রাতের কথা
রাত বিষয়টা ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করি, দিনের থেকেও। আমার কাছে রাত রহস্যময়। রাতের সাথে মানসিক, শারীরিক বেশ কিছু গভীর পরিবর্তন উপলব্ধি করতে পারি, সারাদিনের বিভিন্ন সময়ের বিভিন্ন কথার অনুরণন কানের চারপাশে, মাথার মধ্যে ঘুরপাক খেতে থাকে। জলপ্রবাহ স্থির হয়ে গেলে যেভাবে পলি থিতিয়ে পড়ে, দিনের শেষে রাতে আমরা, আমাদের ভাবনা গুলো থিতিয়ে পড়ে। কিন্তু সবচেয়ে আশ্চর্য এটাই যে মানুষ ভীষণ বদলে যায় রাতে। আসলে দিনের সাপেক্ষে বলতে গেলে অবশ্যই তাই।
রাতে বিশেষ কিছু অদ্ভুত বায়োকেমিক্যাল রিঅ্যাকশন মানুষের শরীরে হয়। যে কারণে এই সময় মানুষের দৃষ্টি ভঙ্গি, মানসিকতা, কথাবার্তা ও সার্বিক প্রতিক্রিয়ায় বেশ পরিবর্তন হয়। সুস্থিত থেকে কোনোকিছু করা এইসময় করা, বলা একেবারেই সম্ভব নয়। একটা বিষয় মাথায় রাখা প্রয়োজন আমাদের মধ্যে অনেকেই এমন আছেন যাঁরা যখন দাবী করেন যে তাঁরা স্থির ভাবনা চিন্তা নিয়ে কোনোকিছু বলতে চাইছেন, তখনই তাঁরা সবচেয়ে বেশি দুঃস্থিত হন। এবার এই ধরনটা রাতে আমাদের সবার ঘাড়ে একরকম চেপে বসে।
" হেথা নয় হেথা নয়, অন্য কোথা অন্য কোনোখানে " ভাবনায় জারিত'রা এই ব্যাপারটা বেশ ভালো বুঝতে পারেন। কারণ তাঁরা কখনো কোথাও এক নৌকোতে থাকতে পারেন না। রাত এইক্ষেত্রে অপ্রাসঙ্গিক, অপ্রত্যাশিত কাছে আসার আগুনে ঘৃতাহুতি দিয়ে যায়। আর পরের দিন সকালে উঠে মনে হয় যে, এই কাল কী ভয়ঙ্কর একটা কাজ করে ফেলেছি( এবার মনে নাও হতে পারে)। যাঁরা মনে করেন রাতের আলাপ এক অনুগচ্ছন্তু প্রবাহ তাঁদের কথা বাদ দিচ্ছি, কারণ কারো ব্যক্তিগত ভাবনায় হস্তক্ষেপ করা আমার উদ্দেশ্য নয়। আমি যতটুকু অবজার্ভ করেছি ততটুকু তুলে ধরার চেষ্টা করে চলেছি।
মাঝরাতে দুজন দুঃখী মানুষ যদি পরস্পরের সংস্পর্শে আসেন, এবং কথোপকথন শুরু হয় আমার মতে তার চেয়ে সাংঘাতিক দুর্ঘটনা আর কিছু হতে পারে না। কথা গড়ায়। মিল খোঁজা চলে। অমিল গুলো সস্নেহে নজর আন্দাজ করা হয়। ফাঁকে ফাঁকে বহুবিধ বিষয়ের মাঝে প্রাধান্য পায় বিচ্ছেদ-বিপনন, বিপন্নতা, আবেগ, আসক্তিময় আসা যাওয়া। সারাদিন নিজের চারপাশে তৈরি করে রাখা দুর্ভেদ্য দূর্গ প্রাকার অবলীলায় ধুলিস্যাৎ করে দিয়ে দুই অজানা দ্বীপের মাঝে সেতুবন্ধন চলে। যে সেতুর কোনো পূর্ব পরিকল্পনা নেই।
আরে পূর্ব পরিকল্পনা করে কিছু হয় না, আবার কিছু বিষয়ে অবশ্যই পূর্ব পরিকল্পনা প্রয়োজন নাহলে সেই মাঝ সমুদ্র থেকে মনে হয়, ধুর বাবা কেন এলাম, ফেঁসে গেলাম, কী করে ফেললাম। এই সময়ে প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব কাজ না করলে ব্যস সব ঘেঁটে ঘন্টা। আর সত্যি আমাদের জেনারেশন, বিশেষত আমার বয়সীরা বেশীরভাগ দীর্ঘসূত্রী। আর তাদের দীর্ঘসূত্রিতায় একটা অদ্ভুত আত্মশ্লাঘা বোধ করে তারা। ওই জন্য সারাদিনের শেষে রাতটা'কে বেছে নেয়। কী অদ্ভুত একজন ঘুম প্রিয় মানুষ রাত্রির তিনটের সময়ে শুতে যাচ্ছেন কেন? না তাঁর ডিপ্রেশন । যা কাটাতে তিনি রাতে গান শুনছেন, স্যোশাল মিডিয়ায় অ্যাকটিভ, এবং আরো আনুষঙ্গিক অনেক কিছু করছেন। এবার কেন করছেন তিনিই জানেন। তাঁর হয়তো মনে হচ্ছে যে এসব করে তাঁর ডিপ্রেশন থেকে তিনি রেহাই পাচ্ছেন।
কিন্তু আদতে তা হয়না। এটা অনেকটা সেই চেইন রি অ্যাকশনের মতো। শেষ হয়না, হবেও না কোনোদিন। কেবল মাত্র এই চেইন টা ভাঙতে পারলে তবেই এর থেকে বেরিয়ে আসা সম্ভব। আমরা সহজেই পারবো। সাড়ে এগারোটা বা বারোটার পর মোবাইলের নেটটা অফ করে শুয়ে পড়ুন। একদিন ঘুম আসবে না এক সপ্তাহ আসবে না, তারপর ঠিক আসবে। দেখবেন অনেক অনেক সমস্যার সমাধান হয়ে গেছে। কাজেই রাত জাগা টা বন্ধ করে দিলে ডিপ্রেশন এবং আনুষঙ্গিক সমস্ত কিছু বাপবাপ বলে পালাবে।
© শাশ্বত বন্দ্যোপাধ্যায়
Comments
Post a Comment