাঁর নিজের পরিপার্শ্বের কথাই লিখছেন। আর, কবি যদি ঈশ্বরবিশ্বাসীও হন, তাতেই-বা ক্ষতি কী! বিংশ শতাব্দীর একটা দীর্ঘ সময়কাল ধরে বাংলার বহু কবি বামপন্থার আদর্শে দীক্ষিত হওয়ায় একটা স্বাভাবিক ধারণা জন্মে গেছে এই যে, কারো কবিতায় ধর্মীয় অনুষঙ্গ এলেই তিনি মুক্তমনা নন। এ-ধারণা যে কতখানি ভুল, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। কবিতার মাধ্যমে সংস্কৃতির রিক্রিয়েশন বা সুলুকসন্ধান, যা কবির ব্যক্তি-আবহমানতারও অংশ— তাকে ধর্মপ্রচারের আওতায় এনে ফেললে বোকামিই হবে। অবশ্য কেউ-কেউ উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে প্রচারভঙ্গিতেই কবিতা লেখেন। তাতেই-বা দোষ কী! বাংলা কবিতার হাজার বছরের ইতিহাস দেখলে, আটশো বছর ধরে তো তা-ই হয়ে এসেছে! প্রশ্ন উঠতে পারে, একুশ শতকে দাঁড়িয়ে, ধর্মকেন্দ্রিক এত জটিলতার মধ্যে ধর্মকে তোল্লাই দেওয়া কতটা যুক্তিযুক্ত। সাধারণভাবে বলা যায়— না, কবিতার আড়ালে ধর্মপ্রচার করা অনুচিত। ধর্মীয় ভেদাভেদমুক্ত এক পৃথিবীর দিকে এগনোই সার্বিকভাবে মানবজাতির লক্ষ্য। কিন্তু তা যদি না-ও করেন কোনো কবি, তাঁকে দোষ দেওয়া যায় না। কেন-না, সমাজ সেই মানবিক অবস্থানের থেকে শতহস্ত দূরে আজও। কবি কি সমাজবিচ্ছিন্ন কেউ?
আবার, বিভিন্ন কবিতা পড়তে-পড়তে এমন কিছু চিহ্ন বা নজির দেখি, যাতে ধর্মকে উপেক্ষা করার সুর উপস্থিত। কখনও-বা ব্যঙ্গও। কবিতা হিসেবে সেগুলি চূড়ান্ত সার্থক। দীক্ষিত পাঠক ওসব নিয়ে ভাববেন না, কবিতার রসই নেবেন শুধুমাত্র। শুধু ধর্ম কেন, যা-কিছু প্রতিষ্ঠিত জড়তাকেই অবমাননা করার অধিকার রয়েছে কবিতার। কবি একটি মাধ্যমমাত্র, আসল অস্ত্র কবিতাই। আরও ভালো করে বললে, ভাষা। কিন্তু ভয় হয়, গোঁড়া মৌলবাদীদের হাতে এসব কবিতা কেমন আপ্যায়ন পাবে, তা ভেবে। কেন-না যাঁরা মৌলবাদের চূড়ায় বাস করেন, তাঁরা কবিতার বক্তব্য কাব্যগুণ কবির স্বাধীনতা ইত্যাদি বোঝেন না, বুঝতে চানও না। নিজেদের সুবিধার মতো কবিতার(বা যে-কোনো শিল্পেরই) একরৈখিক অর্থ দাঁড় করিয়ে নেমে আসেন আক্রমণে। উপমহাদেশের বর্তমান পরিস্থিতি দেখে ভয় হয়, বাংলা কবিতা না-জানি কোনদিন সেইসব আক্রমণের শিকার হয়!
কবিতায় রাজনীতির উপস্থিতি ও তা নিয়ে রাজনীতিবিদদের চোখরাঙানি এ-আলোচনার বাইরেই থাক। নজরুল ইসলাম থেকে শুরু করে সাম্প্রতিককালে অনেক কবিই রাজনীতিবিদদের আক্রমণের শিকার হয়েছেন। তা কবিতার কারণেই হোক বা শাসক-ঘনিষ্ঠতার কারণে। এই প্রসঙ্গে, অন্য খাতেও আলোচনা দীর্ঘায়িত করা যায়। একজন কবি কেন অমুক বিষয় নিয়ে কবিতা লিখলেন না— একশ্রেণির জনগণের এমন অভিযোগ ও আক্রমণের আড়ালেও লুকিয়ে ফতোয়া— না-লিখলে আপনাকে আমরা গ্রাহ্যের মধ্যেই আনব না আর। আপনার কবিসত্তা ততক্ষণ মৃত, যতক্ষণ-না আমাদের দাবিমতো বিষয় নিয়ে কবিতা লিখছেন। এই শ্রেণির জনগণের ভিড়ে কবিতার তন্নিষ্ঠ কিছু পাঠককেও দেখেছি। তাঁরা কবির রাজনৈতিক ‘একচোখোমি’-র সমালোচনা করতেই পারেন। কিন্তু সমালোচনা ও আক্রমণের মধ্যে যে ক্ষীণ বিভেদরেখা, তা মুছে যায় প্রায়ই। এ-সমস্যা শুধু শিল্পের ক্ষেত্রে নয়, সবক্ষেত্রেই। অন্যদিকে, কবি যখন শাসকের পাশে গিয়ে তার সুরে সুর মেলান, কবিপরিচয়ের অধিকারে মঞ্চে উপস্থিত হলেও, সেখানে তিনি শাসকের সমর্থকমাত্র। একজন কবির মূল কবিসত্তা লুকিয়ে তাঁর লেখা ও লেখা-প্রস্তুতির সময়টুকুতে। সবসময় ব্যক্তিজীবনের সঙ্গে কবিসত্তার সামঞ্জস্য খুঁজতে গেলে মুশকিল। আবার, কবি যদি স্বেচ্ছায় রাজনীতির আঙিনায় হাজির হয়ে নিজের কবিসত্তাকেই ‘পণ্য’ হিসেবে তুলে ধরেন, তখন অবস্থানভেদে আক্রমণ নেমে এলেই-বা দোষ দিই কী করে! কবি তো নিজেই তখন ব্যক্তি ও কবিসত্তাকে একাকার করে দিয়েছেন! একুশ শতাব্দীর জটিল আবর্তে দাঁড়িয়ে, মাত্রাজ্ঞানের থেকে বড়ো চ্যালেঞ্জ বোধকরি আর কিছুই নেই আমাদের সামনে।
সব শেষে এ-কথাই বলার, বিভিন্ন সময় বিভিন্ন অদৃশ্য প্রতিবন্ধকতার সামনে পড়েছে কবিতা, ভবিষ্যতেও পড়বে। কখনও ‘সমাজওয়ালা’দের রক্তচক্ষু, কখনও মৌলবাদীদের তলোয়ার, কখনও আবার রাজনীতিকদের তর্জনী— বাংলা কবিতাকে ত্রস্ত করার চেষ্টা করবে বারবার। এই সমস্তকিছুকে অগ্রাহ্য করে, একজন লিখিয়ের কাজ হোক শুধুমাত্র কবিতা-রচনার মুহূর্তে নিজের চিন্তার কাছে সৎ থাকা। সেই চিন্তা যদি সোনায় বাঁধানো হয় তো হোক, ঘৃণ্য হলেও আপত্তি দেখি না। দিনের শেষে তা কবিতা হয়ে উঠল কিনা, সেটাই বিচার্য। স্বয়ং কবিতা কিন্তু এইসব সামাজিক অনুমোদনের পরোয়া করে না। সে শুধু দেখে নিতে চায় অন্তরাত্মার সততাটুকু। বাদবাকি বিচার কবিতাপাঠে অভ্যস্ত পাঠকের। দু-একটি ‘ভাইরাল’ কবিতা পড়ার বোধ নিয়ে কবিতাকে বিচার করতে বসা লোকজনকে কবিও উপেক্ষা করুন। তাঁরা আক্রমণ করতে এলে, এড়িয়ে যান। একান্তই এড়ানো সম্ভব না হলে, তৈরি হোক প্রতিরোধের দল। পড়ে-পড়ে মার খাওয়ার অর্থ নেই কোনো। মূর্খতা-অজ্ঞতার সঙ্গে মেধার সংঘর্ষ বাধলে, লড়াই দীর্ঘমেয়াদি হলেও, জয়ী হবে মেধাই। অবশ্য যদি-না খোদ কবিরাই ‘বাঙালি কাঁকড়ার জাত’— এই প্রবাদ প্রমাণ করতে উঠেপড়ে লাগেন! এ-আশঙ্কাও উড়িয়ে দেওয়া যায় না। বস্তুত, এই আশঙ্কাই সবচেয়ে বেশিবার সত্য বলে প্রমাণিত হয়েছে বাংলার সাহিত্যজগতে...
© তন্ময় ভট্টাচার্য
Comments
Post a Comment