ভালো থেকো নিশীথ অবশেষ — পর্ব ১ : জয়দীপ চট্টোপাধ্যায়



ভালো থেকো নিশীথ অবশেষ : পর্ব ১

- আসলে কী জানো? আমি সেই সব মানুষের দলে… যারা নিজস্ব জগতে, কল্পনার উষ্ণতায় বাঁচে।
- যেমন?
- যেমন… কেউ হয়ত এমনিই কথা বলছে না, বা ইচ্ছে করেই কথা বলতে চাইছে না… আমি ভেবে নিলাম, সে অভিমান করে আছে।
-
- যা নেই, তা আগলে রাখা, তার প্রতিকার, তার নিরাময়, তার জন্য দুশ্চিন্তা… এইসব করতে করতেই অর্ধেক জীবন চলে গেল।
- দুঃখ হয়?
- হয়… আমার মনে হত, আমার অভিমানও সে বুঝবে, সেও চেষ্টা করবে আমার অভিমান ভাঙাতে। একের পর এক ‘সে’ চলে গেছে… আর আমি দেবব্রত বিশ্বাসের গাওয়া গান হয়ে গেছি।
- অদ্ভুত লাগছে…
- কী? এই কথাগুলো? না আমি এইসব বলছি বলে?
- দুটোই। আপনাকে সারাদিন অন্য সময়ে যারা দেখে… মানে, আমিও বুঝতে পারতাম না কখনো।
- বিয়ার আর হুইস্কির ককটেলে এসব বলাচ্ছে ভেবে নাও… কাল সকালে দুটো এস্কালেশন ইমেইল এমন পাঠাব… আর এসব মাথায় থাকবে না।
- হা হা হা… পারেনও আপনি… সত্যি!
- আই অ্যাম সিরিয়াস! ক্রাইসিস, পার্সনাল গ্রাজ, গ্রিভান্স, বিট্রেয়াল, ফেলিওর… খুব শক্তিশালী হলাহলের মত। এমন একাকীত্বে কথা বলা বা শোনা… নরম অনুভূতিগুলো অসাড় করে দিতে পারে, একজনের প্রতি আর একজনের ফিলিংস এমনভাবে রোস্ট করে দিতে পারে, যে বিয়ন্ড রিকভারি।
- জানি… সম্পর্ক ভেঙে গেলে এক্স বিচ অথবা স্লাট হয়ে যায়।
- গোল্ড ডিগার কিংবা অপরচুনিস্টও।
- ইয়া… হোয়াটেভার।
- একটা কথা জিজ্ঞেস করব?
- উম?
- তুমি কি এমন হার্ড খেতে অভ্যস্ত?
- এর পর কী জিজ্ঞেস করবেন? ফিয়ঁসে জানে কি না?

এতক্ষণ পর দুজনে একটু জোরেই হাসল একসঙ্গে। অন্যরা তাকিয়ে দেখল ওদের দিকে একবার। দুজন তিনজন বা চারজনের ছোট ছোট দ্বীপ মাঝে মাঝে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় দল থেকে। নিজেদের মধ্যে কিছুক্ষণ কথা বলে, ব্যক্তিগত সময় কাটায়। এও গেট-টুগেদারের একটা অংশ। অফিসের সহকর্মীদের আউটিং। একটা বড়ো প্রোজেক্ট টীম। শহর থেকে দূরে একটা বিলাসবহুল রিসর্ট, প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, রাতে ক্যাম্পফায়ার জ্বেলে  মদ আর ঝলসানো মাংস। ওয়ান নাইট স্টে করে কাল সকালের ব্রেকফাস্ট করেই যে যার মত বাড়ি। সপরিবার, বড়ো অফিস পিকনিকের সেই পরিবেশ বা যুগ এখন নেই বললেই চলে। টীমের ছেলেমেয়েরা… যাদের পরিবার আছে, তারাও একাই আসে। এও একরকম ‘আজকে রাতের রাজা’ হওয়ার মত ব্যাপার তাদের কাছে। বিবাহিতা মহিলা কর্মীরা আসতে পারেন না, এড়িয়ে যান কিছু একটা বাহানায়। পরে অভিযোগ-অনুযোগ করেন… ‘এত দূরে করলি তোরা!... বললাম ওখানে চ… তাহলে দিনটা কাটিয়ে ম্যানেজ করে ফিরে আসতাম রাতে। অত দূরে সম্ভব?’
     অপ্রতিম আর টায়রা একই অ্যাকাউন্টে আছে, তবে  অপ্রতিম  সিনিয়র ডেলিভারি হেড। প্রোজেক্ট ম্যানেজার কৃষাণুর সঙ্গে অনেকদিনের পরিচয় বলে প্রোজেক্টের সঙ্গে এসেছে। এমনিতে  অপ্রতিমকে মাঝে মাঝেই প্রোজেক্টগুলো তাদের সঙ্গে টেনে নেয় টীম আউটিং-এ। সে কোথাও টীম লাঞ্চ বা ডিনার হোক, অথবা বোলিং অ্যান্ড ড্রিংক্স জাতীয় হ্যাং আউট। অথচ  অপ্রতিম এদের বয়সীই নয়, এরা সকলের পঁয়ত্রিশের নীচে। আর  অপ্রতিমের বয়স কয়েক বছর আগেই চল্লিশ পার করে গেছে। টীমে এত ছেলেমেয়ে থাকতে বিকেলের পর থেকে টায়রাকে  অপ্রতিমের সঙ্গে আলাদা বসে থাকতে দেখে অনেকেই এর ওর দিকে ইশারা করছে, চোখ চাওয়া-চাওয়ি করছে। কিছু বলতে পারছে না।  অপ্রতিম  সকলের সঙ্গে মিশে গেলেও, অফিসের পদটা কারো মাথা থেকে বেরিয়ে যায় না। এদের থেকে দু-ধাপ ওপরে অপ্রতিম । তা ছাড়া, এখানে সেই স্তরের কেউই নেই যে চট করে  অপ্রতিমের কাঁধে হাত রেখে ওদের কথার মাঝে ঢুকে যাওয়ার সাহস দেখাতে পারে। কৃষাণুও তা করবে না। বরং সত্যিই কোনো দরকার পড়লে একবার  ‘অপ্রতিমদা-আ-আ’ বলে হাঁক দিয়ে জানিয়ে দেবে, কেন ডাকা হচ্ছে। কৃষাণু যখন প্রথম কোম্পানি জয়েন করেছিল, সেই সময়  অপ্রতিম ওর ম্যানেজার ছিল। অফিসে তো ভালো রকমই চেনে, এমনকি দুজন একে অপরের ব্যক্তিগত জীবনও কিছুটা জেনে গেছে এতদিনে। কিছু কথা নিজের কাছেই রাখে, কিছুটা খুব বিশ্বস্ত সহকর্মীদের মাঝে আলোচনা হয় মাঝে মাঝে। হয়ে যায়… কথার ফাঁকে।  অপ্রতিমদা কেন একটু বেশিই ব্যস্ত রাখে নিজেকে, কেন বেশি করে এমন টীম আউটিং-এ যায়, উইকেন্ডে সুযোগ পেলেই বেড়াতে চলে যায় পিঠে ব্যাগ ঝুলিয়ে… টীমের এইসব অল্পবয়সী ছেলেমেয়েদের পক্ষে অত জানা বা বোঝা সম্ভব নয়।  অপ্রতিমও চাইবে না, যে তার ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে তৃতীয় ব্যক্তি আগ্রহ দেখাক। কৃষাণুও একটু সাবধানে থাকে, তার নিজের ব্যক্তিগত জীবন অথবা  অপ্রতিমদা সম্পর্কে কেউ কিছু জিজ্ঞেস করলে সচেতন হয়ে যায়। এমনিও, জুনিয়রদের সঙ্গে ড্রিংক নিয়ে বসলে দুটি ত্রিশ এমএল-এর বেশি খায়ও না। নিজে যে এদের ম্যানেজার, সেটাও মনে রাখতে হয়।
     তিনটে ছেলের মাঝে ঢুকে পালা করে পুল খেলছিল  কৃষাণু। সবাই বলে বিলিয়ার্ড… কিন্তু নিয়মের তফাৎ আছে। খেলার টেবিল আর বলগুলোও অন্যরকম দেখতে। অনেকেই ভাব দেখাচ্ছে খুব পারছে, কিন্তু অভ্যেস প্রায় কারোরই খুব একটা নেই… এর ওর শট নেওয়া দেখে হাসছে। মজা করছে। পুল খেলতে খেলতে একটা সাদা বলকে টেবিলের ওপর ঝুঁকে পড়ে এক চোখ দিয়ে নিশানা করার মতো দেখতে দেখতে কৃষাণুও লক্ষ করল টায়রা একদম চোখে চোখ রেখে একটা জিজ্ঞাসু দৃষ্টি নিয়ে  অপ্রতিমের দিকে তাকিয়ে। মেয়েরা কখন পুরুষের দিকে এমন দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে থাকে, কৃষাণু বোঝে। দু পেগের বদলে চার পেগ খেলেও বুঝবে।  অপ্রতিমদাকে মেয়েদের ভালো লেগেই যায়… কিছুক্ষণ কথাবার্তা বললেই ওর ‘কথা বলা’ মানুষকে ইমপ্রেস করতে পারে। অথচ মেয়েটা নাকি এদিকে এনগেজড, বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে একটা পাঞ্জাবী বিজনেসম্যানের ছেলের সঙ্গে। ‘এই কৃষাণু দা-আ-আ… রাইফেল দেব? শুট করবে?’... একটি মেয়েলি কণ্ঠ শুনে চমকে কৃষাণু উঠে দাঁড়াল। প্রাজক্তা… অবাঙালি মেয়ে, কিন্তু বাংলা বলতে পারে হিন্দি টানে। ওর কথা শুনে অন্য ছেলেগুলোও হেসে উঠেছে… কেউ বেশি, কেউ মেপে। প্রাজক্তা আবার হাসির রেশ রেখে বলল, ‘এক আঁখ সে এমন ঘুরছেন… ভাবলাম কিউ সে হবে না, রাইফেল চাই। হা হা!’ কৃষাণুও হেসে হালকা হয়ে ওর দিকে কিউ স্টিকটা এগিয়ে দিয়ে বলল ‘গো অ্যাহেড ট্রাই ইট।’ প্রাজক্তা আরো স্মার্ট, আরো বেশি আদর মেশানো গলায় বলে উঠল ‘আরে দাদা… আপ তো বুরা মান গ্যায়। ওকে চলো লেট মি ট্রাই ওয়ান্স।’ বুঝে মারুক আর না বুঝে… একটা নীল বলে ঠোকা লেগে সেটা পড়েও গেল। হাততালি দিয়ে উঠল সবাই। কৃষাণুও হাততালি দিয়ে উঠল।  'ইয়ে লো দাদা... সি! আই মেড ইট ফর ইয়ু!' বলে সেই এক আদুরে চাহনি নিয়ে কৃষাণুর দিকে তাকিয়ে খিলখিল করে হেসে উঠল প্রাজক্তা।
প্রোজেক্টের বাইরে এমন আউটিংগুলোয় এলে কত কী যে হঠাৎ এমন রঙিন হয়ে ওঠে!


- তুমি বিলিয়ার্ড খেলতে পারো?
- এক্স-কিউজ মি!… আপনার যদি ওই সামনের গ্রীন টেবল্‌ দেখে এই প্রশ্ন মাথায় এসে থাকে… তাহলে বলি– ওরা বিলিয়ার্ড নয়, পুল খেলছে।
- হা হা হা… মানে আমার থেকে ভালোই বোঝো। আমার কাছে যাহাই বিলিয়ার্ড, তাহাই পুল, তাহাই স্নুকার!
- ধ্যাৎ!
- আরে সে কোন ছোটোবেলা গীত শেঠি নামে একজনের পোস্টার দেখেছিলাম। এর বেশি কিছুই জানি না। এখন তো দেখি সব বড়ো হাউজিং, রিসর্ট, গেমিং এনক্লেভে এরকম সব টেবিলে অল্পবয়সী ছেলেমেয়েদের ভিড়!
- যান না… ট্রাই করুন। কৃষাণুদা তো আছে!
- পাগল! কী ভাবে স্টিক ধরব, কী ভাবে মারব…
- সবাই হাসবে।
- ওয়েল…
- বুঝি, এমব্যারাসমেন্ট কেউই চায় না। মেক্‌স সেন্স… ইন আ ওয়ে।
- তুমি যাও না… প্রাজক্তাও তো আছে!
- আপনি প্রাজক্তাকেও চেনেন?!
- চিনি মানে নাম জানি, ব্যাকগ্রাউন্ডস জানি… যেমন আরো অনেককে চিনি। হোয়্যার আর ইউ কামিং ফ্রম?
- না কিছু না… জেনারেলি টিমের বাইরের নিউ কামারদের সকলকে অনেকেই নামে চেনে না… তাই আর কি!

অপ্রতিম  যেন কিছু একটা বুঝতে পেরেছে, এমন ভঙ্গি করে মাথাটা নাড়াতে নাড়াতে দূরে পুল টেবিলের সামনে হইচই করা জটলাটার দিকে আর টায়রার দিকে একবার তাকাল, তারপর ঠোঁট উলটে হেসে হুইস্কির গ্লাসটা নীচে নামিয়ে দূরে ঠেলে দিল। টায়রাও গ্লাসটা সামনের কাচের টেবিলে রেখে আঙুল দিয়ে গ্লাসের মাথার কাছে বোলাতে বলল– ‘কী হল? হাসলেন যে? কিছু ভেবে নিলেন… না?’
‘সব কথা বলতে নেই, না না না বলা যায় না… শুনেছ গানটা?’, একই ভাবে হাসিটা ঠোঁটে ঝুলিয়ে রেখে জিজ্ঞেস করল  অপ্রতিম । টায়রা কিছুক্ষণ চুপ করে রইল ভুরু কুঁচকে। মেয়েটার সঙ্গে কথা বলে একটা জিনিস  অপ্রতিম বুঝতে পেরেছে, মেয়েটার মধ্যে কোনো ভান নেই। মাথার ভেতর কত কী চলে, অত বোঝা যায় না সব সময়ে। শর্ট টার্ম, লং টার্ম গোলও বোঝা যায় না।  অপ্রতিমের মত সিনিয়র কলিগের সঙ্গে র‍্যাপো তৈরি করতে চাওয়াও স্বাভাবিক।  অপ্রতিম  কেমন… কীসে কাজ হয়, কীসে হয় না… সে সব আলাদা প্রসঙ্গ। কিন্তু কথা বলা যাচ্ছে স্বচ্ছন্দে। এই তো কিছুদিনের আলাপ, এই তো কিছুক্ষণের একান্তে বসে কথা বলা… ছোটো ছোটো কিছু ভালো মুহূর্ত, নাই বা হল ঘনিষ্ট বা গভীর সম্পর্কের কেউ… এই বয়সে এসে আর ভরি-রতি মেপে সব কিছু বাছাই করতে ইচ্ছে করে না। মানুষের বয়স বাড়ে, সামাজিক স্তরে এজ সার্কেল তৈরি হয়ে যায় তাকে ঘিরে। তারই বয়সী লোকজনের সঙ্গে বেশি কথা-কাজ। অথচ প্রত্যেক বছর কত নতুন মানুষের সঙ্গে আলাপ পরিচয় হয়। অল্পবয়সী ফ্রেশার্সরা আসে চাকরি পেয়ে। তাদের কাছে অপ্রতিম সিনিয়র। এই সিনিয়রিটির ব্যবধান প্রতি বছর বেড়েই চলেছে। দাড়ি-গোঁফ রাখে না, পাক ধরেছে বলে। জুলপিতেও পাক ধরছে এবার ছিটছিট… এই বেয়াল্লিশে পার করেই। অথচ  অপ্রতিমের ওইসব সাংসারিক আর আদার ব্যাপারী ধাঁচের গল্প ভালো লাগে না। কথায় কথায় অফিস-পলিটিক্স আর কেরিয়ার ওরিয়েন্টেড ক্যাচ ক্যাচ ভালো লাগে না। লোকজন ওকে দেখেই কেন দু-কথার পর এইসব শুরু করে ভেবে পায় না। সফল আর দ্রুত উন্নতি করেছে বলেই কি এভাবে হাড় জ্বালাতে হবে? কিছু বলতে পারে না, এগুলোও একপ্রকার রিলেশনশিপ ডায়নামিক্স। কাউকে চটানো যায় না, জুনিয়র  হলেও না। সময় আর প্রসঙ্গের গুরুত্ব বুঝে শোনে, নাহলে প্রসঙ্গে পালটে কাটিয়ে দেয়। এগুলো শিখে গেছে বয়স আর অভিজ্ঞতার সঙ্গে। এইসব কিছুর মাঝে… টায়রা বা  প্রাজক্তা, বা এদের বয়সী ছেলে-মেয়েগুলো অক্সিজেনের মত। তাই ইচ্ছে করেই আরো আসে পিকনিক বা আউটিং-এ। বেশি করে মেশে এদের সঙ্গে। বিশেষ করে মেয়েদের সঙ্গেই বেশি করে কথা বলতে বা মিশতে ভালো লাগে। অল্পবয়সী, বুদ্ধিদীপ্ত, সুন্দর কথা বলে, ফালতু ওপর-চালাকি করতে যায় না– এমন মেয়েদের সঙ্গে কিছুক্ষণ কোয়ালিটি টাইম স্পেন্ড করতে ভালো লাগে  অপ্রতিমের। অপ্রতিম নিজেকে এই ব্যাপারে ভুল ব্যাখ্যা বোঝানোর চেষ্টা করে না, স্বাভাবিক ভাবেই, একজন পুরুষ হিসেবে ওকে এমন মেয়েরা আকর্ষণ করে, ও ইমপ্রেসড হয়। আর মেয়েরাও স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে ওর সঙ্গে এমন মিশতে বা, একটা দুটো ক্যাজুয়াল ডেটেও অনেকেই আপত্তি করে না। ক্যাজুয়াল ডেট… ক্যাজুয়ালই সব কিছু। একটা ফিকফিক হাসির মাঝে ব্লাশ করতে করতে সামলে নেওয়া, মেপে নেওয়া একজন আর একজনকে… হালকা ড্রিংক আর ডাইনের ফাঁকে ফাঁকে। কেউ খুব মনের কাছাকাছি থাকলে, একটা ইভিনিং ওয়াক, বা লেট নাইট ড্রাইভ।
       ‘নচিকেতার গান… ওটার কথাই বলছেন তো? শুনেছি… আচ্ছা বাহানা এড়িয়ে যাওয়ার! থাক আর কিছু জিজ্ঞেস করব না।’ বলে একটা মিচ করে শব্দ করে গ্লাসের বাকিটা এক ঢোকে খেয়ে নিল টায়রা।
- তুমি বোধহয় কৃষাণুর ব্যাপারে কিছু জিজ্ঞেস করছিলে।
- ও ইয়েস… বাট, একটু আসতে। অ্যাঁ?
- সরি… বলো বলো। কী কেস?
- না না… এমনিই। আপনি কৃষাণুদাকে অনেকদিন চেনেন, না?
- হুম… অলমোস্ট টুয়েল্ভ ইয়ার্স। আমারই আন্ডারে প্রথম প্রজেক্ট ছিল ওর।
- টুয়েল্ভ ইয়ার্স। ওয়াও! উনি এতবছর এই কোম্পানিতেই?
- হুম… সুইচ করল না। করা উচিৎ ছিল।
- সে তো আপনিও করেননি!
- আমি আর ও এক হল?
- কেন এক নয় কেন?
- লুক, আমি অ্যাকাডেমিক বা অফিস পজিশনে যাচ্ছি না… বাট আমি যে সময়ে শুরু করেছি, আমরা অনেক বেশি স্কোপ পেতাম অনসাইটে যাওয়ার। দেয়ারস নাথিং টু হাইড, অনেক পাউন্ড আর ডলার কামিয়েছি। কিন্তু কৃষাণুদের জেনারেশন অতটা পায়নি। আর এখন হাইকের যা অবস্থা। তিন-চার বছরের বেশি নতুনরাই থাকে না! তারপর… ওর ফ্যামিলি আছে… তার গ্রোইং এক্সপেন্সেস থাকে!
- আপনি একটা কথা জানেন কি না জানি না… বাট…
- কী বলো তো?
- কৃষাণুদার ওয়াইফ কিন্তু ডিভর্স ফাইল করেছে…থাকে না একসাথে।
-
- সরি… এগুলো পার্সনাল ব্যাপার।
- ‘অন্যের’ পার্সোনাল ব্যাপার।
- বললাম তো… সরি।
-
- ওকে টপিক চেঞ্জ… জ্যান-এ কোথাও ট্রিপ প্ল্যান করছেন?
-
- এমন করছেন কেন? বললাম তো ভুল হয়ে গেছে! আই মীন ইট!

কথাগুলো টায়রা যতটা সম্ভব গলা নামিয়ে বলল,  অপ্রতিমের দিকে সামান্য ঝুঁকে পড়ে… দূরে একবার দেখেও নিল, কেউ ওদের লক্ষ্য করছে কি না।  অপ্রতিম একটু বাঁকা হাসল, নাক দিয়ে বেরিয়ে এল হাসিটা। তারপর ধীরে সুস্থে একটা সিগারেট ধরাল। চুপ করে ওর দিকে তাকিয়ে ছিল টায়রা... সম্ভাব্য ক্ষমার অপেক্ষায়। সুন্দর দেখতে ধাতব লাইটারটা প্যান্টের পকেটে চালান করে প্রথম টানটা নিয়ে  অপ্রতিম  বলল, “কী জানো… এই যে আমরা এখানে বসে আছি… সবাই… এত কিছু বলছি, করছি… সব একটা রাতের ব্যাপার। রাত গভীর হলেই ক্যাম্প ফায়ারের আগুন ঢিমে হয়ে নিবু নিবু হবে। সকাল উঠে দেখবে ছাইয়ের ওপর জল ঢেলে দিয়ে গেছে কেউ। তারপর কিছু সময় কাটিয়ে যে যার পথে। কৃষাণু আর ওর বউ অতসী তার থেকে অনেক বেশি দিন একসাথে কাটিয়েছে, তাই না?’ প্রতিটা বাক্যর মাঝে একবার করে থামছিল  অপ্রতিম , একটা করে ড্র্যাগ নেওয়ার জন্য সিগারেটের। কথা শেষ করে সোফাতে এলিয়ে বসল, মাথাটা কাত করে সিলিং-এর দিকে তাকিয়ে আর একটা ড্র্যাগ নিয়ে রিং-এর মত ধোঁয়া উড়িয়ে দিল। চোখটা এমন ভাবে বন্ধ করে রাখল, যেন খুব ভারী নেশা উপভোগ করছে। আর কথা বলার ইচ্ছে নেই। টায়রার মনে হল এবার উঠে পড়াই ভালো… আবহাওয়াটা হঠাৎই কেমন ভারী হয়ে গেল একটা প্রসঙ্গের জন্য। কথায় কথায় বুঝতে পারেনি… যে  অপ্রতিম এভাবে নেবে ব্যাপারটা। কৃষাণুর বউয়ের নাম জানে… অবশ্যই জানবে, উনিও নিশ্চয়ই পরিচিত। টায়রা ঝট করে সোফা থেকে উঠে পড়ে বলল ‘আমি একটু ওদিকটা দেখে আসি, কাবাব গ্রিলড হচ্ছে… ধোঁয়া উঠছে বেশ।’ ‘যাবে?... যাও…’ কেমন নিস্পৃহ ভাবে সিগারেটের ধোঁয়ার সঙ্গেই বেরিয়ে এল অপ্রতিমের উত্তর। হঠাৎ এতটা উদাসীনতা প্রত্যাশা করেনি টায়রা। কয়েক পা এগিয়ে শুনল অপ্রতিমের কথাগুলো ‘মাংস পোড়ানোর ধোঁয়া… মাংস ঝলসানো গন্ধ… নাইস!’, এক মুহূর্ত থমকে দাঁড়াল, কিন্তু পিছন ফিরে আর না তাকিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নেমে এলো সেই দিকে যেখানে টীমের তিন-চারজন ইউনো খেলছে রঙিন কার্ড নিয়ে।
        হঠাৎ অতসীর প্রসঙ্গ কেন যে টানতে গেল মেয়েটা! আরো দু পেগ খেতে ইচ্ছে করল অপ্রতিমের। সচেতন ভাবে মনটা অন্যদিকে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করল। অতসীর মুখটা হঠাৎ মনে পড়ে গেল… কতদিন যোগাযোগ নেই! কিন্তু আর ড্রিংক করবে না; পুল টেবিল, ইউনো খেলার আড্ডা, অল্পবয়সী কয়েকটা ছেলের বিয়ারের বোতল হাতে আগুনের পাশে বসে থাকা জটলা, কয়েকটা মেয়ের নিজেদের মধ্যে মোবাইল ফোনে উঁকিঝুঁকি করে একে-তাকে কিছু দেখানো, গ্রিলে কাবাবের ধোঁয়া ওঠা… সব কিছুই এক এক ঘরে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখে নিল অপ্রতিম । কোথায় যাওয়া যায় এখান থেকে… কোথায়? মেয়েটা কেমন এখানে একভাবে কথা বলছিল, তারপর ওখানে গিয়েই ওদের সঙ্গে মিশে গেল। ওর বয়সে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু এখন ক্যাম্প ফায়ার বা গ্রিল-স্ট্যান্ডের ওদিকে গেলে ভাববে ওকে ফলো করেই  অপ্রতিম  ওদিকে এসেছে। ওদিকে যাবে না  অপ্রতিম । হালকা নেশাও ধরেছে… হয়ত বিয়ার আর হুইস্কি দুটোই খেয়েছে বলে। দু তিন-বার টয়লেটে গেলে, ভাতের মত কিছু খেলে হালকা হয়ে যাবে আবার। নিজেকেই নিজে সামলে নিয়ে সংযত পায়ে ধীরে ধীরে হাঁটতে হাঁটতে বাগানের দিকে চলে গেল অপ্রতিম। এর ওর দিকে তাকিয়ে হাসল, চোখ টিপল, হাত নাড়াল… নেশা চড়ছে কাউকে বুঝতে দিল না। সকলের থেকে দূরে, রিসর্টের আউট-হাউজের দিকের পুলটার দিকে চলে গেল। এদিকে রিসর্টের বিলাসী আলোকস্তম্ভ নেই। দুটো হলুদ আলো দেওয়ালে ফিট করা, আর ফুটফুটে চাঁদের আলো আকাশে। লোকজনও কেউ নেই। পুলের জলে পদ্মপাতা ভাসছে, আর টলমল করছে আধখাওয়া চাঁদের প্রতিবিম্ব।
(চলবে ...) 

© জয়দীপ চট্টোপাধ্যায়
অঙ্কন : শাশ্বত বন্দ্যোপাধ্যায়

Comments

Popular posts from this blog

অনিন্দ্য সরকারের গুচ্ছ কবিতা : গান ছুঁয়ে ছুঁয়ে

অয়ন হালদারের পাঁচটি কবিতা

মুন্নী সেনের গুচ্ছ কবিতা : সম্বোধন