ঋতু স্মরণ: সায়ন সিংহরায়



#ঋতু_স্মরণ

গ্রীষ্মের প্রচন্ড  দাবদাহের মধ্যে অকাল শ্রাবণ নেমে আসে ৩০ শে মে ২০১৩। ঋতুপর্ণ পাড়ি দেন দিকশূন্যপুরে। ক্রিয়েটিভিটির চূড়ায় পৌঁছে হঠাৎ নাটকীয় অন্তর্ধান! এই ভাবেই যাওয়া মানায় ঋতুপর্ণ’র মতো প্রতিভার।রবীন্দ্রনাথের গানের কথা যেন প্রতিভাত হয় তাঁর সংক্ষিপ্ত জীবনে -‘আপনাকে এই জানা আমার ফুরাবে না’, সেই জানার সঙ্গে সঙ্গে চেনা। 
সত্যজিৎ পরবর্তী সময়টা কেমন হবে - এই রচনার সূত্রপাত করে দিয়েছেন ঋতুপর্ণ। রবীন্দ্রনাথ ও মহাভারত এই দুইয়ের মধ্যে যে সেতুবন্ধন সেই কর্মযজ্ঞের কাঠামোর স্রষ্টাও তিনি। তিনি নিজের মতো করে রাবীন্দ্রিক ভাবনা কনসিভ করেছেন , ডিকন্সট্রাক্ট  করেছেন , কখনও বা ভিতরে ভিতরে তর্ক করেছেন রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে আমায় তোমাকে ডিবাংক করতে হবে , সর্বদা পদানুসরণ করলে আমার চলবে না। চেনা গন্ডি, চেনা ছককাটা লক্ষ্মন রেখার বাইরেও যেতে হবে আমাকে। ছুঁতে হবে এক নতুন দিগন্তকে । একটা  শুরুয়াত হবে। নতুনকে চেনার, জানার , বোঝার বা শেখার এক গভীর তৃষ্ণা ছিল ঋতুপর্ণর মধ্যে।  ‘তোমার কাছ থেকে আমি আমার উত্তরাধিকার পেয়ে এবার আমি আমার পথ চলছি’ - মহাভারতের এই পাঠ ঋতুপর্ণ ওঁর  জীবনদর্শনে এবং কাজের মধ্যে বহুবার সম্পৃক্ত করেছেন। ওঁর মধ্যে ছিল সৃজনশীলতার এক জ্বলন্ত আগ্নেয়গিরি ,যা নিয়ত বিস্ফোরণের অপেক্ষায় থাকত।কখনও কখনও সেই আগ্নেয়গিরি  উপচে বেরিয়ে আসত লাভা, তার সৌন্দর্য্যে আমরা মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে যেতাম।

তাঁর মধ্যে এমন এক সৌন্দর্য ছিল ,এমন একটা আভিজাত্যের বিনয়সৌন্দর্য যা আজ এই পীড়িত খরার দেশে প্রায় সম্পূর্ণ অনুপস্থিত । না-বলা কথাকে, খুঁড়ে খুঁড়ে আবিষ্কার করা, চরিত্রদের প্রতি সমতা তাঁকে চলচ্চিত্র-পরিচালক হিসাবে স্মরণীয় করে রাখবে।
একটা মানুষ নদীর মতো  নিজেকে ভাঙতে ভাঙতে এগিয়েছে । নতুন নতুন বাঁক নিয়েছে বার বার । চেহারাতেও রিফ্লেক্ট করেছে মনের অবস্থা । শ্যামলা রঙের ঝাঁকড়া চুলওয়ালা থেকে মুন্ডিতমস্তক বৌদ্ধসন্ন্যাসী - সবেতেই সৌন্দর্যের সজলতা। ১৯ শে এপ্রিল ছবির দমবন্ধ করা বার্গম্যানিও তীব্রতা (intensity) তাঁকে যে পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিল তা ঈর্ষণীয় । পারমিতার একাকীত্ব , ঝিনুকের প্রতিবাদ ,বনলতার বিলাপগাথা , কেয়ার দাম্পত্যের ভাঙ্গনকাল , বিনোদিনীর জীবনতৃষ্ণা কিংবা চিত্রাঙ্গদার 'রুদ্র'র পূর্ণ নারী হয়ে ওঠার প্রবল ইচ্ছা - ঋতুপর্ণ এবং তাঁর সৃষ্ট চরিত্রগুলো এক সারিতে দাঁড়িয়ে ।সবাই যেন বড় নিবিড় একাকী ।

শব্দচয়ন ক্ষমতা ছিল অসাধারণ ।উৎসবের ভিড়েও একা মানুষগুলোর বেদনা ঋতুপর্ণ খুব সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন।সঙ্গীতের আবহ নির্মাণ ও সিকোয়েন্স ছিল প্রশংসনীয়।উৎসব ছবিতে ‘দেখি নাই কভু দেখি নাই এমন তরণী বাওয়া’র মধ্যে ছুঁয়ে থাকে  শারদ -বিষন্নতা ।দর্শক ,স্রোতা মুগ্ধ হয়ে থাকে খেলা ছবিতে ‘পালাচ্ছে’ , ‘তিতলির মন খারাপের স্রোতের টানে চলছে বয়ে তিস্তা’। বেনারসে ভেসে থাকা বজরায় বিহারী ও বিনোদিনীর চুম্বনদৃশ্য চলছে। আর একদিকে বেনারসের ঘাট-ঘাট জুড়ে চলছে উৎসব। এই দুই বিপরীত সিকোয়েয়েন্স যখন একটা ভাষ্য তৈরি হচ্ছে ‘চোখের বালি’ সিনেমায় সেখানে  ‘একি লাবন্যে পূর্ণ প্রাণ’ গানটা হচ্ছে- ওটা একটা মাস....জোহান সিবাস্তিয়ান বার্খ -এর কোরাল অর্কেস্ট্যাল ওয়ার্কের মতো।

‘রেনকোট’ ছবিতে নায়কের চাকরির প্রয়োজনের থেকেও খুব বেশি দরকার ওর প্রেমিকার সঙ্গে দেখা হওয়া বা  জানা কেমন আছে সে এখন আর এই সিকোয়েন্সটা ভিসুয়ালি ট্রিট না করে -‘পিয়া তোরা ক্যায়াসা অভিমান ’ গানের মাধ্যমে যখন ট্রিট করলেন দর্শকের মনে গেঁথে গেল প্রতিটি শব্দ। ‘বাড়িওয়ালি’ ছবিতে বনলতার  ক্রাইসিসের মধ্যে দিয়ে সব দৃশ্যপট তৈরি হয়েছে - সেখানে ‘ওলো মধুমাসে বিয়া-বাসর সাজাই মধুর কলস দিয়া -মধুমাসে মধুর মিলন-কলস কলস মধুর আয়োজন-যতই মধু দাও না কলস ভইরা -গরল লিখন খন্ড ই কেমন কইরা...’এই গানটা টুকরো টুকরোভাবে গোটা ছবি জুড়ে তাড়া করেছে বনলতার সেই ক্রাইসিসকে। কোনও কোনও বিদায়ের চিহ্ন থেকে যায় দীর্ঘদিন । শোক স্তিমিত হয়ে এলেও স্মৃতি পিছু ছাড়ে না। গুমসুম  বেনারসীর ভাঁজে যেমন যত্ন লেগে থাকে তেমন তার প্রতিটি কাজে সেই যত্ন লেগে আছে। জীবনের সাথে লড়াই করেছেন নিরন্তর। শিক্ষার সঙ্গে ,জ্ঞানের সঙ্গে ,বইয়ের  সঙ্গে, অক্ষরের সাথে ঘর করতে ভালোবাসতেন । তারাই ছিল তাঁর দিনরাতের সঙ্গী। আবার ‘সঙ্গী জনবিহীন শূন্য  ভবনে ’ তারাই ছিল তাঁর প্রানের আরাম-বিরাম।জীবনকে যাপন করার উৎসমুখ...


© সায়ন সিংহরায়
সম্পাদনা: ঋতুপর্ণা খাটুয়া
ছবিঋণ: ইন্টারনেট। 

Comments

Popular posts from this blog

অনিন্দ্য সরকারের গুচ্ছ কবিতা : গান ছুঁয়ে ছুঁয়ে

অয়ন হালদারের পাঁচটি কবিতা

মুন্নী সেনের গুচ্ছ কবিতা : সম্বোধন